রাসেল ভাইপার কতটা ভয়ংকর
রাসেল ভাইপার কতটা ভয়ংকর
ভূমিকা
এশিয়ার অন্যতম একটি মারাত্নক সাপ রাসেলস ভাইপার। এই সাপ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান চারটি বিষধর সাপের একটি। বর্তমানে সাপটি রাসেলস ভাইপার নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হলেও, এর আসল নাম চন্দ্রবোড়া। অনেক জায়গায় একে উলুবোড়া নামেও ডাকা হয়।
শক্তিশালী বিষ আর লক্ষ্যনীয় চেহারার কারণে এই সাপ কে খুব সহজেই আলাদা করা যায়। সাপটি দংশনের সময় প্রচুর পরিমাণে বিষ ঢেলে দেয়। তাই দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা নিতে না পারলে প্রাণহানির ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বিষধর চন্দ্রবোড়া একটি সংকটাপন্ন ও মহাবিপন্ন প্রাণী। তাই বিগত কয়েক বছরে এই সাপ খুব কমই চোখে পড়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর বিচরণ আবারও বাড়ছে। গত এক মাসেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাসেলস ভাইপারের দেখা পাওয়া গেছে। ফলে বিষধর এই সাপ নিয়ে দেশজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
রাসেলস ভাইপার
বাংলাদেশে প্রায় ১০৪ প্রজাতির সাপ পাওয়া যায়। এর মধ্যে মাত্র ৩০ প্রজাতির সাপ বিষধর। এসবের মধ্যে আবার সবচেয়ে বিষধর হলো রাসেলস ভাইপার।
জীব বিজ্ঞানের যে শাখায় সাপ নিয়ে গবেষণা করা হয়, তার নাম অফিওলজি (Ophiology)। স্কটল্যান্ডের প্রকৃতিবিদ প্যাট্রিক রাসেল কে বলা হয় “ভারতীয় অফিওলজির জনক”। তিনি ভারতে কাজ করার সময় এই অঞ্চলের সাপগুলো নিয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৭৯৬ সালে প্যাট্রিক রাসেল তার “অ্যান অ্যাকাউন্ট অফ ইন্ডিয়ান সারপেন্টস” বইতে চন্দ্রবোড়া সাপের বর্ণনা তুলে ধরেন। তখন থেকে তার নাম অনুসারে এই সাপ রাসেলস ভাইপার নামে পরিচিতি পায়। এর বৈজ্ঞানিক নামও Daboia russelii।
চন্দ্রবোড়া উন্মুক্ত ও কিছুটা শুষ্ক পরিবেশে বাস করতে পছন্দ করে। এরা সাধারণত ঘাস, ঝোপঝাড়, ফসলের মাঠ এবং বনাঞ্চলে বিচরণ করে। এরা খুব ভালো গাছে উঠতে পারে। সাধারণত দুটি কারণে এরা গাছে ওঠে, প্রথমত খাবারের খোঁজে এবং দ্বিতীয়ত গায়ে সূর্যের তাপ পোহাতে। চন্দ্রবোড়া মূলত স্থলভাগের সাপ হলেও, এরা জলেও বেশ দ্রুতগতিতে চলতে পারে। সে কারণে বর্ষাকালে কচুরিপানার সঙ্গে ভেসে ভেসে চন্দ্রবোড়া বহুদূর পর্যন্ত নিজেদের স্থানান্তর ঘটাতে পারে। রাসেলস ভাইপার মূলত নিশাচর; তাই এরা সাধারণত রাতের বেলা বিচরণ করে। সাপটি খাদ্য হিসেবে ইঁদুর, ব্যাঙ, টিকটিকি ও ছোট পাখি খেয়ে থাকে।
সরীসৃপ বিশেষজ্ঞরা জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলের ফসলি মাঠে ইঁদুরের আনাগোনা বেশি ছিল বলে, এসব অঞ্চলে এই সাপ বেশি বিচরণ করতো। সেকারণে রাসেলস ভাইপার বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপ হিসেবেই পরিচিত ছিল। বর্তমানে পদ্মা অববাহিকা ধরে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলায় চন্দ্রবোড়া বিস্তৃত হচ্ছে। রাসেলস ভাইপার শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান এবং চীনেও দেখতে পাওয়া যায়। ভারতের যত লোক বিষধর সাপের কামড়ে মারা যায়, তাদের অধিকাংশই চন্দ্রবোড়ার দংশনের শিকার হয়।
