মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলে গেল কেন

মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলে গেল কেন ১
কি কেন কিভাবে

মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলে গেল কেন

সূচনা

বাংলা নববর্ষের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ও জনপ্রিয় আয়োজনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রতীকী রঙ, মুখোশ, বিশাল আকৃতির শিল্পকর্ম, আর ঢাক ঢোলের শব্দে মুখর হয়ে ওঠে নববর্ষ উৎযাপনের এই আয়োজন। এটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে “Intangible Cultural Heritage of Humanity” বা অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

অনেকেই বলে থাকেন পহেলা বৈশাখ উৎযাপন বাঙালীর হাজার বছরের সংস্কৃতি। কিন্ত সত্যিকার অর্থে বাংলা বর্ষপঞ্জিও হাজার বছরের পুরনো নয়। বর্তমানের প্রচলিত বাংলা বছর গণনা শুরু হয়েছিল ১৫৫৬ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে মাত্র ৪৬৯ বছর আগে। এবং মঙ্গল শোভা যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৯ সালে, অর্থাৎ মাত্র ৩৬ বছর আগে। মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা লগ্নে এর নাম ছিল আনন্দ েশাভাযাত্রা। সাম্প্রতিক সময়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটি পরিবর্তন করে আবারো সেই পুরনো নাম ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন

২০২৫ সালে আমরা ১৪৩২ বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানাচ্ছি। তারমানে এই নয় যে বাংলা বছর গণনা ১৪৩২ বছর আগে শুরু হয়েছিল। বাংলাবছর গণনা আসলে ১ থেকে শুরু হয়নি, শুরু হয়েছে ৯৬৩ থেকে। সে হিসেবে বাংলা বর্ষপঞ্জির বয়স মাত্র ৪৬৯ বছর। শুনতে খানিকটা অবাক করা হলেও, এর পেছনের ইতিহাসটা জানলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে খাজনা আদায় করা হত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সাথে তার কোন মিল ছিল না। ফলে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হত। খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন। তিনি মূলত এই অঞ্চলে প্রচলিত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সন গণনার বিষয়টি সমন্বয় করেন।

৯৯৩ হিজরীর ৮ই রবীউল আউয়াল বা ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ থেকে বাংলা সাল গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর ৯৬৩ হিজরী বা ১৫৫৬ সালের ৫ই নভেম্বর থেকে। সেসময় ৯৬৩ চন্দ্র সনকে ৯৬৩ বাংলা সৌর সনে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জির যাত্র শুরু হয়। তারমানে বর্তমানে প্রচলিত বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম বছরটিই ছিল ৯৬৩। কিন্তু যেদিন প্রথম এই বর্ষপঞ্জি কার্যকর করা হয়, সেদিনও এটি ছিল ৩০ বছরের পুরনো। কারণ বর্ষপঞ্জি গণনা শুরু হয়েছে ৯৯৩ -তে, কিন্তু এর উৎপত্তির বছর ধরা হয়েছে ৯৬৩ কে। কারণ ওই বছর সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন।

প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরবর্তীতে “বঙ্গাব্দ” বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। ফতেহউল্লাহ সিরাজির বাংলা সাল প্রবর্তনের ভিত্তি ছিল হিন্দু সৌর পঞ্জিকা। সে পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বার মাস অনেককাল আগে থেকেই প্রচলিত ছিল এবং সে পঞ্জিকার নাম ছিল শক বর্ষপঞ্চি বা শকাব্দ। শক বর্ষপঞ্চির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। ৯৬৩ হিজরি তে চন্দ্র সনের প্রথম মাস মহররম ছিল বাংলা বৈশাখ মাসে। তাই তখন থেকে বৈশাখকেই বাংলা বছরের প্রথম মাস হিসেবে গণনা করা শুরু হয়।

