বাংলাদেশ কি দেউলিয়া হতে পারে

sddefault (1)
জীবনযাপন

বাংলাদেশ কি দেউলিয়া হতে পারে

অতীতের সম্বৃদ্ধ দেশ লেবানন সম্প্রতি নিজেদেরকে দেউলিয়া ঘোষনা করেছে। আমাদের আরেক প্রতিবেশি দেশ শ্রীলংকা নিজেদেরকে ঋণ খেলাপি ঘোষনা করেছে। তারাও কার্যত এক প্রকার দেউলিয়া। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকার অবস্থাও এক সময় বেশ ভালো ছিল। কিন্তু অতিরিক্ত বিদেশী ঋণের ভারে দেশটির অর্থনীতি আজ ভারাক্রান্ত। এসব অবস্থা দেখে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, বাংলাদেশেরও তো অনেক বিদেশী ঋণ আছে, তাহলে বাংলাদেশও কি দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে?

বাংলাদেশ কি দেউলিয়া হবে ?

দেউলিয়া বলতে কি বুঝায়?
প্রথমেই জানা যাক, দেউলিয়া বলতে আসলে কি বুঝায়? ‘দেউলিয়া’ শাব্দের সাধারণ অর্থ হল ‘দেনা পরিশোধ করতে অক্ষম’ বা, ‘নিঃস্ব’। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন পাওনাদার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়, তখন উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া হিসেবে গণ্য করা হয়। দেউলিয়া শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ইধহশৎঁঢ়ঃপু, ইতালীয় শব্দ ইধহপধ জড়ঃঃধ থেকে এসেছে, যার অর্থ “ইৎড়শবহ ইবহপয” বা ভাঙ্গা বেঞ্চ। প্রাচীনকালে ভেনিসের শহরতলীর বিভিন্ন স্থানে বিনিয়োগকারী, অর্থলগ্নিকারী ও অর্থ বিনিময়কারীরা বেঞ্চ পেতে বসতেন এবং মানুষকে সুদে টাকা ধার দিতেন অথবা তাদের বৈদেশিক মুদ্রা পরিবর্তন করে দিতেন। আধুনিক কালের ব্যাংক শব্দটিও সেই ইতালীয় বেঞ্চ থেকেই এসেছে। ভেনিসের কোন অর্থ বিনিময়কারী যদি তার দেনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হত তবে তার বেঞ্চটি ভেঙ্গে ফেলা হত। তাই দেউলিয়া বোঝাতে ইধহপধ জড়ঃঃধ বা ইধহশৎঁঢ়ঃ শব্দটি ব্যবহৃত হত। এভাবেই ‘দেউলিয়া’ হবার মত বিষয়টির উৎপত্তি ঘটে।

একটি দেশ কিভাবে দেউলিয়া হয়?
সাধারণত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কে আইনগতভাবে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়ে থাকে। এই দুই ধরনের সত্ত্বার দেউলিয়ত্বের জন্য বিভিন্ন দেশে আলাদা আলাদা আইন রয়েছে। বাংলাদেশেও দেউলিয়া বিষয়ক আইন রয়েছে। তবে দেউলিয়া শব্দটি কখনও কখনও দেশের জন্যও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু একটি দেশ কখন দেউলিয়া হয়ে যায়? করপোরেট ফাইনান্স ইনস্টিটিউটের মতে, ‘একটি রাষ্ট্র তখনই দেউলিয়া হয়ে যায়, যখন তার সরকার নির্ধাারিত সময়ে ঋণ ও অন্যান্য প্রদেয় বিল পরিশোধে ব্যর্থ হয়।’ সাধারণত কোনো দেশে সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা বিপ্লব সংঘটিত হলে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। বিদায়ী সরকারের আর্থিক কর্মকান্ডের বৈধ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বকেয়া ঋণ ও পাওনা পরিশোধ বাতিল করে, নতুন সরকার দেশকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারে। এছাড়া কোন দেশের কাছে সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও, অনেক সময় সেগুলোকে তরল অর্থে রূপান্তর করা যায় না। তখন তারল্য সংকটের কারণেও কোনো দেশ দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। এছাড়া সরকারের আর্থিক অসচ্ছলতা, ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকা, খেলাপি ঋণ এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্বেও কারণে কোন দেশ দেউলিয়া হতে পারে। কোনো রাষ্ট্র যদি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে; তবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মত রাষ্ট্রের সম্পত্তি নিলামে ওঠে না। কোনো কোম্পানি দেউলিয়া হলে তার স্থাবর, অস্থাবর সব সম্পত্তি জব্দ করতে পারে আদালত। তবে রাষ্ট্র দেউলিয়া হলে আদালতের সেই এখতিয়ার নেই। ইন্ডিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যাওয়া প্রকৃত অর্থে একটি ভুল কথা। যখন একটি দেশ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তখন দেশটি মোটেও দেউলিয়া হয়ে যায় না, তখন দেশটি হয় ঋণ খেলাপি। তবে বহু দেশই তাদের ইতিহাসে কোনো না কোনো সময় ঋণ খেলাপি হয়েছে এবং সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