সাপের বৈশিষ্ট্য
রাসেলস ভাইপারের গায়ে চাঁদের মত দাগ থাকার কারণে এদের নাম হয়েছে চন্দ্রবোড়া। চন্দ্রবোড়ার দেহ মোটাসোটা, লেজ ছোট ও সরু। এরা সাধারণত বাদামি, তামাটে হলুদ বা মাটির মত রঙের হয়ে থাকে।
প্রাপ্তবয়স্ক রাসেল ভাইপার সাধারণত ৪ ফুট লম্বা হয়। তবে এদের শরীর লেজসহ সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। চন্দ্রবোড়ার মাথা চ্যাপ্টা ত্রিভুজাকার এবং এদের শরীর থেকে খানিকটা আলাদা। এই ভাইপারের শক্তিশালী দেহ সুবিন্যস্ত শক্ত আঁশ দ্বারা আবৃত। এরা এক ধরনের হিস জাতীয় শব্দ তৈরি করে এবং এদের শব্দ অন্য যেকোনো সাপের শব্দের চেয়ে অনেক তীব্র।
রাসেল ভাইপারের সিরিঞ্জের মত দুটি দাঁত আছে। সাধারণত এসব দাত ৬ ছয় মিমিটার লম্বা হয়। যা প্রায় ১ ইঞ্চির চার ভাগের এক ভাগের সমান। সাপের বয়সের সাথে সাথে এর দাতে দাঁতের আকার বৃদ্ধি পেতে থাকে। কোন সাপের দাঁত কতটুকু লম্বা হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে তার শরীর এবং মাথার গঠন ও আকারের উপর। প্রাপ্তবয়স্ক একটি চন্দ্রবোড়ার তীক্ষ্ণ সূচের মতো এসব দাত হাফ থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণও লম্বা হতে পারে। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো রাসেল ভাইপার তার দুটি দাঁত পৃথকভাবে যেকোনো দিকে ঘোরাতে পারে। সেই সাথে এরা এদের মুখ প্রায় ১৮০°পর্যন্ত খুলতে পারে। সে কারণে এরা এদের দাঁত দিয়ে যেকোনো দিকে এদের সুবিধামতো কামড় বসাতে পারে।
কতটা মারাত্নক
রাসেল ভাইপার এর বিষ পৃথিবীর সবচেয়ে বিষধর সাপের বিষ গুলোর মধ্যে অন্যতম। সাপের শরীরের আকারের সাথে বিষের পরিমাণ নির্ভর করে। সাপ যত বড় হবে তার শরীরে বিষও তত বেশি থাকবে। এই সাপ যখন কাউকে কামড়ায় তখন এর বীষ গ্রন্থি থেকে বিষ নিঃসরিত হয়ে দাঁতের মাধ্যমে শিকারের শরীরে প্রবেশ করে। সাপের মাথায় চোখের পেছনে এই বিষ গ্রন্থির অবস্থান। এরা মাত্র ১ সেকেন্ডের অর্ধেকেরও কম সময়ের মধ্যে শিকারকে কামড় দিতে পারে। বিষক্রিয়া শুরু হবার পর, শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে, কিডনি বিকল হতে পারে, স্নায়ু অবশ হয়ে ফুসফুসের কার্যকারিতা হারিয়ে যেতে পারে, এমনকি হার্ট অ্যাটাকেরও ঝুঁকি থাকে।
রাসেল ভাইপার কামড়ানোর পর থেকে শরীরে তীব্র টনটনে ব্যথা অনুভূত হতে থাকে। সাপে কামড়ানোর ১৫ মিনিট পর থেকে আক্রান্ত স্থান ফুলতে শুরু করে। আক্রান্ত ব্যক্তির চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে এবং চোখের ঝাপসা দেখতে শুরু করে। এর বাইরেও ভাইপারের বিষ শরীরে নানান ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
সতর্কতা ও করণীয়
চন্দ্রবোড়া কামড়ালেই যে মানুষ মারা যাবে বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ও ফিরেছেন। তবে সাপে কামড়ানোর শিকার হলে বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
সাপে কামড়ানোর পর বেশি নড়াচড়া করা যাবে না। বিশেষ করে শরীরের যে অংশে সাপ দংশন করেছে, খেয়াল রাখতে হবে সেই অংশটি যেন কিছুতেই নাড়াচড়া করানো না হয়। চিকিৎসকরা বলেন, যে অংশে সাপে কামড়ায় তার ঠিক উপরে এবং নিচে একটি কাঠির সাহায্যে বেঁধে ফেলতে হবে; যাতে সাপের বিষ সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। সেই সাথে হাতে কোন আংটি, চুড়ি, ব্রেসলেট, ঘড়ি এগুলো পড়া থাকলে তা খুলে ফেলতে হবে।
সাপে কামড়ানোর পর আতঙ্কিত হওয়া যাবে না বা, রাগান্বিত হয়ে সাপকে ধরার জন্য সাপের পিছে দৌড়ানো যাবে না। সাপে কামড়ানো ব্যক্তিকে আশ্বস্ত করতে হবে। অনেক সময় দেখা গেছে যে, কাউকে এমন সাপ কামড়েছে যা মোটেও বিষধর নয়; কিন্তু শুধু সাপে কামড়েছে এই আতঙ্কেও রোগীর পরিস্থিতি অনেক জটিল হয়ে গেছে।
রাসেল ভাইপারের কামড়ে মানুষ দ্রুত মারা যায়, এই ধারণাটিও একটি গুজব। এই সাপে কামড়ানোর ন্যূনতম তিন দিনের মধ্যে কেউ মারা যায় না। এমনকি রাসেল ভাইপার এর কামড় খাওয়ার পর ১৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার নজির আছে। তাই বলে চিকিৎসা নিতে দেরি করার কোন সুযোগ নেই। সাপে কামড়ানোর পর আক্রান্ত জায়গায় মুখ দিয়ে চুষে কিছুতেই বিষ বের করা যাবে না। সচেতনতার অভাবে হাসপাতালে না গিয়ে ওঝার কাছে যাওয়ার কারণে বেশিরভাগ মানুষের অপমৃত্যু হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুততম সময়ে এমন কোন হাসপাতালে নিতে হবে, যেখানে টিটেনাস টক্সাইড বা এন্টিভেনম জাতীয় উপাদান দিয়ে দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব। বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর বা বিষ নিষ্ক্রিয় করতে পারে এমন উপাদানকে অ্যান্টিভেনম বলা হয়। দ্রুত অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিলে, অ্যান্টিভেনমের অ্যান্টিবডিগুলো বিষকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির সুস্থ হয়ে ওঠে।
আতঙ্কিত হবার কিছু নেই
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপের এখন প্রজনন মৌসুম চলছে, তাই বর্তমানে এই সাপ বেশি দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে রাসেলস ভাইপারের অভিযোজন ক্ষমতাও আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, কোন একটি জেলায় রাসেল ভাইপার সাপের উপস্থিতি পাওয়া গেছে মানে, ওই জেলার সবজায়গায় এই সাপ বিচরণ করছে এমন ধারণা অমূলক। বরং বাংলাদেশের যত ধরনের সাপ পাওয়া যায় তার অধিকাংশেরই কোন বিষ নেই। তার চেয়েও বড় কথা, এই সাপ নিজ থেকে তাড়া করে কাউকে দংশন করে না। মূলত অসাবধানতাবশত কেউ এই সাপের গায়ে পারা দিলে তখনই এই সাপ ছোবল দেয়।
বর্তমানে যে কোন সাপ কামড়ানোর যে কোন সংবাদই মানুষ রাসেল ভাইপারের উপদ্রব বলে মনে করছে। মনে রাখতে হবে সারা বাংলাদেশের সকল সাপই রাসেলস ভাইপার নয়। সেকারণে সাপের আতঙ্কে দিন কাটানো এক ধরনের উন্মাদনা। রাসেলস ভাইপার কামড়ালেই মানুষ মারা যায় না। সতর্কতা অবলম্বন করে, সময়মত সঠিক চিকিৎসা নিতে পারলে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব।