মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের সুবিধা

maxresdefault (25)
কি কেন কিভাবে বাংলাদেশ

মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের সুবিধা

ঢাকার যানজটের ভোগান্তি কমাতে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প মেট্রোরেল ব্যবস্থা। ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে যাতায়াতের ব্যবস্থা সহজ হলে, এই শহরে বসবাসের ভোগান্তি অনেকটাই কমে আসবে। ঢাকার যন্ত্রণাদায়ক গণপরিবহন ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা পাল্টে দেয়ার জন্য, রাজধানীতে মেট্রোরেলের যে ছয়টি লাইন চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, তার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে উত্তরার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এমআরটি লাইন ৬, যা পরবর্তীতে কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত হবার কথা রয়েছে। প্রথম ধাপে উত্তরা থেকে কমলাপুর নয়, বরং এর অর্ধেকেরও কম দূরত্ব আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রো রেল সেবা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এই সামান্য পথ মেট্রোরেলের যাতায়াত করে, ঢাকার যানজট সমস্যা খুব বেশি সমাধান হয়নি। কিন্তু মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হবার কারণে, এই মহাপ্রকল্প নগরবাসিকে অনেকটা স্বস্তি দিবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

মেট্রোরেল মতিঝিল পর্যন্ত গেলে কী সুবিধা ?

মেট্রোরেল প্রকল্প

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লুইস বার্জার গ্রুপ ইনকরপোরেশন, ঢাকার যোগাযোগ কাঠামো উন্নয়নের জন্য ২০ বছর মেয়াদী একটি কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনা তৈরী করে দিয়েছিল। সেই পরিকল্পনায়ই প্রথমবারের মত ঢাকায় মেট্রোরেল গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়। সেসময় ঢাকার জন্য সম্ভাব্য তিনটি মেট্রো রুটও চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০১২ সালে ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বা মেট্রো রেল প্রকল্প অনুমোদন লাভ করে। ২০১৪ সালে জাপানের সহযোগীতা সংস্থা জাইকা, মেট্রোরেলের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং ধারনাগত নকশার প্রণয়ন করে। ২০১৬ সালের মধ্যে ঢাকা মেট্রো নেটওয়ার্কের বিস্তারিত নকশা তৈরী হয়। ঢাকা এবং ঢাকার আশেপাশের এলাকা থেকে যাতায়াত সহজ করতে মেট্রোরেলকে বেশ কয়েকটি অংশে ভাগ করা হয়েছিল। জাইকার পরামর্শ অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত অংশটি নির্বাচন করা হয়। এই অংশটির নাম এমআরটি লাইন ৬, যা প্রায় ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ। ২০১৬ সালের জুনে এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলে উদ্বোধনের পর রাজধানীবাসী প্রথমবারের মত মেট্রোরেলের সুবিধা ভোগ করে। আর ২০২৩ সালের নভেম্বরে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশটি চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে, ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল সেবা পূর্ণতা পেল।

ঢাকার যানজট

গত বছর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে মেট্রোরেল চালু হবার পর, যাত্রীরা মাত্র ১২ কিলোমিটার পথ মেট্রোরেলে ভ্রমণ করার সুযোগ পায়। আগারগাঁও থেকে দূরবর্তী গন্তব্যে যেতে হলে যাত্রীদের মেট্রোরেল থেকে নেমে আবারো সেই বাসে চড়তে হত। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পরিবহন সংস্থা, উত্তরা এবং আগারগাঁও থেকে বিআরটিসি বাস চালু করে। তবে মেট্রোরেলের আরামদায়ক ভ্রমণ শেষে বিআরটিসির পুরোনো বাস, যাত্রীদের জন্য আরেক ধরনের ভোগান্তি তৈরী করেছিল। ১২ কিলোমিটার পথ বৈদ্যুতিক ট্রেনের গতিতে ভ্রমণ করে, বাকি ৮ কিলোমিটার পথ কচ্ছপের গতিতে চলা বিআরটিসি ডাবল ডেকারে পাড়ি দেওয়াটা ছিল সত্যিই বিরক্তিকর। বর্তমানে এই রুটে সম্পূর্ণ মেট্রোরেল চালু হওয়ার ফলে, যাত্রীদের আর কোন ধরনের ভোগান্তি থাকবে না।

শুধু উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্তই নয়, এই সম্পূর্ণ রুটের মাঝখানের জায়গাগুলোতে, স্বল্প দূরত্বে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্যও নাগরিকদের বহু সময় অপচয় এবং সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হত। ঢাকা শহরে যানবাহনের গতি ৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা, যা মানুষের হাটার গতির সমান। বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণায় দখা যায়, ঢাকা মহানগরীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন প্রায় ৩২ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হয়। যার ফলে প্রতিদিন প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এবং ঢাকার যানজটে প্রতিদিন প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার জ্বালানী অযথাই পুড়ে অপচয় হয়। মেট্রোরেলের পূর্ণাঙ্গ একটি রুট চালু হওয়ার মাধ্যমে যানজটের মাধ্যমে অপচয় হওয়া বিপুল আর্থিক ক্ষতির অনেকটাই কমিয়ে আনা যাবে। সাধারণত সড়ক পথে উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। সভা সমাবেশ বা কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে এই পথ পাড়ি দিতে ৩ চার ঘন্টাও সময় লেগে যায়। কিন্তু মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩৮ মিনিট। যা রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসে এক অসাধারণ উন্নয়ন।

মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোর সুবিধা

মেট্রোরেলের চালু হওয়া এমআরটি লাইন ৬ এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২০.১ কিলোমিটার। এই অংশটি সবার আগে তৈরী করার প্রধান কারন ছিল, এই রুটটি শুরু হয়েছে উত্তরার মত একটি সম্পূর্ণ আবাসিক এলাকা থেকে; এবং শেষ হয়েছে মতিঝিলের মত সম্পূর্ণ বানিজ্যিক একটি এলাকায়। এছাড়াও এর একদিকে রয়েছে মিরপুরের মত জনবহুল আবাসিক এলাকা, অন্যদিকে রয়েছে ফার্মগেট, শাহবাগ, সচিবালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ অফিস পাড়া। যার ফলে রাজধানীর মানুষ আবাসিক এলাকাগুলো থেকে বানিজ্যিক এলাকাগুলোতে নিরবচ্ছিন্নভাবে যাতায়াত করতে পারবে। অফিসে যাতায়াতের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে, চাকরীজীবিরা এতদিন পর্যন্ত অফিসের আশেপাশে বাসা ভাড়া করত। কিন্তু বানিজ্যিক এলাকাগুলো বসবাসের  জন্য ঠিক অতটা উপযোগী ছিল না। কিন্তু বর্তমানে এমআরটি লাইন ৬ সম্পূর্ণ চালু হওয়ার কারণে, শহরের একপ্রান্তে বসবাস করে, অন্যপ্রান্তে অফিস করার সুবিধাও চাকরিজীবীরা উপভোগ করতে পারবেন। তাছাড়া উত্তরায় তিনটি মেট্রো স্টেশন থাকলেও, এসব স্টেশনের আশে পাশে এখনও পূর্ণাঙ্গ বসতি গড়ে উঠেনি। মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হবার ফলে, এই অঞ্চলের আবাসন ব্যবস্থায় গতি আসবে। ফলে মেট্রোরেল শুধু রাজধানীর জানজট সমস্যার সমাধানই নয়, বরং আবাসন সমস্যার সামাধানেও নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরী করবে।

মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানি ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের তথ্য মতে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রতিদিন মেট্রোতে গড়ে ৮৫ হাজার যাত্রী যাতায়াত করছেন। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পুরোদমে চালু হলে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। তারমানে শুধুমাত্র এই রুটেই প্রতিদিন ৬ লাখের বেশি যাত্রী চলাচল করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশ চালু হওয়ার পর, মাত্র ১২ শতাংশ নাগরিক এই সুবিধার আওতায় আসবে। ঢাকা মেট্রোরেলের কমলাপুর পর্যন্ত এমআরটি লাইন ৬ এর কাজ শেষ করতে খরচ হবে মোট ৩৩ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে জনপ্রিয় এই লাইনের কাজ পূর্ণতা পাওয়ার শেস পর্যায়ে, এমআরটি লাইন ৫ এর কাজেরও উদ্বোধন করা হয়েছে। এই লাইন হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। এর মাঝের লাইনটি গাবতলী, মিরপুর ১০ এবং গুলশান অতিক্রম করবে। ৪১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকার এই প্রকল্প ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ হবে। এর আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এমআরটি লাইন-১ এর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করা হয়েছিল। সেই রুট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুরু হয়ে, একদিকে কমলাপুর এবং অন্যদিকে পূর্বাচল পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এমআরটি লাইন-১ ই হবে দেশের প্রথম পাতালরেল। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত অংশটি মাটির নিচ দিয়ে গড়ে তোলা হবে। এবং বসুন্ধরা থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত অংশটি হবে উড়ালপথে। পাতাল রেল সহ এই অংশটির নির্মান ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকা। তারমানে ঢাকা মেট্রোর প্রধান তিনটি লাইন নির্মান করতেই প্রায় এক লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এছাড়া গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত উড়াল এবং পাতাল রেলের সমন্বয়ে ১৭.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি রুট ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মিত হবে। একই সময়ের মধ্যে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পাতাল ও উড়াল রেল প্রকল্প পরিকল্পনাধীন রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে কমলাপুর থেকে নারায়নগঞ্জের মধ্যেও ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি মেট্রোরেল নির্মান করা হবে। প্রকল্পগুলোর নির্ধারিত সময় না বাড়লে, ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকাবাসী শহরের যে কোন প্রান্ত থেকে মেট্রোরেলের মাধ্যমে সহজে যাতায়াত করতে পারবে বলে, আশা করা হচ্ছে। 

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।