মিয়ানমারের সামরিক শক্তি
মিয়ানমারের সামরিক শক্তি
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামরিক শক্তি নিয়ে গবেষণা করে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা ১৪২ টি দেশের সামরিক সামর্থ্য নিয়ে গবেষণা করে, একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। ৮ ক্যাটেগরিতে ৪৬ টি বিষয়ের মান নির্ণয় করে এই র্যাংকিং করা হয়েছে। তালিকায় মিয়ানমারের অবস্থান ৩৯ তম এবং বাংলাদেশ আছে ৪৬ তম অবস্থানে। তারমানে সামরিক শক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ মিয়ানমারের চেয়ে ৭ ধাপ পিছিয়ে আছে। শুধু তাই নয়, মিয়ানমারের সামরিক শক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, দেশটির নির্বাচিত সরকারকে দমন করে, ক্ষমতা দখল করার পর, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশগুলোকে মিয়ানমারের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে নিষেধ করা হয়। সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো মিয়ানমারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
মিয়ানমারকে অস্ত্র দেয় কারা?
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নাম তাতমাদো। সত্যি কথা বলতে গেলে, তাতমাদো আসলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নয়; বরং বলাযায় সমগ্র মিয়ানমার দেশটাই তাতমাদো বাহিনীর সম্পত্তি। কারণ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হবার পর থেকে এই বাহিনীই মূলত মিয়ানমার শাসন করে আসছে। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এরপরই আছে রাশিয়া, চায়না, ভারত এবং জাপান। এই তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান ৯ম। জনসংখ্যার বিচারে সামরিক শক্তির দিক থেকে মিয়ানমার তার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। দেশটির বহরে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র থেকে শুরু করে নজরদারি করার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি পর্যন্ত সবই রয়েছে। আয়তনের বিচারে মিয়ানমার বাংলাদেশে তুলনায় প্রায় ৫ গুণ বড়। কিন্তু মিয়ানমারের জনসংখ্যা বাংলাদেশের মাত্র ৩ ভাগের এক ভাগ। মিয়ানমার প্রতি বছর তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট এবং সামরিক সামর্থ্য বাড়িয়েই যাচ্ছে। ২০২২ সালে প্রতিরক্ষা খাতে মিয়ানমারের বরাদ্দ সাড়ে ২২৮ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেট ৩৮৯ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের সামরিক বাজেট মিয়ানমারের থেকে বেশি হলেও, সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশ পিছিয়েই আছে। বাংলাদেশ বনাম মিয়ানমারের সামরিক সক্ষমতার তুলনা অনেকটা এরকম: মিয়ানমারের সেনা সদস্য আছে চার লাখ; আর বাংলাদেশের আছে এক লাখ ৬৫ হাজার। মিয়ানমারের প্যারামিলিটারি আছে ৫০ হাজার, বাংলাদেশের আছে ৬৮ লাখ। মূল সেনাবাহিনীর বাইরে, সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সদস্যদেরকে প্যারামিলিটারি বলা হয়। প্যারামিলিটারির সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বের মধ্যে ১ নম্বর। কারণ বাংলাদেশ আনসার বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক প্যারামিলিটারি ফোর্স। আনসারের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬১ লাখ। ভূমিতে আক্রমণ চালানোর জন্য মিয়ানমারের ট্যাংক আছে ৬৬৪ টি, বাংলাদেশের ৩২০ টি। মিয়ানমারের সাঁজোয়া যান ১৫৮৭ টি, বাংলাদেশের ৮৩৭ টি। মিয়ানমারের স্বয়ংক্রিয় কামানের সংখ্যা ১৯০ টি এবং সাধারণ কামান ১৮৬৯ টি, বাংলাদেশের যথাক্রমে মাত্র ২৭ টি এবং ৩৭১ টি। এছাড়া মিয়ানমারের রকেট প্রক্ষেপণ যন্ত্র আছে ৪৮৬ টি, বাংলাদেশের মাত্র ৬৯ টি। মিয়ানমারের ২৮০ টি বিমান সম্পন্ন বহর আছে। বাংলাদেশের আছে ৯০ টি। ফাইটার এয়ারক্রাফট মিয়ানমারের আছে ৫৫ টি, বাংলাদেশের ৪৪ টি। তবে মিয়ানমারের ২১ টি ডেডিকেটেড অ্যাটাক এয়ারক্রাফট এবং ৯ টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার থাকলেও, বাংলাদেশের একটিও নেই। মিয়ানমারের প্রশিক্ষণ বিমান ৯৩ টি, বাংলাদেশের ৬৩ টি। তবে দুই দেশের কোনটিরই সামুদ্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুব বেশি উন্নত নয়। মিয়ানমারের যুদ্ধবহরে নৌযান আছে মোট ১৫৫টি, বাংলাদেশের ১১২ টি। মিময়ানমারের টহল জাহাজের সংখ্যা ১৩৩টি, বাংলাদেশের মাত্র ৩০টি।
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী মিয়ানমারের কাছে সমরাস্ত্রের বিপুল ভা-ার রয়েছে। মিয়ানমার তাদের ব্যবহৃত সকল ভারী অস্ত্র বিদেশ থেকে কেনে। তবে, হালকা অস্ত্র তৈরির জন্য মিয়ানমারের নিজস্ব সমরাস্ত্র কারখানা আছে। ২০১৯ সালে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন টিম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। মিয়ানমার কোন কোন দেশ থেকে অস্ত্র কেনে, সেই রিপোর্টে তার বিররণ ছিল। সামরিক জান্তার নিপীড়নে দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যখন ব্যাপক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তখনো সাতটি দেশের ১৪ টি কোম্পানি মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবারহ করে আসছিল। ২০১৬ সাল থেকে চীন, উত্তর কোরিয়া, ভারত, ইসরায়েল, ফিলিপাইনস, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের কোম্পানিগুলো মিয়ানমারের কাছে যুদ্ধ বিমান, সাঁজোয়া যান, যুদ্ধজাহাজ, মিসাইল এবং মিসাইল লঞ্চার বিক্রি করেছে। রিপোর্ট প্রকাশের পর মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহবান জানানো হয়েছিল। কোন দেশে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনে অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে এমন আশঙ্কা থাকলে, সেখানে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি বা সরবারহ আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থি। জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত একটি চুক্তিতে এই নিয়মের কথা বলা আছে। চীন ওই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ হয়েও, মিয়ানমারের কাছে অবাধে অস্ত্র বিক্রি করে গেছে। প্রতিবেশী দেশ চীন এবং ভারতের সাথে মিয়ানমারের অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক। তাই ভারত আর চীনই মিয়ানমারের অস্ত্র চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করেছে। অতীতেও মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর উপর নিষেধাজ্ঞা আসার পর, ভারত আর চীন মিয়ানমারকে সমর্থন জুগিয়েছে। মিয়ানমারের বেশিরভাগ ফাইটার বিমান, সাঁজোয়া যান, বন্দুক এবং যুদ্ধজাহাজ আসে চীন থেকে। সুসম্পর্কের খাতিরে, ভারত ২০১৮ সালে মিয়ানমারকে একটি রুশ নির্মিত সাবমেরিন উপহার দিয়েছে। এটিই তাদের একমাত্র ডুবোজাহাজ। ভারত আর চীনের পরেই রাশিয়া, ইসরাইল এবং ইউক্রেন মিয়ানমারের অন্যতম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। মিয়ানমার সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ বিমান এবং সাঁজোয়া যান কিনেছে রাশিয়া থেকে। এছাড়া সার্বিয়া থেকে রকেট এবং কামানের গোলার সবচেয়ে বড় চালান আসারও প্রমাণ আছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল এক বিবৃতিতে বলেছে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশটির সামরিক জান্তা মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর চীন, রাশিয়া এবং সার্বিয়া দেশটিকে অস্ত্র সরবারহ করা চালিয়ে গেছে। এসকল অস্ত্রই ব্যবহার করা হয়েছে, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে দেশটির রাজনীতি সচেতন সাধারণ জনগণকে দমনের কাজে। ওই বিবৃতিতেই মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল।
এাত্র সাড়ে ৫ কোটি জনসংখ্যা দেশ হলেও, সামরিক শক্তির দিক থেকে মিয়ানমার যথেষ্ট এগিয়ে। এর কারণ হল বন্দুকের নলই মিয়ানমারের ক্ষমতার উৎস। দেশটি চালায়ই সেনাবাহিনী, তাই সামরিক দিক থেকে যথেষ্ট সক্ষমতা না থাকলে, এত বড় দেশ নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব নয়। বহু দিন ধরে সামরিক শাসন চলে আসলেও, মিয়ানমারের সাধারণ জনগণ আর সামরিক শাসন চায় না। যদিও এই সামরিক বাহিনীকে তারা অতীতে ব্যাপক সমর্থন জানিয়েছিল, যখন তারা রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার অভিযানে নেমেছিল। বিশেষ করে মিয়ানমারের বৌদ্ধ সস্প্রদায় রোহিঙ্গাদের হত্যাকে ন্যায়সঙ্গত দাবি করে, সারা দেশে জনমত গড়ে তুলেছিল। যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের মূল মন্ত্রই হল অহিংসা, সেখানে মিয়ানমারের বৌদ্ধরা সবচেয়ে ন্যাক্যারজনক মানবতা বিরোধী কর্মকান্ড ঘটানোর কারণে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানায়। অবশ্য সেই পাপের ফল এখন মিয়ানমারের জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। এখন শুধু দেশটির সংখ্যালঘুরাই নয়, বরং মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ট জাতি বামারাও, তাতামাদো বাহিনীর হাতে নিপিড়ীত হচ্ছে। সেসব কারণে তৈরী হওয়া, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সামরিক অস্থিরতার আলামত বাংলাদেশের সীমান্তেও উত্তেজনার সৃষ্টি করছে।