মারিয়ানা ট্রেঞ্চ
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ
সূচনা
পৃথিবীর সমুদ্রের নিচে লুকিয়ে থাকা এক অবিশ্বাস্য গভীর রহস্যের জগৎ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ। এটি শুধু একটি গভীর খাতই নয়, বরং এটি যেন আমাদের গ্রহের এক গোপন রাজ্য। যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না। এখানে পানির চাপ এত বেশি যে, একটি বাস নিয়ে গেলে, তারা পানির চাপে সঙ্কুচিত হয়ে এত ছোট হয়ে যাবে যে, বাসটি মানুষের হাতের তালুতে রাখা যাবে।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম সমুদ্র খাত। এটি প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম অংশে, মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের ঠিক পূর্ব পাশে অবস্থিত। এর সর্বনিম্ন গভীরতা প্রায় ১০,৯৮৪ মিটার বা ৩৫ হাজার ৮৭৬ ফুট। তারমানে, যদি মাউন্ট এভারেস্টকে উল্টো করে এই খাতের মধ্যে বসানো হয়, তবু তার চূড়ো মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তল পর্যন্ত পৌছাবে না।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ কীভাবে গঠিত হয়েছে?
পৃথিবীর উপরের স্তরটি বিশাল বিশাল একাধিক টুকরোতে ভাগ হয়ে আছে, যেগুলোকে বলা হয় টেকটোনিক প্লেট। এই প্লেটগুলো প্রতি বছর খুব ধীরে, কয়েক সেন্টিমিটার করে নড়া চড়া করে। পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলেই মূলত মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সৃষ্টি হয়েছে।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ গঠিত হয়েছে এমনই এক জায়গায়, যেখানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট ধীরে ধীরে ফিলিপাইন সাগরীয় প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে। এই ঢুকে যাওয়ার প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় সাবডাকশন (Subduction)।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি বছর প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট প্রায় ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার ফিলিপাইন সাগরীয় প্লেটের নিচে সরে যাচ্ছে। টেকটোনিক প্লেটের এই চলাচল একেবারে বন্ধ হয়নি, বরং এখনও চলছে। তাই বলা যায়, মারিয়ানা ট্রেঞ্চ দিন দিন আরো গভীর হচ্ছে।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সবচেয়ে গভীর অংশের নাম চ্যালেঞ্জার ডিপ (Challenger Deep)। এটি ট্রেঞ্চের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এবং এর গভীরতা প্রায় ১০,৯৮৪ মিটার বা ৩৫,৮৭৬ ফুট। এই গভীরতা এত বেশি যে, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টকেও এখানে বসানো হলে, প্রায় ২ কিলোমিটার গভীর পানির ডুবে থাকবে।
তবে মারিয়ানা ট্রেঞ্চ শুধু একটা গভীর গর্তই নয়। এটি আমাদের পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক কার্যকলাপ, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশগত পরিবর্তন বোঝার জন্য এক এক “জ্যান্ত ভূতাত্ত্বিক গবেষণাগার”। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই গভীর খাদে লুকিয়ে আছে এমন সব প্রাণী, জীবাণু এবং রাসায়নিক উপাদান, যা হয়তো আমাদের চিকিৎসা, প্রযুক্তি বা পৃথিবীর ইতিহাস বোঝার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া, সাবডাকশন অঞ্চল থেকে ভূমিকম্প ও সুনামির উৎপত্তি হয়। তাই এসব প্রাকৃতিক রহস্য বোঝার ক্ষেত্রেও মারিয়ানা ট্রেঞ্চ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চে প্রথম মানব অভিযান
মানুষ কোনোভাবেই সরাসরি মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরে নামতে পারবে না। কারণ আমাদের শরীর সমুদ্রের পানির এই চাপ সহ্য করতে পারবে না। এখানে নামতে নামতেই মানুষের হাড়গোড়, ফুসফুস সব চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। তাই বিশেষভাবে তৈরি শক্তিশালী সাবমেরিনেই কেবল মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরে নামা সম্ভব।
১৯৬০ সালে মানুষ প্রথমবারের মত মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সবচেয়ে গভীর অংশ চ্যালেঞ্জার ডিপ এর রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করে। সেই ঐতিহাসিক অভিযানে ছিলেন দুইজন সাহসী মানুষ ডন ওয়ালশ এবং জ্যাক পিকার্ড। ডন ওয়ালশ ছিলেন মার্কিন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট, আর জ্যাক পিকার্ড হলেন সুইস বিজ্ঞানী ও অভিযাত্রী। তাঁরা “ট্রিয়েস্ট” (Trieste) নামের এক বিশেষ ধরনের সাবমেরিনে চড়ে এই অভিযান চালান।
ট্রিয়েস্ট দেখতে অনেকটা বিশাল ডিম্বাকার ট্যাংকের মতো ছিল। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে গভীর সমুদ্রের ভয়ঙ্কর চাপ সহ্য করতে পারে। সাবমেরিনটি ধীরে ধীরে গভীরে নামতে নামতে একসময় পৌঁছে যায় প্রায় ১০,৯১৬ মিটার গভীরতায়। সেই গভীরে নামতে তাঁদের প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় লেগেছিল।
ট্রিয়েস্ট যখন নিচে পৌঁছায়, তখন বাইরের চাপ ছিল এত বেশি যে, প্রতি বর্গইঞ্চিতে প্রায় ১৬,০০০ পাউন্ড বা ৭২৫৭ কেজি চাপ পড়ছিল। সেই গভীরে পৌঁছে তাঁরা প্রায় ২০ মিনিট অবস্থান করেছিলেন। অবাক করা বিষয় হলো, তারা মারিয়ানা ট্রেঞ্চের নিচে চিংড়ির মতো এমন কিছু অদ্ভূত প্রাণীর দেখা পেয়েছিলেন যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না।
এরপর অনেক বছর ধরে কেউ আর চ্যালেঞ্জার ডিপে নামার সাহস করেনি। অবশেষে, ২০১২ সালে হলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরন এককভাবে সেখানে নামেন। তিনি Deepsea Challenger নামের একটি বিশেষভাবে তৈরি ডুবোযানে চড়ে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরে গিয়েছিলেন। জেমস ক্যামেরন একা একা চ্যালেঞ্জার ডিপে নেমে প্রায় ৩ ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেছিলেন। সেই অভিযান থেকে অনেক ছবি, ভিডিও ও নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।
এরপর ২০১৯ সালে, মার্কিন অভিযাত্রী এবং ব্যবসায়ী ভিক্টর ভেস্কোভো নামেন চ্যালেঞ্জার ডিপে। তিনি চড়েছিলেন এক অত্যাধুনিক সাবমেরিনে, যার নাম “লিমিটিং ফ্যাক্টর” (Limiting Factor)। এটি তৈরি হয়েছিল একেবারে বাণিজ্যিকভাবে বারবার গভীরে নামার উপযোগী করে। তাঁর মিশনের শুধু গভীরে নামাই নয়, বরং বৈজ্ঞানিকভাবে নতুন প্রাণীর খোঁজ করাও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। এই অভিযানে তিনি চ্যালেঞ্জার ডিপের তলদেশ থেকে কিছু অজানা প্রজাতির প্রাণী ও নমুনাও সংগ্রহ করেন।
তবে একাধিক অভিযানের পরেও মারিয়ানা ট্রেঞ্চের অজানা জগৎ আজও বিজ্ঞানীদের কাছে এক বিশাল রহস্যের ভাণ্ডার হয়ে রয়ে গেছে।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের প্রাণী
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীর অংশে এমন সব প্রাণী বাস করে, যাদের দেখলে মনে হয় তারা যেন কোনো বিজ্ঞান কল্পকাহিনির চরিত্র। কারণ, সেখানে এমন চিরস্থায়ী অন্ধকার আর পানির চাপ এত বেশি যে সেখানে সাধারণ প্রাণীর পক্ষে বেঁচে থাকা একপ্রকার অসম্ভব। তবু সৃষ্টিকর্তা এমনসব প্রাণীকেও তৈরি করেছেন, যারা এমন চরম পরিবেশের সঙ্গেও মানিয়ে নিতে পারে।
তাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য প্রাণী হলো হিরোন্ডেলিয়া গিগাস (Hirondellea gigas)। এটি এক ধরনের গভীর সমুদ্রের ক্রাস্টেশিয়ান, দেখতে অনেকটা চিংড়ির মতো। এই ছোট্ট প্রাণীটি চরম অন্ধকার, হাড়ভাঙা ঠাণ্ডা এবং ভয়ঙ্কর চাপের মধ্যেও অনায়াসে টিকে থাকে। বৈজ্ঞানিকদের গবেষণায় জানা যায়, হিরোন্ডেলিয়া গিগাসের শরীরে এক বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা তাকে গভীর সমুদ্রের অত্যধিক চাপ থেকে রক্ষা করে। এছাড়া, তারা খাদ্য হিসেবে সমুদ্রতলের পচনশীল পদার্থ বা জৈব পদার্থ খেয়ে বেঁচে থাকে।
এছাড়া, মারিয়ানা ট্রেঞ্চের মধ্যে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত আকারের মাছ। অনেক মাছের শরীর নরম, যেন জেলির মতো। তাদের শরীের কোন হাড় নেই, যেন গভীর সমুদ্রের চাপে তাদের হাড়-গোড় ভেঙে না যায়। এখানকার কোন কোন প্রাণী নিজস্ব আলো তৈরি করতে পারে; যাকে বলা হয় বায়োলুমিনেসেন্স (Bioluminescence)। এই আলো দিয়ে তারা শিকার ধরতে, বিপদ থেকে বাঁচতে বা সঙ্গীর খোঁজে সংকেত দিতে পারে।
আরও এক বিস্ময়ের কথা হলো, এখানে অণুজীব (microbes)-ও বাস করে, যারা চরম অবস্থায় বেঁচে থাকতে সক্ষম। যেমন, এখানে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে যারা পাথরের ফাটলে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ভেতর বসবাস করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এদের মতো অণুজীব থেকেই হয়ত একসময় পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি হয়েছে। এমনকি ভিনগ্রহে জীবনের অস্তীত্ব খুঁজতেও এই অণুজীবের অধ্যয়ন কাজে লাগতে পারে।
সমুদ্রের এত গভীর আর দুর্গম স্থানে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির বিস্ময় যেমন আছে, তেমনি আছে মানুষের অপব্যবহারের ছাপ। ২০১৯ সালে ভিক্টর ভেস্কোভো চ্যালেঞ্জার ডিপে ডুব দিয়ে সমুদ্রের তলদেশে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ খুঁজে পান। মানুষের তৈরী দূষণ পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর স্থানেও পৌঁছে গেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি প্রমাণ করে, সমুদ্র দূষণ কতটা গভীর এবং ব্যাপকভাবে আমাদের প্রকৃতিকে আক্রান্ত করছে।