বাংলাদেশ ব্রিকস থেকে বাদ পড়ল কেন
বাংলাদেশ ব্রিকস থেকে বাদ পড়ল কেন
ব্রিকস সম্প্রসারণ
সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিকসের জোহানেসবার্গ সম্মেলনে নতুন ছয়টি দেশকে জোটে শরীক হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, মিসর, ইথিওপিয়া ও আর্জেন্টিনা ব্রিকসের নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দিবে। এর মধ্যদিয়ে ৫ সদস্যের ব্রিকস ১১ টি দেশের জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। নতুন সদস্যরা ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এই জোটে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করবে।
ব্রিকসে যোগদানকারী নতুন দেশগুলোর মধ্যে আরেকটি নাম হতে পারত বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আত্নবিশ্বাসী বক্তব্যে তেমনই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিকস বাংলাদেশকে তাদের দলে ভেড়ায় নি।
ব্রিকসের নতুন সদস্য
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ সম্মেলনে ব্রিকসের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল জোটের সম্প্রসারণ। কিন্তু কিভাবে নতুন সদস্য সংগ্রহ করা হবে, তার নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায়, নতুন সদস্যের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি অনেকটা অনিশ্চিত ছিল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো থেকে জানা যায়, সদস্য বাছাই করার নীতিমালা সম্পর্কে ব্রিকসের পাঁচ সদস্যদেশ একমত হতে পারছিল না। ভারতের এক প্রস্তাবের পর বিষয়টি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রস্তাব ছিল, এমন কোনো দেশকে সদস্য করা হবে না, যে দেশ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার হতে পারে। এবং সদস্য বাছাই করার জন্য মাথাপিছু জিডিপির একটি ন্যূনতম মানদণ্ড থাকতে হবে। তবে এই প্রস্তাব কতটা বিবেচনা করা হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। কারণ নতুন সদস্য হিসেবে ইরানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে বহু আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া ইথিওপিয়ার মতো দেশকেও এই জোটে সামিল করা হয়েছে, যার মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশে চেয়েও কম। তবে স্বাগতিক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা শুধু এটুকু বলেছেন, ব্রিকসের পাঁচটি সদস্যদেশ জোটের সম্প্রসারণের বিষয়ে একমত হতে পেরেছে। এবারের সম্মেলনের আগে ৪০টিরও বেশি দেশ ব্রিকসের সদস্য হবার জন্য আবেদন করেছিল। এসব দেশের মধ্যে সদস্য হওয়া দেশগুলো বাদে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশ।
জোটে নতুনদের প্রভাব
ব্রিকস বর্তমানে কয়েকটি শক্তিশালী একনায়কতন্ত্র এবং মধ্যম আয় ও উন্নয়নশীল গণতন্ত্রের জোট হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোটের নতুন সদস্যরাই একে আরও বেশি বৈচিত্রপূর্ণ করে তুলেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ব্রিকসের সম্প্রসারণ বিশ্বমঞ্চে কীভাবে এই জোটের প্রভাব আরও বাড়াতে পারে, তা এখনো স্পষ্ট নয় যে। এর জন্য তাদের এক হয়ে কার্যক্রম চালাতে হবে। তবে ব্রিকস জোটের সবগুলো দেশ একসাথে কাজ করাটাও খুব সহজ নয়।
নতুন সদস্য সংগ্রহের মধ্যে সবচেয়ে বড় চমক হল সৌদি আরব আর ইরান এক সঙ্গে ব্রিকসে যোগ দিচ্ছে। অথচ দেশ দুটি মাত্র কয়েকদিন আগেও একে অপরের ‘সবচেয়ে বড় শত্রু’ ছিল। চীনের মধ্যস্থতায় অতি সম্প্রতি সৌদি আরব ও ইরান তাদের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। চীন যে ভূমিকা পালন করেছে, সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রকে সেই ধরনের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। এদিক থেকে ব্রিকস বলয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমে আসার একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এছাড়া ভারত কিছুদিন আগে আরব আমিরাতের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছে। যার ফলে দেশ দুটি মার্কিন ডলারকে পাশ কাটিয়ে রুপি ও দিরহামে বাণিজ্য করবে। সব মিলিয়ে এই জোটের দেশগুলোর মধ্যে মার্কিনদের প্রভাব ব্যাপকহারে না কমলেও, কিছুটা যে কমতে শুরু করেছে তা নিশ্চিত।
নতুন সদস্য সংগ্রহের দুর্বল দিক হল, আর্জেন্টিনা ও ইথিওপিয়া কে ব্রিকসভুক্ত করা। কারণ দেশ দুটি সংকটে জর্জরিত। বর্তমানে আর্জেন্টিনার অর্থনীতি খুব খারাপ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, এবং ইথিওপিয়ার প্রধান সংকট গৃহযুদ্ধ।
সম্প্রসারিত ব্রিকসের দিক তাকালে দেখা যায়, এটি ‘খুব বেশি জ্বালানিকেন্দ্রিক’। সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং ইরান শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের শীর্ষ পেট্রোলিয়াম সম্বৃদ্ধ দেশ। সেকারণে নতুন সদস্যদেশের নাম ঘোষণার পর সম্মেলনস্থলেই অনেকে বলাবলি করছিল যে তারা একে এখন থেকে ‘ব্রিকস প্লাস ওপেক বলে ডাকবে কি না’।
ব্রিকসের সম্প্রসারণকে বিশ্ব মিডিয়া খুব আগ্রহী ছিল, এবং এই বিষয়টিকে গণমাধ্যমে খুব ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। তবে পশ্চিমা অনেক গণমাধ্যম অবশ্য এই জোটের প্রভাবকে এখনই খুব বেশি গুরুত্ব দিতে নারাজ। আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলো মনে করে, নতুন এই ব্রিকস জোটকে জি-৭ ও অন্যান্য উন্নত দেশের একেবারে পাত্তা না দেওয়ারও সুযোগ নেই। বিশেষ করে তেল উৎপাদনকারীরা নতুন সদস্যরা জোটে যোগ দেওয়ার ফলে, বিশ্ব অর্থনীতির একটি বড় অংশ সরাসরি ব্রিকস সদস্যদেশগুলোর নিয়ন্ত্রনে থাকবে।
বাংলাদেশের অপ্রাপ্তি
সরকারের পক্ষ থেকে জানানো বিগত কয়েক মাসের বার্তা থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ হয়ত আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্রিকসের সদস্য হতে যাচ্ছে। শেষমেষ ব্রিকসের সদস্যভুক্তির তালিকায় নাম না আসাটা সরকারের জন্য একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী করেছে।
ব্রিকসে ছয়টি নতুন দেশকে যুক্ত করা হলেও, তাতে বাংলাদেশের না থাকার কারণ হিসেবে কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। নেপাল, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশের বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানোর ঘাটতি ছিল। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন, ব্রিকসে সদস্য না হওয়ায় আশাহত হওয়ার কিছু নেই। পরবর্তী ধাপে বাংলাদেশ ব্রিকসে যুক্ত হতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হলেই যে খুব লাভ হত, ব্যাপারটা এমনও নয়। কারণ ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ মূলত বিভিন্ন ধরনের পণ্য এবং কাঁচামাল আমদানি করে। ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোই এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, চীন, রাশিয়া এবং ভারত একসাথে যে দেশের পক্ষ নিবে, শুধুমাত্র তারাই ব্রিকসের সদস্য হতে পারবে। এই তিনটি দেশের সাথে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য রয়েছে। বিশেষ করে ব্রিকস জোটের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ চীনের সাথে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ বানিজ্য সুবিধা ভোগ করছে। ব্রিকসে যোগ দিতে পারলে, চীনের কাছ থেকে পাওয়ার মত নতুন কোন বানিজ্যিক সুবিধা অবশিষ্ট নেই।
প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলাদেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে থেকেও ইথিওপিয়া কিভাবে ব্রিকসের সদস্য হল। ইথিওপিয়া মূলত আফ্রিকার কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়নের সদরদপ্তর ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় অবস্থিত। সুতরাং ইথিওপিয়াকে হাতে রাখেলে আফ্রিকার অন্যান্য অংেশ ব্রিকসের প্রভাব বিস্তার করার একটি সুযোগ থাকে।
অন্যদিকে পশ্চিমাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরানকে জোটে ভেড়ানোর কারণ হল, মাতদর্শিক সাদৃশ্য। ব্রিকস পশ্চিমাদের আধ্যিপত্য ভাঙার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, ইরান বহু আগে থেকেই সেই চেষ্টায় অনেকটাই সফল। এছাড়া ইরান একটি খনিজ তেল সম্বৃদ্ধ দেশ, তারা মধ্যপ্রাচ্যের একটি আঞ্চলিক শক্তি। সবমিলিয়ে ইরানের পেশিশক্তি পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ব্রিকসকে আরো শক্ত অবস্থানে দাঁড় করাবে। সেকারণে ভারতের কিছুটা আপত্তি থাকা সত্ত্বেও চীন এবং রাশিয়া ইরানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিশ্বরাজনীতির নতুন এই সমীকরণে বাংলাদেশও যে বড় টেবিলে জায়গা করে নিয়েছে, সেটিই আমাদের জন্য একটি প্রাপ্তি। এই মুহুর্তে ব্রিকসে যুক্ত হতে না পারাটা বাংলাদেশের জন্য ভালো বিষয়ও হতে পারে। বাংলাদেশ মূলত চীন ও ভারত থেকে কাঁচামাল আমদানি করে, তা দিয়ে তৈরী পোষাক ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করে। এই চক্র যদি বাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে আমাদের স্বার্থে আঘাত লাগবে। বাংলাদেশকে যদি এগিয়ে যেতে হয়, তাহলে সবগুলো প্রধান শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। এ জন্য ভারতে কাছ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু আছে। ভারত তাদের ভারসাম্যপূর্ণ কুটনীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ভালো সম্পর্ক রেখেছে, আবার রাশিয়ার কাছ থেকেও সুবিধা ভোগ করছে।