ব্ল্যাক ফ্রাইডে
ব্ল্যাক ফ্রাইডে
আধুনিক বিশ্বের ভোক্তা সংস্কৃতির সবচেয়ে আইকনিক ইভেন্ট ব্ল্যাক ফ্রাইডে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের খুচরা পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো, ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল নামে মহা ছাড়ে পণ্য বিক্রির উৎসব আয়োজন করে থাকে। ক্রেতারাও সস্তায় পণ্য পাওয়ার জন্য রীতিমত পাগলের মত কেনাকাটা করে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে মূলত ব্যবসায়ীদের একধরনের মার্কেটিং টুল, যার মাধ্যমে তারা ভোক্তাদের পকেট থেকে সহজেই টাকা খসাতে পারে।
আমেরিকায় পালিত হওয়া থ্যাংকসগিভিং এর ছুটিকে কেন্দ্র করে ব্ল্যাক ফ্রাইডের উৎপত্তি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ব্যবসায়িক এই উপলক্ষ্য আমেরিকার গন্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। অনলাইন কেনাকাটায় ব্ল্যাক ফ্রাইডে আবহ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সাইবার মানডে নামে আরেক ধরনের ব্যবসায়িক কৌশল আবিষ্কার করা হয়েছে।
থ্যাংকসগিভিং
ব্ল্যাক ফ্রাইডে ভালোভাবে বোঝার আগে থ্যাংকসগিভিং সম্পর্কে জানতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে থ্যাংকগিভিং পালিত হয়। কানাডায় অক্টোবরের দ্বিতীয় সোমবার এবং আমেরিকায় নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার থ্যাংকসগিভিং পালন করা হয়। বহু আগে থেকেই ফসল কাটার মৌসুমে নবান্ন উৎসব হিসেবে থ্যাংকসগিভিং উৎযাপন করা হত। এর উদ্দেশ্য ছিল বিগত বছরে যা আশির্বাদ লাভ করা হয়েছে এবং নতুন বছরের জন্য যে ফসল ঘরে উঠছে, তারা জন্য কৃতজ্ঞা জ্ঞাপন করা। এই উৎসবে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের ফলমূল এবং টার্কি মুরগী পরিবেশন করা হয়।
থ্যাংকসগিভিং যেহেতু বৃহস্পতিবারে হয়, এবং তারপরের শুক্র শনি এবং রবিবার মিলিয়ে একটা লম্বা ছুটির আমেজ তৈরী হয়। সেকারণে এই সময়ে, ক্রিসমাস বা বড় দিনের কেনাকাটার করার জন্য হাতে কিছুটা সময় পাওয়া যায়। সেকারণে মানুষ থ্যাংকস গিভিং এর পরের দিন ব্ল্যাক ফ্রাইডে থেকে বড় দিনের উপহার কেনা শুরু করে। বড়দিনে প্রিয়জনকে উহার দেওয়া আমেরিকান সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি। যা কোন ধর্মীয় আচার থেকে আসেনি; এটি সম্পূর্ণই ব্যবসায়িক মনোভাব থেকে আগত। সেকারণে নিজের জন্য হোক বা উপহার হিসেবে, ক্রেতাকে বড় দিনের উপলক্ষ্য দেখিয়ে বেশি বেশি পণ্য বিক্রি করাই ব্ল্যাক ফ্রাইডের মূল আয়োজন।
ব্ল্যাক ফ্রাইডের উৎপত্তি
ব্ল্যাক ফ্রাইডে শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ১৯৬০ সালে। এই শব্দের সাথে বেচাকেনা বা মূল্যছাড়ের কোন সম্পর্ক নেই। ১৯৬০ সালের থ্যাংকগিভিং এর পরের দিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়া শহরে ভয়ঙ্কর ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয়। ছুটির দিনে বহু লোকজন একসাথে কেনাকাটা করতে বের হওয়ার কারণে, এই ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয়েছিল। মার্কেটের ভিড়, রাস্তায় বিপুল জনসামাগম আর দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামের মত পরিস্থিতির ব্যাপকতা বোঝাতে, ফিলাডেলফিয়া পুলিশ সেই দিনটিকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে হিসেবে সম্বোধন করে। কিন্তু শহরের দোকানদাররা ওই দিনটিতে ব্যাপক মুনাফা করেছিল। ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলা দোকানগুলোও, ব্ল্যাক ফ্রাইডের কল্যাণে ব্যাপক বেচাকেনা করে ঘুরে দাড়িয়েছিল। পরের বছর থেকে দোকানদাররা ব্ল্যাক ফ্রাইডে কে তাদের মুনাফা অর্জনের উপলক্ষ্য হিসেবে দেখতে থাকে। সেকারণে তারা বিভিন্ন পণ্যে মহা ছাড় ঘোষনা করে ব্ল্যাক ফ্রাইডের ব্যাপক প্রচারণা চালাতে থাকে।