মঙ্গল শোভাযাত্রার উৎপত্তি

মঙ্গল শোভাযাত্রার উৎপত্তি একদিকে যেমন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফল, অন্যদিকে তা ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে একটি শান্তিপূর্ণ ও সৃজনশীল প্রতিবাদ। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ  এক অস্থির রাজনৈতিক সময় পার করছিল। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের তৎকালীন  সামরিক শাসনের গুমোট পরিবেশ, নাগরিক অধিকার হরণের শঙ্কা আর সামাজিক অনিশ্চয়তার মধ্যে মানুষ ছিল আতঙ্কিত ও বিভ্রান্ত। ঠিক সেই সময়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভাবলেন একটা এমন কিছু করতে হবে, যা মানুষকে আশার আলো দেখাবে এবং একই সাথে বাঙালির সংস্কৃতিকে উদযাপন করা যাবে।

ইতোপূর্বে ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল – পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। ১৯৮৯ সালে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই, ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। এরপর প্রতিবছরই চারুকলার শিক্ষার্থীরা একে আরও বেশি রঙ, শিল্প ও বার্তায় সমৃদ্ধ করতে থাকে। এক সময় এটি ঢাকায় নববর্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন শহরেও এ ধরনের শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে “Intangible Cultural Heritage of Humanity” বা মানব জাতির অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়, যা এই আয়োজনকে বিশ্বদরবারে পৌছে দেয়।

মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলে গেল কেন?

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলা নববর্ষের শোভাযাত্রার নতুন নামকরণ করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রার নতুন নাম রাখা হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলে যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে বেশ আলোড়ন তুলেছে। এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ, যুক্তি ও বিতর্ক।

চারুকলা অনুষদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই নাম পরিবর্তন কোনো নতুন নামকরণ নয়, বরং এটি পূর্বের ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামের পুনরুদ্ধার। ১৯৮৯ সালে প্রথম যে শোভাযাত্রা হয়েছিল, তার নামও ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে ‘অমঙ্গল’কে দূর করে ‘মঙ্গল’-এর আহ্বান জানিয়ে এই আয়োজনের নাম দেওয়া হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ‘মঙ্গল’ শব্দটি নিয়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিতর্ক তৈরি হওয়ায় আয়োজকেরা সেই পুরনো নামেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এই নাম পরিবর্তনের পেছনে আরেকটি বড় প্রভাবক ছিল ইসলামপন্থী কিছু সংগঠনের আপত্তি। ২০২৩ সালে ৯ এপ্রিল একজন বাংলাদেশী আইনজীবী মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনি নোটিশ দেন। তিনি মঙ্গল শব্দটি একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ এবং বৃহত আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার দাবি করেন।

প্রতি বছরই মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে ‘হিন্দুধর্মীয় সংস্কৃতির অনুসরণ’ এর অভিযোগ তোলা হয়ে থাকে, বিশেষ করে ‘মঙ্গল’ শব্দটিকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি আপত্তি রয়েছে। আয়োজকেরা বলছেন, তাঁরা চান সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করুক এবং কোনো ধরনের রাজনীতিকরণ বা ধর্মীয় অনুভূতির সংঘাত যেন না থাকে।

তবে নাম পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিস্তর বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে। অতীতে মঙ্গল েশাভাযাত্রা আয়োজকদের অনেকে এই পরিবর্তনকে ‘হাস্যকর’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাদের মতে, যেহেতু ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামেই জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সংস্থা (UNESCO) ২০১৬ সালে এই আয়োজনকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই এখন নাম পরিবর্তন করলে আন্তর্জাতিকভাবে এর গ্রহণযোগ্যতা, পরিচিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।

ইউনেস্কোর নীতিমালায়ও কোন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থমকে যাওয়ার যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে উৎসবের কার্যক্রম ও অর্থ পাল্টে যাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ইউনেস্কো তার স্বীকৃত ঐতিহ্যের যেকোনো পরিবর্তনকে স্পষ্টভাবে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচনা করে, কারণ এতে ঐতিহ্যের প্রাসঙ্গিকতা, সৃজনশীলতা ও স্থানিক গুরুত্ব হ্রাস পেতে পারে। যদিও এখনও পর্যন্ত ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, সমাজে বিভাজন না বাড়িয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নাম ব্যবহার করাই ভালো, যাতে সবাই স্বস্তিবোধ করতে পারে।

মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলে গেল কেন ?

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।