কোন কোন দেশ দেউলিয়া হয়েছে?
সাম্প্রতিক সময়ে লেবানন কিংবা শ্রীলঙ্কাকে ঘিরে রাষ্ট্রের দেউলিয়াত্বের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। পৃথিবীতে সর্ব প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে দেউলিয়া হয়েছিল গ্রিস। ৩৭৭ সালে গ্রিসকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছিল। গত ২০০ বছরে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক দেশ, আফ্রিকার ৪০ শতাংশ দেশ এবং এশিয়ার প্রায় ৩০ ভাগ দেশ নানা সময়ে দেউলিয়া হয়েছে। এই তালিকায় কিন্তু শুধু দুর্বল অর্থনীতির দেশই নয়; যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, জার্মানি, জাপান, ব্রাজিল এবং চীনের মত দেশও অতীতে দেউলিয়া হয়েছে। মহামারি করোনার কারণে গত বছর ব্রাজিল নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। তবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার দেউলিয়া হয়েছে ইকুয়েডোর। দেশটি মোট ১০ বার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশ কি দেউলিয়া হবে?
এবার আসা যাক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। শ্রীলংকার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হবার সাথে সাথে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কারণ, শ্রীলংকার এই বেহাল দশার পেছনে রয়েছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের মতে, কোন দেশের ঋণের হার সেই দেশের জিডিপির ৫৫ শতাংশের বেশি হলেই অর্থনীতি দেউলিয়া হবার বিপদে পড়তে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঋণের হার এখন জিডিপির ৩৮ শতাংশ। বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কার বর্তমান ঋণের হার তাদের জিডিপির ১১৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশটি সবমিলিয়ে এক বছরে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে, তার তুলনায় শ্রীলংকার ঋণ অনেক বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৩ লাখ ধরে হিসাব করলে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২৯২ দশমিক ১১ ডলার। সেখানে শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ এক হাজার ৬৫০ ডলার। বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। সেখানে শ্রীলঙ্কা পণ্য রপ্তানি থেকে আয় করেছে মাত্র ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়লেও, বিভিন্ন পণ্যের আমদানিও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ৪৪ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। সেখানে শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ আছে মাত্র দুই বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ এর তথ্য বলছে, চলতি বছর শ্রীলঙ্কার সবমিলিয়ে ৫০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করার কথা। অথচ এখন তাদের হাতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আছে মাত্র ২৩১ কোটি ডলার। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, দৈনন্দিন কাজ চালাতেই দেশটির নতুন করে ঋণ করতে হচ্ছে। সুতরাং, শ্রীলংকার সাথে বাংলাদেশের তুলনা করে, অর্থনীতিবিদরা বলছেন আমাদের আপাতত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।

শ্রীলংকার ‘ভুল’ থেকে শিক্ষা নিতে হবে
বাংলাদেশের দেউলিয়া হবার সম্ভবনা না থাকলেও, সঙ্কট এড়িয়ে চলার ব্যাপারে অর্থনীতিবিদেরা সতর্ক করছেন। শ্রীলংকার সমস্যা একদিনে তৈরী হয়নি। অতীতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকার মাথাপিছু আয় ছিল সবার চেয়ে বেশি। তাই বাংলাদেশকেও সাবধান হতে হবে। বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। গত ১৫ বছরে দেশটি সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তাসহ মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি। বাংলাদেশের একটি বড় সম্যস্যা হল প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি করা। যেমন, পদ্মা সেতু প্রকল্প শুরু করা হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে, কিন্তু সেতু শেষ করতে খরচ হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে দেশে ১০টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এর একটির কাজও সময়মতো শেষ হয়নি। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বেশি ব্যয়ও বেড়েছে। এতে করে এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক মূল্য কমে যাচ্ছে। বড় বড় প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের ঋণের দায় আগের চেয়ে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য মতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হয়েছিল ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯১ কোটি ডলারে। আগামীতে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বড় প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে এই ঋণ পরিশোধের দায় অনেক বেড়ে যাবে। এছাড়া বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে গেলে, আগামীতে আর কম সুদে আর ঋণ পাওয়া যাবে না। তখন আরো বেশি সুদে ঋণ নিতে হবে। সেই সাথে বিশেষ বাণিজ্য সুবিধাও মিলবে না। ফলে এখন থেকেই ঋণের দায় নিয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে। শ্রীলংকার ভুল থেকে বাংলাদেশ কে শিক্ষা নিতে হবে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।