ব্ল্যাক ফ্রাইডে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার ইতিহাসে এক অনন্য পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই দিনটিতে ব্যবসায়ীরা তাদের সারা বছরের লোকসান পুষিয়ে নেয়, এবং ক্রেতারা তাদের কাঙ্খিত পণ্যটি অনেক কমদামে কিনতে পারে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে একসময় গ্রাহকদের কাছে এতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, বিভিন্ন পণ্য কেনার জন্য ভোক্তারা সারা বছর ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল বা মূল্য ছাড়ের অপেক্ষা করত। অনেকে ছাড়ের পণ্য কেনার জন্য ব্ল্যাক ফ্রাইডের আগের রাত থেকেই বিভিন্ন দোকানের সামনে তাবু টাঙিয়ে রাত্রি যাপন করে। যাতে ভোর বেলা দোকানের সামনে সহজেই লাইনে দাড়ানো যায়। সকাল বেলা দোকান খোলার সময় অসংখ্য ক্রেতা হুড়োহুড়ি করে দোকানে ঢুকে পড়ে। সেকারণে ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে দেওয়া মূল্য ছাড় ডোর বাস্টার ডিল হিসেব পরিচিত। তারমানে দরজা ভেঙে দোকানে ঢুকে পণ্য কেনার মত অফার।
সাইবার মানডে
ব্ল্যাক ফ্রাইডে মূলত ব্যবসায়ীদের ধূর্ত প্রচারণার মাধ্যমেই এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। থ্যাংকসগিভিং এর পরের শুক্র, শনি, রবিবার কেনাকাটার করার পরও ব্যবসায়ীদের কাছে অনেক পণ্য থেকে যেত। তাই সোমবারেও যেন ক্রেতারা তাদের অফিসের কম্পিউটারে বসে ব্ল্যাক ফ্রাইডে ডিসকাউন্টের পণ্য কিনতে পারে, সেজন্য এক নতুন অফার হাজির করা হয়, যার নাম সাইবার মানডে। ২০০৫ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশনের Shop.org ভোক্তাদেরকে অনলাইনে কেনাকাটা করানোর জন্য সর্বপ্রথম সাইবার মানডে শব্দটি ব্যবহার করে। সেই থেকে অনলাইন শপিংয়ে ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল বা ডিসকাউন্ট সাইবার মানডে হিসেবে পরিচিত।
তবে বর্তমানে ব্ল্যাক ফ্রাইডে উন্মাদনা সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। অতীতে ব্ল্যাক ফ্রাইডে শুধু এক থেকে তিন দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, এখন এর আর কোন সীমারেখা নেই। এখনকার সময়ে ব্ল্যাক ফ্রাইডে শুরু হওয়ারও বহু আগে থেকে মেগা সেল, হিউজ ডিসকাউন্ট এর নামে মূল্য ছাড়ের উৎসব শুরু হয়ে যায়। এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরো নভেম্বর মাস জুড়ে ব্ল্যাক ফ্রাইডে চলতে থাকে। অন্যদিকে অনলাইনে ব্ল্যাক ফ্রাইডে ডিসকাউন্টের নামে সাইবার মানডে শুরু হলেও, সাইবার মানডেরও কোন সীমারেখা নেই। কোন কোন ওয়েব সাইট সাইবার উইক, সাইবার মান্থ এর মত সপ্তাহ বা মাসব্যাপী নানা রকমের অফার দিতে থাকে।
সাইবার মানডে যেহেতু অনলাইনের বিষয়, তাই ধীরে ধীরে এই সংস্কৃতি আমেরিকার বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বেই কোন না কোনভাবে ব্ল্যাক ফ্রাইডে বা সাইবার মানডে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয়।
