বেলুচিস্তান কেন স্বাধীন হতে চায়

maxresdefault (74)
কি কেন কিভাবে

বেলুচিস্তান কেন স্বাধীন হতে চায়

ভূমিকা

দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অঞ্চল বেলুচিস্তান। বেলুচিস্তান মূলত বেলুচ জাতিগোষ্ঠীর বাসস্থান। পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মধ্যে বেলুচিস্তানই সবচেয়ে বড়। পাকিস্তানের মোট ভূখণ্ডের প্রায় ৪৪% জুড়েই রয়েছে বেলুচিস্তানের অবস্থান। বেলুচিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর ও রাজধানীর নাম কোয়েটা। বেলুচিস্তানের একদিকে রয়েছে ইরান এবং অন্যদিকে রয়েছে আফগানিস্তান।

বেলুচিস্তান বহু প্রাকৃতিক সম্পদ এবং খনিজ পদার্থে ভরপুর। বেলুচিস্তানের একটি দীর্ঘ সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে। বেলুচ জনগণের একটি বড় অংশ মনে করে যে তারা পাকিস্তানের অধীনে নিপীড়িত এবং তাদের অঞ্চল শোষণের শিকার।

বেলুচিস্তান কেন পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হতে চায় ?

ব্রিটিশ আমলে বালুচিস্তান

বহু প্রাচীনকাল থেকেই বেলুচিস্তানের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় রয়েছে। জরথুষ্ট্রীয় ধর্মের ধর্মগ্রন্থ অবেস্তায়, গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডটাস এবং গ্রিক ভূগোলবিদ স্ত্রাবোর লেখাতে বেলুচিস্তানের উল্লেখ রয়েছে। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বে মহাবীর আলেকজান্ডার এই অঞ্চল বিজয় করেছিলেন। তারপরও বহু সাম্রাজ্যের হাত বদলের পর ১৭ শতকে অল্প কিছু সময়ের জন্য বেলুচিস্তান মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ হয়। পরবর্তীতে এটি পারস্য সাম্রাজ্যের অধেীনে চলে যায়।

ব্রিটিশ শাসনের অধীনে বেলুচিস্তান একটি বিশেষ রাজনৈতিক ও কৌশলগত অঞ্চল ছিল। ব্রিটিশরা বেলুচিস্তানকে সরাসরি ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসেবে দখল করেনি, বরং এটিকে একটি আধা-স্বাধীন রাজ্য হিসেবে শাসন করত এবং স্থানীয় শাসকদের মাধ্যমে অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করত।

১৮৩৯ সালে ব্রিটিশরা প্রথম বেলুচিস্তানে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে ১৮৭৬ সালে খান অব কালাত নামক বেলুচিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজ্যকে ব্রিটিশরা তাদের অধীনস্থ করে নেয়। তবে তারা সরাসরি শাসন করার পরিবর্তে, খান হিসেবে পরিচিত স্থানীয় শাসক ও বিভিন্ন গোত্রের সর্দারদের মাধ্যমে অঞ্চলটি পরিচালনা করত। এ ব্যবস্থাকে সর্দারি সিস্টেম বলা হতো।

ব্রিটিশ আমলের একটি প্রচলিত প্রবাদ হল, – ‘পাঞ্জাবিদের শাসন করো, সিন্ধিদের ভয় দেখাও, পশতুদের টাকা দিয়ে কিনে নাও, আর বালুচদের সম্মান করো।’

বালুচদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিজের ভূমি, নিজের গোত্র আর নিজের সরদার।  সেকারণেই ব্রিটিশরা সরাসরি বেলুচিস্তানে হস্তক্ষেপ না করে, বেলুচ গোত্রপতিদের সম্মান দেখিয়ে পরোক্ষভাবে এই পুরো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ১৮৮৭ সালে ব্রিটিশরা বেলুচিস্তান এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করে, ব্রিটিশ ভাইসরয়ের অধীনে বেলুচিস্তান পরিচালনা করতে থােক।

