রোলস রয়েস গাড়ি এত দামি কেন

maxresdefault (29)
জীবনযাপন

রোলস রয়েস গাড়ি এত দামি কেন

রাজকীয় গাড়ি রোলস রয়েস

গাড়ির জগতে আভিজাত্য, বিলাসিতা আর সম্মানিত জীবনের প্রতীক হিসেবে রোলস রয়েসের অবস্থান শীর্ষে। ব্রিটিশ ব্র্যান্ড রোলস রয়েস কোনো সাধারণ যানবাহন তৈরী করে না। এটি এক ঐতিহাসিক ব্র্যান্ড, যা যুগের পর যুগ ধরে বিশ্বের ধনকুবের, রাজপরিবার ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের গাড়ি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। রোলস রয়েস কে বলা হয় ‘গাড়ির রাজা’, কারণ গাড়িগুলো সৌন্দর্য, নীরবতা এবং আরামের দিক থেকে অতুলনীয়। সেকারণে এই ব্রান্ডের প্রতিটি মডেল যেন একেকটি যন্ত্রচালিত শিল্পকর্ম।

বিশ্বের অন্যতম দামি ও বিলাসবহুল এই গাড়ির পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ও চমকপ্রদ ইতিহাস, জটিল নির্মাণ প্রক্রিয়া, আর এমন সব কারিগরি রহস্য যা পৃথিবীর অন্য কোন গাড়িতে নেই।

রোলস রয়েস গাড়ি এত দামি কেন?

জন্ম থেকে যাত্রা: রোলস ও রয়েসের স্বপ্ন

চার্লস রোলস এবং হেনরি রয়েসের নামানুসারেই রোলস রয়েস ব্রান্ডের নামকরণ করা হয়েছে।  রোলস ছিলেন এক অভিজাত পরিবারের সন্তান, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং গাড়ির দারুণ ভক্ত। তিনি নিজে রেসিং করতেন এবং গাড়ির ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। অন্যদিকে হেনরি রয়েস ছিলেন একেবারে সাধারণ ঘরের ছেলে, যিনি বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর নিখুঁত নকশা, কারিগরি দক্ষতা আর মেশিন তৈরির প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল।

১৯০৪ সালের মে মাসে, এই দুইজনের প্রথম দেখা হয় এক ব্যবসায়িক উদ্যোগের মাধ্যমে। রয়েস তখন একটি ছোট নিখুঁত গাড়ি তৈরি করেছিল, যা রোলসের নজর কাড়ে। রয়েসের এই গাড়ি তৈরীর মূল উদ্দেশ্যই ছিল একদম শব্দহীন ইঞ্জিনের সাহায্যে গাড়ি ৈতরী করা। সেই গাড়ি দেখে রোলস এতটাই মুগ্ধ হয় যে, সে এই গাড়িগুলো তার শোরুমে ‘Rolls-Royce’ নামে বিক্রি করার ঘোষণা দেয়। অার সেখান থেকেই শুরু হয় এক অনন্য জুটি, যার ফলে ১৯০৬ সালে গড়ে ওঠে ‘Rolls-Royce Limited’।

রোলস রয়েসের প্রথম যুগান্তকারী মডেল ছিল Silver Ghost। গাড়িটি ১৯০৭ সালে কোনো ধরনের যান্ত্রিক সমস্যা ছাড়াই একটানা প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সক্ষম হয়। এটা ছিল তখনকার সময়ের এক অসাধারণ কীর্তি। ওই সময়কার সংবাদপত্রগুলো একে ‘The Best Car in the World’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। সেই গাড়ির নীরবতা, স্থিতিশীলতা, আরাম এবং নির্ভরযোগ্যতা তৎকালীন সময়ে গাড়ির ধারণেই আমূর বদলে দেয়।

হাতে গড়া নিখুঁত শিল্পকর্ম

রোলস রয়েস এর প্রতিটি গাড়ি হাতে গড়া শিল্পকর্মের মত। এসব গাড়ি কোনো কারখানায় যন্ত্রচালিত প্রযুক্তিতে তৈরী হয় না। বরং রোলস রয়েসের গাড়িগুলো এখনো পুরোপুরি হাতে তৈরি হয়।

প্রতিটি রোলস রয়েস বানানো হয় ব্যক্তির পছন্দ অনুযায়ী। অর্থাৎ গাড়িগুলো সম্পূর্ণভাবে কাস্টমাইজড। একই মডেলের একটি গাড়ির সাথে আরেকটি গাড়ির কোন মিল নেই। আপনি যদি বলেন, “গাড়ির রঙ হবে আমার বিড়ালের চোখের রঙের মতো”, কিংবা “ভেতরে হাতের লেখায় আমার নাম খোদাই থাকবে” তাও সম্ভব। এমনকি এক ধনী আরব ব্যবসায়ী তার গাড়ির ইন্টেরিয়র সাজাতে নিজের খেজুর বাগানের কাঠ ব্যবহার করেছিলেন! আবার কেউ কেউ গাড়ির আসনে রেশমি চামড়া ব্যবহার করিয়েছেন। যা শুধু বরফের অঞ্চলে থাকা এক ধরনের বিরল গরুর চামড়া থেকে বানানো হয়।

গাড়ির কাস্টমাইজেশন কতটা জটিল, তার উপর সেই গাড়ি তৈরীর সময়কাল নির্ভর করে। তবে সাধারণত একেকটি গাড়ি বানাতে ৬ মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত সময় লাগে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি রোলস রয়েস ফ্যান্টম মডেলে, ভেতরের কাঠের কাজ করতেই প্রায় এক মাস সময় লাগে। কারণ সেই কাঠ ১০ বছরের পুরনো গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং প্রতিটি প্যানেলকে সূক্ষ্মভাবে পালিশ করা হয় যেন তার রঙ এবং টেক্সচার একদম একই রকম দেখায়।

গাড়ির প্রতিটি আসন আলাদাভাবে হাতে সেলাই করা হয়। এমনকি রঙ দেওয়ার কাজেও থাকে মানুষের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ। একটি গাড়ির পুরো শরীরে অন্তত ৫টি লেয়ারে রঙ দেওয়া হয় এবং প্রতিটি লেয়ার হাতে পালিশ করা হয় যেন আয়নার মতো ঝকঝক করে।

রোলস রয়েসের কারখানার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত অংশটি হলো ‘The Surface Finish Centre’, যেখানে গাড়ির শেষ চেহারা চূড়ান্ত করা হয়। সেখানে একেকজন বিশেষজ্ঞ দিনভর শুধু গাড়ির গায়ে আলো ফেলে ক্ষুদ্রতম দাগ বা অসমতা খুঁজে বের করেন, যেন একটুকুও ত্রুটি না থাকে। এই নিখুঁত মান আর খুঁতখুঁতে যত্নের কারণেই রোলস রয়েস কেবল একটি গাড়ি নয়, বরং প্রকৃত আভিজাত্যের প্রতীক।

স্পিরিট অফ একস্টেসি: সৌন্দর্যের প্রতীক

রোলস রয়েসের সামনে চকচকে ধাতব এক নারী ভাস্কর্য দেখা যায়। এই ভাস্কর্যটির নাম ‘Spirit of Ecstasy’। এটি রোলস রয়েসের ইতিহাস, সৌন্দর্য, আর শিল্পচেতনার অনন্য প্রতীক।

১৯১১ সালে প্রথম রোলস রয়েসের গাড়িতে এই ভাস্কর্য যুক্ত হয়। এর নির্মাতা ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ  ভাস্কর Charles Robinson Sykes। প্রথম দিকে একে বলা হতো “The Whisper”, পরে এটি রূপান্তরিত হয়ে বর্তমান ‘Spirit of Ecstasy’ রূপে আসে, যেখানে নারীটি যেন বাতাসে ভেসে চলেছেন, যা গতি, মুক্তি ও সুনিপুণ সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

আজকের দিনে এই ভাস্কর্যটি আধুনিক প্রযুক্তির সাথে একীভূত হয়ে আরও আকর্ষণীয় হয়েছে। বর্তমান মডেলগুলোতে গাড়ি স্টার্ট দিলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপরে উঠে আসে এবং বন্ধ করলে আবার নিচে ঢুকে যায়। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী এর গায়ে সোনার প্রলেপ, ক্রিস্টাল গ্লাস, এমনকি হীরাও বসানো হয়।

২০২৩ সালে রোলস রয়েস তাদের নতুন ইলেকট্রিক মডেল ‘Spectre’-এর জন্য Spirit of Ecstasy-এর ডিজাইন আরো অ্যারোডাইনামিক এবং আরো সূক্ষ্ম করেছে। Spirit of Ecstasy শুধুমাত্র একটি কার কোম্পানির লোগো নয়। এটি এক ধরনের জীবনদর্শনের প্রতীক।

প্রযুক্তি আর নীরবতার রাজত্ব

রোলস রয়েসের গাড়িগুলোর সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর অত্যন্ত নিঃশব্দ ইঞ্জিন। এতটাই নিঃশব্দ যে, আপনি গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে বুঝতেই পারবেন না সেটি চালু আছে নাকি বন্ধ। একবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে একটি রিপোর্টে বলা হয়, রোলস রয়েসের প্রকৌশলীরা একসময় গাড়ির ঘড়ির টিকটিক শব্দও বাদ দিতে চেয়েছিল; কারণ সেটাই তখন গাড়ির সবচেয়ে জোরালো শব্দ ছিল! এই গাড়িগুলোতে V12 ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়, যা নিজের শক্তিশালী পারফরম্যান্সের বিপরীতে এক আশ্চর্য নিঃশব্দতা বজায় রাখতে সক্ষম।

কিন্তু শুধু ইঞ্জিন নয়, গাড়ির পুরো গঠনেই রয়েছে এক অসাধারণ শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। প্রতিটি রোলস রয়েস গাড়িতে প্রায় ১৩০ কেজি পরিমাণ সাউন্ড-ড্যাম্পেনিং উপাদান ব্যবহার করা হয়। এমনকি জানালার কাচ পর্যন্ত ডাবল-গ্লেজড, যা বাইরের শব্দ সম্পূর্ণভাবে আটকে দেয়। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দকেও অত্যন্ত মৃদু আর মার্জিত রাখা হয়েছে।

এর পাশাপাশি রোলস রয়েসের সাসপেনশন সিস্টেমকেও বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাকে বলা হয় “Magic Carpet Ride”। এর মানে, গাড়ি চলার সময় রাস্তার কোনো গর্ত, ঢেউ বা ধাক্কা যাত্রী অনুভবই করেন না। গাড়ির সামনে বসানো ক্যামেরা সারাক্ষণ রাস্তার অবস্থা স্ক্যান করে, এবং সাসপেনশনকে তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাডজাস্ট করে নেয়।

এছাড়া রোলস রয়েস এখন EV বা Electric Vehicle প্রযুক্তির দিকেও এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত তাদের প্রথম ইলেকট্রিক মডেল Spectre, নিঃশব্দতার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছে। কারণ সেখানে ইঞ্জিনই নেই, আছে শুধুই ব্যাটারি, যার ফলে শব্দ আরও কম এবং আরও সূক্ষ্ম হয়েছে।

বিলাসিতা মানেই শুধু দাম নয়

রোলস রয়েস গাড়িগুলোর দাম শুরু হয় প্রায় ৫-৬ কোটি টাকা থেকে, আর কাস্টমাইজেশন অনুযায়ী সেই দাম পৌঁছাতে পারে ১০-১৫ কোটি টাকা বা তারও অনেক বেশি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে দাম দিয়ে রোলস রয়েসের মান বোঝা যায় না। রোলস রয়েস কেবল কোনো গাড়ি নয়—এটি এক ধরনের জীবনদর্শন। তাই এর ক্রেতারা গাড়িগুলোকে টাকার অঙ্কে মাপে না।

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রাজপরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রের সফল ব্যক্তিরা এই গাড়ি ব্যবহার করেন। অনেকেই আবার নিজের নামে কাস্টম মডেল পর্যন্ত তৈরি করান। এক রুশ ধনকুবের নিজের গাড়ির ইন্টেরিয়র হীরার আসন দিয়ে সাজিয়েছেন। তাছাড়া আরব রাজপুত্ররা নানা সময়ই বিভিন্ন ধরনের পাগলামি সখ পূরন করেন রোলস রয়েস কাসমাইজেশনের মাধ্যমে।

বাংলাদেশেও এখন রোলস রয়েস দেখা যায়। বাংলাদেশে গার্মেন্টস খাতের শীর্ষ উদ্যোক্তা, বিদেশে প্রতিষ্ঠিত ধনকুবের, কিংবা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কিছু মানুষের কাছে হাতে গোনা কয়েকটি রোলস রয়েস গাড়ি রয়েছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।