যেসব দেশে থ্যাংকসগিভিং, ব্ল্যাক ফ্রাইডে বা সাইবার মানডে উৎযাপনের মত সংস্কৃতি এখনও তৈরী হয়নি; সেখানে নভেম্বর মাসের ১১ তারিখকে বিনা কারণে বিশেষ উপলক্ষ্য বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এমনভাবে দেখানো হচ্ছে যে এই ইলেভেন ইলেভেন বা ১১/১১ ডিসকাউন্টে পণ্য কেনা যেন বিশেষ কিছু। ব্ল্যাক ফ্রাইডের মত এই অফারও শুধু নির্দিষ্ট একটি দিনের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। অফারের নাম ১১/১১ হলেও, পুরো নভেম্বর মাস জুড়ে ভোক্তারা ডিসকাউন্টে পণ্য কিনতে পারে।
আসল উদ্দেশ্য
ব্ল্যাক ফ্রাইডের মত ডিসকাউন্ট অফারের আসল উদ্দেশ্য হল ক্রেতার পকেট থেকে যতবেশি টাকা বের করে নেওয়া যায়, তার সকল ব্যবস্থা করা।
ব্ল্যাক ফ্রাইডে সমাজের ভোগবাদী মনোভাবকে অস্বাভাবিকভাবে উস্কে দেয়। ব্যবসায়ীরা সারা বছর একটি পন্য নায্য দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম বিক্রি করে। এরপর বছর শেষে যখন ব্ল্যাক ফ্রাইডে আসে, তখন দেখায় যে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য ছাড়ে তারা পণ্যটি বিক্রি করছে। এতে করে একদিকে ব্যবসায়ীদের মূলধনও উঠে আসছে, আবার তাদের পড়ে স্টকও ক্লিয়ার হচ্ছে। অন্যদিকে সাধারণ ক্রেতারা একে বিরাট লাভের উপলক্ষ্য ভেবে, পণ্যটি কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সস্তায় পণ্য পাওয়া যাবে বলে, মানুষ এমনসব জিনিস কেনে, যা তার আদৌ দরকারই ছিল না। এক সময়ে দেখা যায়, মূল্য ছাড়ের প্রলোভনে কেনা অনেক পণ্য, গ্রাহক ব্যবহার না করেই ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে।
ডিসকাউন্ট যেমনই হোক না কেন, ব্যবসায়ীরা কিন্তু তাদের লোকসানে পণ্য বিক্রি করে না। সেকারণে ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে সকল পণ্যের উপর ডিসকাউন্ট দেওয়া হয় না। সাধারণত যেসব পণ্য থেকে ব্যবসায়ীদের পর্যাপ্ত মুনাফা উঠে গেছে, যেসব পণ্যে আগে থেকে অধিক দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল বা যেসব পণ্য খুব একটা বিক্রি হচ্ছে না এরকম পণ্যই সাধারণত ব্ল্যাক ফ্রাইডে ডিসকাউন্টে পাওয়া যায়। তাই ব্ল্যাক ফ্রাইডে ব্যবসায়ীদের জন্য একটি মূল্যবান মার্কেটিং টুল হিসেবে কাজ করে।
নেতিবাচক দিক
ব্ল্যাক ফ্রাইডে সস্তায় পণ্য কেনার জন্য জনপ্রিয় হলেও, এর ব্যাপক সমালোচনাও রয়েছে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে সমাজের মানুষের কেনাকাটার অভ্যাসকে বিকৃত করে দিয়েছে। ব্ল্যাক ফ্রাইডের মত অসুস্থ ব্যবসায়িক এবং কেনাকাটার মানসিকতার জন্য, সমাজের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বেশি পণ্য উৎপাদন করা হয়। অধিক পণ্য উৎপাদনের জন্য পৃথিবীর বহুমূল্যবান উপাদান খরচ হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে যার বড় একটি অংশ সরাসরি অপচয় হয়। এবং পণ্য উৎপাদনের জন্য কলকারখানা গুলো প্রাকৃতিক পরিবেশ অধিক দূষিত করে ফেলে।
দূষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ক্ষতি ছাড়াও, উন্নত দেশগুলো তথাকথিক অনুন্নত দেশগুলো থেকে সস্তা শ্রমের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করিয়ে নায্য মজুরি দিচ্ছে না। উন্নত দেশগুলোতে, ক্রেতাদের অধিক দামে পণ্য কোনার সামর্থ থাকা সত্ত্বেও, বড় বড় কম্পানিগুলো নিজদের ব্যবসা বাড়ানোর স্বার্থে কম দামে পণ্য বিক্রির অসুস্থ প্রতিযোগীতা করছে। যার ফলে, বাংলাদেশের গ্রার্মেন্টস শ্রমিকদের মত মানুষগুলো অত্যন্ত নিম্ন মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
সবকিছু মিলিয়ে যে ভোগবাদ পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে; ব্ল্যাক ফ্রাইডের মত ব্যবসায়িক উপলক্ষ্য গুলো সেই অপ সংস্কৃতিকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে।