ব্রিকস কী

maxresdefault (63)
কি কেন কিভাবে

ব্রিকস কী

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর একটি BRICS। ব্রাজিল রাশিয়া ভারত চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিকস নামের এই শক্তিশালী আন্তঃসরকারী সংস্থাটি গড়ে তুলেছে। সমগ্র ভূপৃষ্ঠের ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ অঞ্চল ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ব্রিকস অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতেই সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যার বিশ্বের প্রায় অর্ধেক লোক বাস করে।

ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি সমগ্র বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ। ব্রিকস এর সদস্যরা একে অপরের সাথে আরো বেশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এর ফলে দেশগুলোর অর্থনীতি আরো অনেক বেশি প্রসারিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে ব্রিকসর্ভুক্ত দেশগুলো ইউএস ডলার কে পাশ কাটিয়ে স্বর্ণমানের উপর ভিত্তি করে, এক ধরণের নতুন রিজার্ভ কারেন্সি তৈরি করারও পরিকল্পনা নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেরও ব্রিকসে যোগ দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

BRICS এর কাজ কী ?

উৎপত্তি ও গঠন

ব্রিকস মূলত বিশ্বের উদীয়মান অথর্নৈতিক শক্তিগুলোর একটি সংগঠন। যারা বিশ্ব রাজনীতির পরিমন্ডলে ক্রমশই তাদের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। জিম ওনিল নামের একজন অর্থনীতিবিদ সবর্প্রথম ব্রিকসের ধারণাটি নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি ২০০১ সালে একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন যে, ব্রাজিল, রাশিয়া, চায়না এবং ভারত আগামী দশকে বিশ্ব অথর্নীতির গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়ারে পরিণত হবে। ২০০৯ সালে রাশিয়ায় দেশ গুলো সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিক সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্রিকসের দেশগুলো শুধু অথনৈতিকভাবই নয়, জনশক্তি এবং প্রযুক্তি গত দিক থেকেও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ থেকে অনেক এগিয়ে আছে। সেই সাথে বিশ্বের পারমানবিক শক্তিধর ৯টি দেশের ৩টিই ব্রিকস এর সদস্য। সেকারণে তারা একত্রে বিশ্ব রাজনীতি এবং সামরিক দিক থেকেও এক ধরনের মহাজোটে পরিণত হয়েছে।

ব্রিকসের উদ্দেশ্য

ব্রিকসের মূল উদ্দেশ্য হল এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সহযোগীতা বৃদ্ধি করা। এর অন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য হল বহুমুখী বিশ্বব্যবস্খা গড়ে তোলা। যেখানে কোন একক দেশ বিশ্ব মোড়ল সেজে বসবে না। অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্রিকস এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ বানিজ্যিক সম্পর্ক এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে চায়। সেই সাথে টেকসই উন্নয়ন এবং অথর্নৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্রিকস দেশগুলো বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল New Development Bank প্রতিষ্ঠা করা। একে অনেকে ব্রিকস ব্যাংকও বলে। এই ব্যাংকের কাজ হল ব্রিকসভুক্ত এবং ব্রিকসের বাইরে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অবকাঠামো নির্মানের ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করা।

ব্রিকসের চ্যালেঞ্জ

ব্রিকস সদস্য দেশগুলো অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করলেও, তাদের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাশিয়া, চীন, ভারত, ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক কাঠামোতে ব্যাপক বৈচিত্র এবং বৈপরিত্য রয়েছে। এছাড়া দেশগুলোর অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটও বেশ আলাদা। ভারত এবং চীনের মধ্যে একাধিক অঞ্চলের সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ রয়েছে। তাছাড়া চীনের অর্থনীতি অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে অনেক বড়। চীনের এই অবস্থান ভবিষ্যতে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে বলে, বিশ্লেকদের ধারণা।

অন্যদিকে রাশিয়ার অর্থনীতি বিগত এক দশক ধরে অনেকটা স্থবির অবস্থায় রয়েছে। ব্রাজিলের অর্থনীতিও বিগত দশ বছরে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থাও অনেকটা একই রকম। এই জোটের সবচেয়ে বড় শক্তি চায়নার অথনীতিও যতই বড় হচ্ছে, তাদের ঝামেলাও তত বাড়ছে। ব্রিকভুক্ত দেশের মধ্যে ভারতই সবচেয়ে দরিদ্র দেশ, কিন্তু ব্রিক সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে উজ্জ্বল অর্থনৈতিক সম্বাবনাও ভারতেরই সবচেয়ে েবশি। কারণ দেশটির বিপুল জনশক্তির উল্লেখযোগ্য একটি অংশ দক্ষ এবং শিক্ষিত বলে মনে করা হয়।

ব্রিকস সদস্যরা নিজস্ব সবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে তাদের দেশগুলোকে যুক্ত করতে চাইছে। কারণ অধিকাংশ ক্যাবল কোন না কোন ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডের সার্ভারের সাথে যুক্ত। মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা এসব ক্যাবলে নিয়মিত নজরদারি করে, যার ফলে তাদের গোপন তথ্য বেহাত হবার সম্ভবনা থেকে যায়। রাশিয়া, চায়না এবং ভারতের জন্য এই বিষয়টি বাস্তবায়ন করা খুব বেশি কঠিন নয়। কারণ তারা ভৌগলিকভাবে খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। দক্ষিণ আফ্রিকাও খুব বেশি দূরে নয়, তবে বিশাল এক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ব্রাজিলকে একই ক্যাবলের সাথে যুক্ত করা বিশাল এক চ্যালেঞ্জ।

বৈশ্বিক প্রভাব এবং গুরুত্ব

বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, বিশ্বকে বদলে দেয়ার মত ব্রিকসের নানা কার্যকারিতা রয়েছে। চীনকে এখনও সমগ্র বিশ্বের কারখানা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাশিয়া এবং ব্রাজিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সম্পদে সম্বৃদ্ধ দেশগুলো মধ্যে অন্যতম। সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম জনশক্তি রয়েছে ভারতে। তাছাড়া বিশ্বের প্রায় ৪১.৫% লোক ব্রিকস দেশ গুলোতে বাস করে। সেকারণে বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়নে এই জোটের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জাতি সংঘ এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ব্রিকসের দেশগুলো বহু আগে থেকই উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়ার আওভান জানিয়ে আসছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ব্রিকসের New Development Bank পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত World Bank এবং IMF এর আধিপত্য কমাতে কাজ করে যাচ্ছে।

ব্রিকস আরো নতুন নতুন সদস্য সংগ্রহের বিষয়েও আগ্রহী। সৌদি আরব, ইরান, আরব আমিরাত, মিশর, বাহরাইন, আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়া এবং বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্য পদের জন্য আবেদন করেছে। আরো বেশ কিছু দেশ অনানুষ্ঠানিকভাবে এই জোটে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে। এত এত দেশ কেন ব্রিকসে যোগ দিতে চায়? বিশেষজ্ঞদের অনেকই মনে করছেন, দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের অর্থনৈতিক খবরদারি এবং অনাকাঙ্খিত নিষেধাজ্ঞা থেকে বাঁচতে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। সেকারণই তারা নতুন এক বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার অংশ হতে চাইছে।

রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে, তাদেরকে নানামুখী নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হয়েছে। অন্যদিকে চীনের সাথে আমেরিকার বেশ কিছু বিষয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে; বিশেষ করে তাইওয়ান ইস্যুতে আমেরিকা এবং চীন সামরিক দিক থেকে অনেকটা মুখোমুখি অবস্থান করছে। আমেরিকার সাথে মতের অমিল হলেই যেন, নিষেধাজ্ঞার কবলে পরতে না হয়, সেজন্য বিকল্প এক বিশ্ব ব্যবস্থা অতি জরুরী মনে করছে ব্রিকসের সদস্যরা। আমেরিকার অর্থনৈতিক শক্তিকে পুঁজি করে, তারা সারা বিশ্বে তাদের সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। ব্রিকস যদি তাদের পরিকল্পনামত আর্থিক সাফল্য অজর্ন করতে পারে, তাহলে মার্কিন সামরিক প্রভাবও অনেকটা দুবর্ল হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

পশ্চিমা কেন্দ্রিক বিশ্ব অর্থব্যবস্থা যদি এশিয়ার দিকে সরে আসে তাহলে ব্রিকসের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। আগামী কয়েক দশকের মধ্যই ব্রিকসের সদস্য দেশগুলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। এর সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে হলে, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ মিটিয়ে ফেলতে হবে।

ব্রিকসের আনুষ্ঠানিক সূচনাই হয়েছিল ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অথনৈতিক মন্দা পরবর্তী সময়ে। তাদের প্রথম সম্মেলনের মাত্র এক মাসের মাথায় তারা নতুন এক বৈশ্বিক রিজার্ভ কারেন্সি নিয়ে আলোচনা করে। যা হবে ডলারের চেয়ে অনেক বেশি স্থিতিশীল এবং যার মূল্যমান হবে স্বচ্ছ। মার্কিন ডলার কে যে কারণে রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল, ডলার সেই মূল বিষয়টি থেকেই সরে গেছে। অতীতে ইসএস ডলার স্বর্ণমানের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হলেও, বতর্মানে স্বর্ণের সাথে ডলারের কোন সম্পর্ক নেই। বিকল্প রিজার্ভ কারেন্সি নিয়ে ব্রিক জোটে আরো বহু বছর আগে থেকেই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এখনও পযর্ন্ত এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে স্বর্ণমান সম্পন্ন নতুন রিজার্ভ কারেন্সি প্রতিষ্ঠার জন্য চীন এবং রাশিয়া গোপনে গোপনে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ করতে শুরু করেছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।