মিয়ানমার কি বাংলাদেশের ধৈর্য পরীক্ষা করছে
মিয়ানমার কি বাংলাদেশের ধৈর্য পরীক্ষা করছে
সাম্প্রতিক সময়ে দফায় দফায় মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল ও গুলি বাংলাদেশের ভেতরে এসে পড়ছে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বা যুদ্ধবিমান প্রায়ই বাংলাদেশের আকাশসীমায় ঢুকে পড়ছে। এমনকি মিয়ানমারের হামলায় বান্দরবান জেলার তুমব্রু সীমান্তে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বেশ কয়েকবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে, প্রতিবাদ জানানো হলেও, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। সেই সাথে বাংলাদেশও ধৈর্যের চরম পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের এমন আচরণ কি অনিচ্ছাকৃত? নাকি নতুন করে সংঘাত সৃষ্টির পেছনে মিয়ানমারের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে?
প্রতিটি দেশের সেনাবাহিনী, তাদের দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কাজ করে। কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাতমাদো নামে পরিচিত। এই সেনাবহিনীর কাজই যেন, নিজের দেশের মানুষকে হত্যা করা। মিয়ানমার একটি বহু জাতির দেশ। এ দেশে বামার, কাচিন, কারেন, শান, রাখাইন, চীন, মোন সহ অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে। এসব জাতীর লোকেরা, মিয়ানমারের ৭টি প্রদেশে বাস করে। যাদের বেশ কয়েকটি রাজ্য বিগত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন চাচ্ছে। এদের দমন করতে গিয়ে দেশটির সেনাবাহিনী বহুমুখী গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। মিয়ানমার ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হবার পর থেকে অধিকাংশ সময় সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটির সামরিক বাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদী জনগোষ্ঠীদের দমনের নামে দেশ জুড়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন এবং বিস্তৃত জনপদে অগ্নিসংযোগের মত ঘৃণ্য কর্মকান্ডকে নিয়মিত বিষয়ে পরিণত করেছে। দেশের জনগণের খাজনার টাকা দিয়ে কেনা অস্ত্র, তাতমাদো বাহিনী তাদেরই জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করতে ব্যবহার করছে। ২০২০ সালের নির্বাচনে অং সান সুচি নির্বাচিত হলেও, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়। তারপর থেকে গণতন্ত্রকামীরা সেনাবাহিনী এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যতই প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সেনাবাহিনীর দমন ও নির্যাতন। সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে এপর্যন্ত ২ হাজার ২৪৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। সেই সাথে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে গনতন্ত্রপন্থী শীর্ষ নেতাদের। এবং ১৫ হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভ্যুত্থানের পর ২৮ হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং বিভিন্নভাবে ঘরছাড়া হয়েছে প্রায় আট লাখ মানুষ। মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী বামাররাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এছাড়া চীন ও কায়াহ প্রদেশেও মানবাধিকার পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়। বর্তমানে উত্তর রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ব্যাপক সেনা অভিযান চালাচ্ছে। তারই প্রতিক্রিয়া আমরা বাংলাদেশ থেকে দেখতে পাচ্ছি।
চলতি বছরের আগস্ট মাসের শেষের দিক থেকে, মিয়ানমার বারবার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে, বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরী করছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যুদ্ধপরিস্থিতির ফলে ব্যাপক গোলাগুলি চলছে। বিশেষ করে উত্তর রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ব্যাপক সেনা অভিযান চালাচ্ছে। তারই গোলা এসে পড়ছে বাংলাদেশে। এই অস্থিতিশীলতায় চূড়ান্ত ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, মিয়ানমার হয়তো বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাবে না। তবে মিয়ানমার সামরিক জান্তার ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য থাকার বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার পর, ৮ লাখ রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি হারিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। মিয়ানমারে এখনও ৬ লাখ রোহিঙ্গা রয়ে গেছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন সাম্প্রতিক অস্থিরতা, মিয়ানমারে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদেরকে কৌশলে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য, ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। মিয়ানমার অতীতে চীন ও থাইল্যান্ডের আকাশসীমাও লঙ্ঘন করেছে। তবে সেজন্য তারা ক্ষমা চেয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে, এবং তারপর আর এধরনের কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটায়নি। কিন্তু বাংলাদেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘনের পর, বেশ কয়েকবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে, কঠোর প্রতিবাদ জানানো হলেও, তারা কোন দুঃখ প্রকাশ তো করেই নি, বরং একই ঘটনা বারবার ঘটাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে, তার ধরন কিছুটা ভিন্ন। এবার তাতমাদো বাহিনী শুধু রোহিঙ্গাদেরকে হামলা করছে না। বর্তমানে মিয়ানমারের অন্যান্য নৃগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষকেও টার্গেট করা হয়েছে।
মিয়ানমার সুস্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করলেও, বাংলাদেশ কেন এর জবাব দিচ্ছে না, এই প্রশ্নে বিশ্লেষকেরা দুই ধরনের মন্তব্য করেছেন। এক পক্ষ মনে করছে, মিয়ানমারের মর্টার শেল বাংলাদেশে পড়লেও, এর লক্ষ্যবস্তু বাংলাদেশ ছিল না। তাই এমন পরিস্থিতিতে সামরিক জবাব না দিয়ে, কূটনৈতিক প্রক্রিয়া আরো জোরদার করা দরকার। অন্য পক্ষ মনে করছেন, মিয়ানমার সীমান্তগুলোতে বাংলাদেশের সেনা সম্মেলন ঘটিয়ে ক্ষমতার প্রদর্শন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে বাংলাদেশের সামরিক জবাবও দেয়া উচিত। তারা বলছেন এই মর্টার শেল মিয়ানমার সেনাবাহিনী ছুড়েছে নাকি, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ছুঁড়েছে তা দেখার বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, যেখান থেকে আক্রমণ এসেছে, সেই উৎসস্থল ধ্বংসে বাংলাদেশ চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে। বান্দরবানের ঘুমধুম তুমব্রু সীমান্তের মিয়ানমার অংশে, সে দেশের সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে ব্যাংকার স্থাপন করে, ভারী অস্ত্রও জমা করেছে। যা বাংলাদেশ অংশ থেকেই দেখা যায়। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, যেহেতু মিয়ানমার বারবার একই ঘটনা ঘটাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এটি জাতিসংঘ সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে ওঠানো দরকার। রোহিঙ্গাদেরকে আবারো মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের তৎপরতা মিয়ানমার ভালোভাবে দেখছে না। এছাড়া জাতিগত নিধন চালানোর জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চলমান আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার এবং আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় পড়ার কারণেও তারা ক্ষুদ্ধ। সেজন্য মিয়ানমার যে কোন উপায়ে বাংলাদেশকে হয়ত সংঘাতে জড়াতে চাইছে। বাংলাদেশ যদি সামরিকভাবে সংঘাতের জবাব দেয়, তাতে মিয়ানমারের সুবিধা হবে। কুকুর মানুষকে কামড় দিলে তো, মানুষও কুকুরকে কামড়াতে পারে না। তাই মিয়ানমারের মত পাগলা কুকুরের সাথে, কূটনৈতিক সমাধানের পথে আগানোই শ্রেয়। এছাড়া নতুন করে যাতে মিয়ানমারের নাগরিকরা অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। সেই সাথে সীমান্ত নিরাপত্তা ও টহল জোরদার করা হয়েছে।
ভারতের মিজোরাম অঞ্চলের কাছে, মিয়ানমারের চিন প্রদেশেও সাধারণ নাগরিকদের উপর হামলা এবং তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে মিয়ানমার সোনাবাহিনী। চীন প্রদেশে দুটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী চীন ডিফেন্স ফোর্স ও চিন ন্যাশনাল আর্মি, বহুদিন ধরেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শসস্ত্র আন্দোলন চালাচ্ছে। এসব সশস্ত্র বাহিনীর সাথে কোন সম্পর্ক না থাকলেও, তাতমাদো বাহিনী বহু নিরপরাধ লোকের গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেজন্য এসব এলাকার বহু মানুষ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। মিয়ানমারের সাথে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত বলতে একটা পাহাড়ি নদী, যার নাম টিয়াউ। ভরা বর্ষায় অনেক পানি থাকলেও, বছরের অন্যান্য সময় এই নদী হেটেই পার হওয়া যায়। অতীতে এই সীমান্ত একবোরেই শিথিল থাকলেও, বিগত কয়েক বছরে এখানে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। তার মধ্যেও হাজার হাজার মিয়ানমারের নাগরিক ভারতে অনুপ্রবেশ করছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টিকে ভালোভাবে না নিলেও, মিজোরামের মূখ্যমন্ত্রী এসব শরনার্থীদেরকে সাদরে গ্রহণ করছেন। কারণ মিজোরামের মিজো জাতি এবং মিয়ানমারের চিন সম্প্রদায় ঐতিহাসিকভাবে মূলত একই নৃগোষ্ঠী। দেশ ভাগের সময় শুধুমাত্র তারা অলাদা দেশে পড়েছে, কিন্তু সংস্কৃতিগত ভাবে তারা এক জাতি। তাই মিয়ানমার থেকে আসা কাউকেই মিজোরাম ফিরিয়ে দিচ্ছে না। মিজোরামের মূখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা মনে করেন, মানবিক কারণেই এদের ফিরিয়ে দেয়া ঠিক নয়, এমনকি রোহিঙ্গাদেরও ভারতের ফিরিয়ে দেয়া উচিত নয়।
বর্তমান পরিস্থিতিকে মিয়ানমারের জনগণের পাপের ফসল বলা যায়। তাতমাদো সামরিক বাহিনী যখন রোহিঙ্গাদের উপর নির্বিচার হামলা শুরু করেছিল, তখন মিয়ানমারের বহু জনগণ সামরিক বাহিনীকে সমর্থন জানিয়ে বলেছিল, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের লোক নয়। তাদের দেশ থেকে বের করে দিয়ে সেনাবাহিনী সঠিক কাজ করেছে। এমন ঘোরতর অন্যায়কে যারা সমর্থন দিয়ে, সেনাবাহিনীর অবৈধ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করেছিল, তাদেরই অনেকে এখন সেনাবাহিনীর হাতে গুম, খুন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তখন হয়ত তারা ভেবেছিল, রোহিঙ্গাদের মত সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করলে কি আর এমন যায় আসে। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা থেকে সাহস সঞ্চার করে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির উপর দমন পীড়ন চালাতেও দ্বীধাবোধ করছে না। অতীতে এমন পরিস্থিতিতে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচিও নিরব ছিলেন। এমনকি সুচি আন্তর্জাতিক আদালতে বলেন, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা হলেও, তাকে কোনভাবেই গণহত্যা বলা যায় না। যে সামরিক বাহিনীর পক্ষ নিয়ে সুচি রোহিঙ্গাদের প্রতি হওয়া অন্যায় কে সমর্থন করেছিল, সেই সামরিক বাহিনীই সুচির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নির্বাচনী আইন এবং রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনের জন্য ১৮ টি মামলা করেছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিশেষ আদালতে সুচির বিচারও হচ্ছে। সবগুলো অভিযোগ প্রমানিত হলে, ৭৬ বছর বয়সী এই নেত্রীর ১৫০ বছরের কারাদন্ড হতে পারে।