মশাকে মারবে মশা
মশাকে মারবে মশা
মশা মারতে মশা
বর্তমান সময়ে এক আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েও ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশাকে দমন করা যাচ্ছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষতিকর মশা দমনের চিরাচরিত পদ্ধতির বাইরে নতুন এক ব্যবস্থা কাজে লাগানো হচ্ছে। এই পদ্ধতির নাম ওলবাকিয়া। এর মাধ্যমে পুরুষ ডেঙ্গু মশার শরীরে ওলবাকিয়া নামের ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করানো হয়। এই ওলবাকিয়া সম্পন্ন পুরুষ মশা ডেঙ্গু বাহিত স্ত্রী এডিস মশার সাথে মিলিত হলে, নতুন করে কোন মশা জন্ম নিতে পারে না। আর এভাবেই মশা দিয়ে মশাকে ধ্বংস করা যায়।
ওলবাকিয়া কী ?
ওলবাকিয়া হল এক ধরনের প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া। প্রায় ৫০ শতাংশ কীট পতঙ্গের শরীরে প্রাকৃতিকভাবেই এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। প্রজাপতির, ফড়িং এবং মাছির মত পতঙ্গের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে ওলবাকিয়া থাকে। কিছু কিছু মশার শরীরে ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া থাকলেও, ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস ইজিপ্টি মশার শরীরে এই ব্যাকটেরিয়া প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায় না। এডিস ইজিপ্টি মশা শুধু ডেঙ্গু রোগই নয়, এরা জিকা, চিকুনগুনিয়া এবং পীতজ্বরের জীবাণূও বহন করে।
এডিস ইজিপ্টি মশার ডিমে যদি ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করানো যায়, তাহলে সেই ডিম থেকে উৎপাদিত পুরুষ মশা ডেঙ্গু সহ অন্যান্য রোগের জীবাণূর সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে। The World Mosquito Program নামের একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংস্থা এবং সিঙ্গাপুরের National Environment Agency ওলবাকিয়া সম্পন্ন এডিস মশা উৎপাদনের কাজ করছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগারে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ ওলবাকিয়া মশা প্রকৃতিতে ছাড়া হচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যে শুধুমাত্র সিঙ্গাপুরের সরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই ২০ কোটি পুরুষ এডিস মশা প্রকৃতিতে উন্মুক্ত করা হয়েছে। এসব মশা উন্মুক্ত হবার পর নারী সঙ্গীদের খুঁজে বেড়ায়। এদের সাথে মিলিত হবার পর, ক্ষতিকর নারী ডেঙ্গু মশারা যে ডিম পারে, সেই ডিম ফুঁটে কখনই বাচ্চা হয় না। আর এভাবেই ক্ষতিকর ডেঙ্গু মশার বংশ বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়।
ওলবাকিয়া কিভাবে কাজ করে?
মশার বংশ পরম্পরায় ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় Cytoplasmic Incompatibility। এই প্রক্রিয়া মূলত তিনভাবে মশার বংশ বৃদ্ধির ধা রায় কাজ করে। কোন পুরুষ মশার শরীরে যদি ওলবাকিয়া থাকে এবং স্ত্রী মশার না থাকে, তাহলে স্ত্রী মশা যে ডিম পারবে তা থেকে বাচ্চা হবে না। কোন স্ত্রী মশার যদি ওলবাকিয়া থাকে, এবং পুরুষের যদি না থাকে, তাহলে স্ত্রী মশা যে ডিম পারবে তা থেকে স্বাভাবিক নিয়মে বাচ্চা হবে এবং সকল বাচ্চাও ওলবাকিয়া সম্পন্ন হবে। যখন স্ত্রী পুরুষ উভয়ের ওলবাকিয়া থাকবে, তখন তাদের স্বাভাবিক নিয়মে বাচ্চা হবে, এবং সকল বাচ্চারা ওলবাকিয়া সম্পন্ন হবে। আর ওলবাকিয়া সম্পন্ন মশা কোন রোগের জীবাণূ ছড়ায় না। এমনকি ওলবাকিয়া সম্পন্ন মশার শরীরে ডেঙ্গু রোগের জীবাণূ প্রবেশ করিয়ে দেখা গেছে যে, তাদের শরীরে ডেঙ্গুর জীবাণূ টিকতে পারে না। কয়েক প্রজন্ম মশার মধ্যে ওলবাকিয়া ছড়িয়ে দিতে পারলে, পরবর্তীতে প্রাকৃতিকভাবেই মশারা ওলবাকিয়া সম্পন্ন হয়ে উঠবে। ফলে প্রাকৃতিকভাবে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
The World Mosquito Program এর গবেষনায় দেখা গেছে, ওলবাকিয়া একটি টেকসই প্রযুক্তি। কোন কোন অঞ্চলে ওলবাকিয়া মশা ছাড়ার ৮ বছরের মধ্যে, সেই অঞ্চলে মশা বাহিত ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া বা পীত জ্বরের সংক্রমণ দেখা যায় নি।
ওলবাকিয়া পদ্ধতির মাধ্যমে মশার শরীরে কোন জ্বীনগত পরিবর্তন আসে না। গবেষণায় দেখা গেছে, ওলবাকিয়া পদ্ধতি প্রয়োগ, মানুষ, প্রাণী এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সবার জন্যই নিরাপদ। এমনকি এটি একটি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতির বিভিন্ন পোকামাকড়ের শরীরে ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া থাকার কারণে, প্রাকৃতিকভাবেই সেসব কীট পতঙ্গের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রিত হয়।
আমরা কী করতে পারি?
বাংলাদেশে মশা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিগত কয়েক বছরে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। ঢাকায় মশা নিধনের জন্য দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন শহরের জলাশয়গুলোতে ব্যাঙ ছেড়েছে; অন্যদিকে উত্তর সিটি কর্পোরেশন ড্রোনের মাধ্যমে ওষুধ ছিটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। গত একযুগে ঢাকার মশা নিধনের জন্য দুই সিটি কর্পোরেশন খরচ করেছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তবে কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের মশা মারার পদ্ধতিই সঠিক নয়। ফলে পুরো টাকাই অপচয় হয়েছে।
কিন্তু ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত ওলবাকিয়া মশা ডেঙ্গু সহ মশা বাহিত রোগ দমনে সবচেয়ে বেশি কার্যকর পদক্ষেপ রাখতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া সহ বিশ্বের প্রায় ১৫ টি দেশে ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশি বেশি ওলবাকিয়া মশা ছাড়া হচ্ছে। বাংলাদেশে মশা দমনে যত টাকা খরচ করা হয়েছে, তার সামান্য অংশ খরচ করলেও, ওলবাকিয়া ব্যবস্থা আমাদের দেশে গ্রহণ করা সম্ভব হত।