বালুচ জনগোষ্ঠী অত্যন্ত অকুতোভয় যোদ্ধা। লড়াই এদের রক্তে মিশে আছে এবং এই জাতীর মানুষ যুদ্ধ করতে ভালোবাসে। তারা যেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে না পারে, সেজন্য বিট্রিশরা কৌশলে বালুচদেরকেই নিজেদের পক্ষে যুদ্ধ করাতে থাকে। এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে শুধু বালুচিস্তানের সৈন্যদের নিয়ে গেড়ে তোলা হয় বিখ্যাত বালুচ রেজিমেন্ট।

ব্রিটিশরা নানা কৌশলে বেলুচিস্থান কে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেও, বিভিন্ন সময়ে বেলুচিস্তানে ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ ও অসন্তোষ দেখা দেয়।

পাকিস্তানের সাথে বালুচিস্তান

১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে বেলুচ জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান ঘটে। সেই চেতনা থেকেই  ১৯৪৭ সালে বেলুচরা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার বিরোধিতা করে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত বেলুচিস্তানের জাতীয়তাবাদী চেতনা অতটাও শক্তিশালী ছিল না যে, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারে।

সে সময় তৎকালীন বেলুচিস্তানে থাকা কালাত রাজ্যের প্রধান খান পাকিস্তানের সাথে স্ট্যন্ডস্টিল এগ্রিমেন্ট নামে একটি চুক্তিতে সই করেন। সেই চুক্তিতে বলা হয়েছিল – ‘পাকিস্তান সরকার স্বীকার করছে যে কালাত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, যার মর্যাদা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।’

কালাত বা বেলুচিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হলে সেটি কি পাকিস্তানের অংশ নাকি আলাদা সেই বিষয়টি পরিষ্কার ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান এসব বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে, বেলুচিস্তানকে নিজেদের সাথে যুক্ত করে নেয়। যার ফলে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে তৈরী হয় প্রথম বালুচ বিদ্রোহ।

ব্রিটিশরা জানত বালুচরা জাতি হিসেবে শক্তিশালী গর্বিত এবং স্বাধীনচেতা, সে কারণেই ব্রিটিশরা বালুচদের সম্মান করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের কাছে বেলুচিস্তান শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ, গ্যাস এবং খনিজ সম্পদের উৎস মাত্র। শুধু তাই নয়, বেলুচস্তানে স্বর্ণের খনিও আছে। পাকিস্তান সরকার বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের সকল ব্যাবস্থা করলেও, বালুচদের জন্য তেমন কিছুই করেনি। এমনকি বালুচরা তাদের রাজস্বের ভাগও ঠিকমতো পায় না। সেকারণে বেলুচিস্তান প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর হলেও, এটিই পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র প্রদেশ। পাকিস্তানের সমগ্র জিডিপির মাত্র ৩.৭ শতাংশ আসে বেলুচিস্তান থেকে।

বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা অভিযোগ করেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার বরাবরই তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বেলুচিস্তানের মানুষ খুবই দরিদ্র। পাকিস্তানে শিক্ষার হার শতকরা ৪৭ ভাগ হলেও, বেলুচিস্তানের মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। এবং বেলুচিস্তানের প্রায় ৩০ শতাংশ লোকই বেকার। পাকিস্তানের মজুদ গ্যাসের তিন ভাগের এক ভাগেই রয়েছে বেলুচিস্তানে; কিন্তু এই অঞ্চলের হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি শহরে বিদ্যুতের সরবরাহ আছে।

ব্রিটিশদের আমলে যাদেরকে সম্মান দেওয়া হয়েছে, তারাই দেখতে পায় পাকিস্তানে এসে তারা শুধু লুটের শিকার হচ্ছে। পাকিস্তানের শোষণ এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে বালুচরা আন্দোলন করলেই পাকিস্তান বলে, এর পিছে ভারত এবং আফগানিস্তানের মত বিদেশি শক্তির হাত রয়েছে।

বেলুচিস্তানের জনগণ নিজেদের স্বাধীনতা আদায়ের জন্য যতবারই আন্দোলন করেছে, পাকিস্তান তার সবগুলো ঘটনাকেই সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দিয়েছে, কঠোরভাবে দমন করেছে।

​বেলুচ লিবারেশন আর্মি

বেলুচ জনগণের স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করা সবচেয়ে সক্রিয় সংগঠন ​বেলুচ লিবারেশন আর্মি বা বিএলএ। বেলুচ জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ এই সংগঠনটি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত।

বিএলএ দাবি করে যে, পাকিস্তান সরকার দীর্ঘদিন ধরে বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ করছে এবং স্থানীয় জনগণকে বঞ্চিত করছে। তাই তারা বেলুচ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়।

বিএলএ পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারি স্থাপনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সশস্ত্র হামলা চালিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে তারা কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনে হামলা চালিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই ঘটনায় ৩৩ জন হামলাকারী নিহত হয় এবং ২৬ জন যাত্রী ও নিরাপত্তা কর্মী প্রাণ হারায়। এই হামলায়ও পাকিস্তান ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে বিদেশী শক্তির জড়িত থাকার অভিযোগ করেছে।

বেলুচ লিবারেশন আর্মির কর্মকাণ্ডের কারণে পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। তবে সংগঠনটি নিজেদেরকে স্বাধীনতাকামী দাবি করে বেলুচ জনগণের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

বেলুচিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা

বেলুচিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল ও সংঘাতপূর্ণ। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, নিরাপত্তা সংকট এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন দমনের জন্য পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘদিন ধরে বেলুচিস্তানে গুম, খুন এবং নিপীড়নের মত ঘটনা ঘটাচ্ছে। বেলুচ লিবারেশন আর্মি (BLA), বেলুচ রিপাবলিকান আর্মি (BRA), এবং বেলুচ লিবারেশন ফ্রন্ট (BLF) এর মত স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোকে কঠোরভাবে দমনের পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তান সরকার তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত সামরিক অভিযান, গোপন অপারেশন, এবং সন্দেহভাজনদের গুম করার মতো কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।

বেলুচ নেতারা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (ISI) এবং আধা-সামরিক বাহিনী (FC) নিয়মিতভাবে বেলুচ অ্যাক্টিভিস্ট, সাংবাদিক এবং মানবাধিকারকর্মীদেরও গুম করে। অনেককে পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, আবার অনেকে কখনোই ফিরে আসেন না।

সহজ করে বলতে গেলে, বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে যে ই কথা বলবে, তাকেই পাকিস্তান সরকার দেশের শত্রু িহসেবে গণ্য করে, এবং তাদেরকে গুম করা বা খুন করা একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নবাব আকবর বুগতির মত বেলুচিস্তানের বহু শীর্ষ নেতাকেও পাকিস্তান সরকার হত্যা করেছে।

বেলুচ এক্টিভিস্ট ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো দাবি করে যে, শুধুমাত্র ২০২৪ সালেই ৫০০-র বেশি মানুষ গুম হয়েছেন, যাদের অনেকেরই কোনো খোঁজ মেলেনি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ পাকিস্তান সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার প্রতিবাদ জানিয়েছে।

বেলুচিস্তানে পাকিস্তানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গদর বন্দর চালু করা এবং এই অঞ্চলে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হলে বেলুচিস্তানের লোকজন তাদের উন্নয়নের ব্যাপারে আশাবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু এসব উন্নয়নের ফলে বেলুচদের বদলে লাভবান হয়েছে পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং সিন্ধু অঞ্চলের জনগণ।

পাকিস্তান রাষ্ট্র বরাবরই নিজেদের ভুল নীতির কারণে যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেগুলোর জন্য কখনো নিজেদের দায় স্বীকার করেনা। পাকিস্তান কখনোই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে, পাকিস্তান বেলুচিস্তানের উপর কঠোর নজরদারি ও দমন পীড়ন শুরু করে। যাতে তারা কখনও বাংলাদেশের মত স্বাধীনতা অর্জনের ধারে কাছেও যেতে না পারে।

অন্যদিকে বেলুচিস্তানেরও স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে বাংলাদেশ এক অনুপ্রেরণার নাম। তাই বিভিন্ন সময় বেলুচ জনগণকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।