বাংলাদেশ ঋণে জর্জরিত
বাংলাদেশ ঋণে জর্জরিত
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে। উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েছে বৈদেশিক ঋণের বোঝা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ৩২২ শতাংশ বেড়েছে। অক্টোবর মাসে রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন বাংলাদেশ এখন উচ্চমাত্রার ঋণগ্রস্ত একটি দেশ। বাংলাদেশ যদি এখন থেকে নতুন করে আর কোনো বিদেশি ঋণ নাও নেয়, তারপরও বর্তমান ঋণের বোঝা শোধ করতে ২০৬২ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, তিনি তার ৩৬ বছরের চাকরী জীবনে এমন অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখেননি।
বৈদেশিক ঋণ কত
বাংলাদেশ সাধারণত বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং বন্ধুসুলভ দেশগুলোর বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে। তবে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেশের বেসরকারী বানিজ্যিক বাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও বাংলাদেশ সরকার ঋণ নিয়ে থাকে।
২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময়, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ২৩.৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋনের পরিমাণ দাড়িয়েছে ৯৯ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ গত ১৪ বছরে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩২২ শতাংশ।
গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ বাংলাদেশ কে ঋণ দেওয়ার সময় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আইএমএফ এর সেই হিসেবে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ২২৯ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৭ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকার বেশি।
আইএমএফ বাংলাদেশকে সর্বশেষ ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। যার প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার জানুয়ারি মাসে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বাকি ঋণ গুলোর মধ্যে, বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নিয়েছে ১ হাজার ৮১৬ কোটি ডলার, এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবির কাছ থেকে নিয়েছে ১ হাজার ৩২৮ কোটি ডলার, জাপানের কাছ থেকে নিয়েছে ৯২৩ কোটি ডলার, রাশিয়ার কাছ থেকে ৫০৯ কোটি ডলার এবং চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে ৮৭৬ কোটি ডলার।
বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে
বাংলাদেশ ব্যাংক এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১৬ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে দেশে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ প্রায় ৯৫ হাজার টাকা। সরকারের মোট ঋণের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৪৩.৫ শতাংশ। তারমানে বিদেশী ঋণের চেয়ে, দেশের ভেতর থেকেই সরকার বেশি ঋণ গ্রহণ করেছে।
এখনও পর্যন্ত বিদেশী ঋণের পরিমাণ দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের চেয়ে কম হলেও, বিদেশী ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। বিগত দশ বছর বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক ঋণ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১০ বছরে ভারতের বিদেশী ঋণ বেড়েছে প্রায় ৮৩ শতাংশ। একই সময়ের পাকিস্তানের ১০১ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ১১৯ শতাংশ বেড়েছে। এই দশ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ২১৩ শতাংশ। তারমানে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের ঋণের বোঝা অনেক বেশি বেড়েছে। এমনকি শ্রীলংকার চেয়েও প্রায় ১০০ গুণ বেশি ঋণ বেড়েছে বাংলাদেশের।
ঋণ পরিশোধের চাপ
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ যেমন বাড়ছে, সেই সাথে সেসব ঋণ পরিশোধের চাপও দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ যেহেতু নতুন করে আরো বহু উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে, তারমানে ঋণ পরিশোধের চাপ সামনের বছরগুলোতে আরো বাড়বে।
অর্থ মন্ত্রনালয়ের হিসেব বলছে, দশ বছর আগে, ২০১২-১৩ অর্থ বছরে বাংলাদেশকে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিলো। ১০ বছর পর ২০২১-২২ অর্থ বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২০১ কোটি ডলারে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে পরিশোধ করা হয়েছে ২৭৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরে ৭৩ কোটি ডলার বেশি ঋণ শোধ করতে হয়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় ৪৭ শতাংশ বেশি। তাছাড়া দশ বছরে ঋণ পরিশোধের চাপ দ্বিগুণ হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৩২৮ কোটি ডলার ঋণ শোধ করতে হবে। ছয় বছর পর ২০২৯-৩০ অর্থ বছরে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৫১৫ কোটি ডলারে। বাংলাদেশ যদি নতুন করে আর কোনো ঋণ না নেয়, তাহলেও বর্তমান ঋণের বোঝা শোধ করতে ২০৬২ সাল পর্যন্ত ঋণের সুদ এবং আসল পরিশোধ করতে হবে।
বিভিন্ন কারণেই বাংলাদেশে ঋণ সহায়তার পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশের ঋণ গ্রহণের প্রক্রিয়া একেবারে থেমে নেই। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার কোটি ডলারের ঋণ পাইপলাইনে আছে। তারমানে আরো এত বিপুল পরিমাণ ঋণ খুব শীঘ্রই দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হবে।
টাকা ছেপে ঋণ
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিদেশী ঋণের চাপের পাশাপাশি, অভ্যন্তরীণ ঋণের বোঝাও বেশ প্রকট হচ্ছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বেসরকারী বানিজ্যিক ব্যাংক ছাড়াও, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকেও আলাদা তহবিল গঠনের মাধ্যমে, উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ঋণ নিয়েছে। তবে দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ভুল পদক্ষেপ ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছেপে, সরকার কে ঋণ দিয়েছে। এরফলে দেশে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি তৈরী হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য, বাংলাদেশ ব্যাংক গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নেওয়া শুরু করে। অর্থনীতিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়ার বন্ধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার কোনো ঋণই নেয়নি। উল্টো আগের নেওয়া ঋণের ৩১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। তবে সরকার এই টাকা পরিশোধ করার জন্য বেসরকারী ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ৩১ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। তারমানে বেসরকারী ঋণ নিয়ে, সরকারী ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।
ঋণ লুটপাট
বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের চাপ বাড়ার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল স্বল্প মেয়াদী ঋণ। বাংলাদেশের বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য দীর্ঘ মেয়াদের তুলনায় স্বল্প মেয়াদী ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব স্বল্প মেয়াদী ঋণের সুদের হার বেশি, এবং এসব ঋণ খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিশোধ করার চাপ থাকে। রাশিয়া, জাপানসহ কয়েকটি দেশ থেকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এ ধরনের ঋণ নেয়া হয়েছে। এ ধরনের ঋণে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে, বিশ্ব ব্যাংক কিংবা আইএমএফের মত নজরদারি থাকে না। তাই এসব ঋনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি করার সুযোগ বেশি। বিশ্লেষকদের মতে, বিদেশী ঋণ ভিত্তিক প্রকল্পে অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে লুটপাট করা হয়।
রাশিয়ার কাছ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার ৪০০ মেগওয়াট। অথচ ভারতের তামিলনাড়ুতে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি প্রকল্প করা হয়েছে মাত্র ছয় বিলিয়ন ডলার দিয়ে। যেহেতু রুপপুরের প্রকল্প বাস্তবায়নের দ্বায়িত্বও দেওয়া হয়েছে রাশিয়া কে, তাই রাশিয়া এই প্রকল্পে বেশি বেশি খরচ দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে অতিরিক্ত ডলার হাতিয়ে নিয়েছে।
কতটা ঝুঁকিপূর্ণ
বাংলাদেশে ঋণ এবং জিডিপির অনুপাত ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ২০১৪ সালে দেশের সামগ্রিক ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ছিল ২৮.৭ শতাংশ, যা এখন ৪২.১ শতাংশ। এরমধ্যে দেশী এবং বিদেশী সকল ঋণই অন্তর্ভূক্ত।
একটি দেশের ঋণের মাত্রা বিপদসীমা অতিক্রম করেছে কিনা, তা বোঝার জন্য বৈদেশিক ঋণের সাথে জিডিপির তুলনা করা হয়। সাধারণত, বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ৪০ শতাংশের বেশি হলে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপি হবে প্রায় ৪৪৬ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২২ শতাংশ। সেকারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋনের বোঝা এখনও আপাতত নিরাপদ অবস্থায় রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বৈদেশিক ঋণের বোঝা আর বেশি না বাড়ানোর বিষয়ে সতর্কও করে দিয়েছেন। বিদেশী ঋণের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা কমানোর ওপর জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন দেশের অর্থনীতিবিদেরা।
দেশী বিদেশী ঋণ ছাড়াও, হুন্ডি এবং ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশে পাচার এবং বিপুল পরিমাণ খেলাপী ঋণের কারণে দেশের অর্থনীতি অনেকটাই নাজুক। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও, বাংলাদেশে হঠাৎ করেই কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে গেঠে। শুধুমাত্র গত তিন মাসেই প্রায় তিন হাজার নতুন কোটিপতি হয়েছে।