বাংলাদেশে ভারতের ট্রেন চলবে
বাংলাদেশে ভারতের ট্রেন চলবে
ভূমিকা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর, প্রথম দ্বিপাক্ষিক সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে। দুই সরকার প্রধানের বৈঠকে দশটি চুক্তি সই করা হয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের রেল ট্রানসিট সুবিধা আদায় এবং বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে ভারতের অন্তর্ভুক্তি। এগুলো সহ এবারের বৈঠকে মোট দশটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে; যার মধ্যে তিনটি পুরনো চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে এবং বাকি সাতটি সম্পূর্ণ নতুন চুক্তি।
রেল ট্রানজিট
অতীতে দেশ ভাগের আগে বর্তমান ভারত-বাংলাদেশের অঞ্চলগুলোর মধ্যে মোট আটটি সীমান্ত পথ দিয়ে রেল যোগাযোগ ছিল। তবে ১৯৬৫ সালের পর প্রায় সব পথই বন্ধ হয়ে যায়। যদিও ১৯৭১ সালের পর আবারও রেলপথে যুক্ত হতে শুরু করে প্রতিবেশী দুই দেশ। শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক বৈঠকের পর জানা যায়, আগামী মাস থেকেই ভারতের ট্রেন বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে পরীক্ষামূলকভাবে চলবে।
বর্তমানে পাঁচটি রুটে বাংলাদেশ-ভারত ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে তিনটি যাত্রীবাহী ইন্টারচেঞ্জ, বাকি দুটি পণ্যবাহী। বর্তমান পদ্ধতিতে ভারতীয় ট্রেন সীমান্তে আসার পর বাংলাদেশি ইঞ্জিনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসে। বাংলাদেশি চালক তা চালিয়ে আনেন। ফেরার সময়েও একই রকম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। কিন্তু পরীক্ষামূলক যাত্রার জন্য ভারতের সাম্প্রতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে দেশটির এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ট্রেন নিতে চায়।
ট্রানজিট চালুর পর ভারতের ট্রেন বাংলাদেশে চলার জন্য, গেদে-দর্শনা সীমান্ত থেকে হলদিবাড়ি-চিলাহাটি রুটকে সংযুক্ত করা হবে। এই ট্রানজিট চালু হলে নিজ দেশের মধ্যে রেলপথে দূরত্ব অনেকখানি কমবে ভারতের। ট্রানজিট চালু করতে নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হবে, নাকি যেটি আছে সেটিকে সংস্কার করা হবে সে ব্যাপারে পরিস্কার তথ্য জানা যায়নি।
এর বাইরেও বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা রুটে নতুন ট্রেন চালু করার বিষয়ে আরেকটি সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তা নিয়ে বহু আগে থেকেই সংকট চলছে। এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা চুক্তির দাবি জানানো হলেও এতদিনেও তার কোন অগ্রগতি হয়নি। এমন অবস্থায় তিস্তা নদী কেন্দ্রিক বন্যা প্রশমন, ভাঙন হ্রাস ও ভূমি উদ্ধারে একটি মহাপরিকল্পনা করে বাংলাদেশ। যেটি তিস্তা মহাপরিকল্পনা হিসেবে পরিচিত। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের উজানে একটি বহুমূখী ব্যারেজ নির্মাণেরও চিন্তা রয়েছে বাংলাদেশের।
শেখ হাসিনার ভারত সফরে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তিস্তা প্রকল্প। সাম্প্রতিক বৈঠকের পরে জানানো হয় তিস্তা প্রকল্পে ভারত যুক্ত হবে। তবে এটি কি বাংলাদেশের প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা; নাকি ভারতের সাথে নতুন কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে সে বিষয়েও পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি। তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য ভারতের পক্ষ থেকে একটি কারিগরি দল খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ সফর করবে।
২০১১ সালে তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। এরপর ১৪ বছরেও এই সংকটের সমাধান হয় নি। বরং এখনো এটি আলোচনার পর্যায়েই আটকে আছে। তবুও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই বৈঠককে ফলপ্রসূ বলে দাবি করেছেন। এই বৈঠকের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই মাসে দ্বিতীয়বারের মতো দিল্লি সফর করেছেন। এর আগে গত ৯ জুন তিনি মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা এক মাসে দুইবার ভারত সফরের বিষয়টিকে “দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ” হিসেবে উল্লেখ করেন।
ট্রান্সশিপমেন্ট
পণ্যবাহী একটি যানবহন থেকে পণ্য আরেকটি যানে স্থানান্তর করে পরবর্তী গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে ট্রান্সশিপমেন্ট বলা হয়। যেমন: ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশের বেনাপোল স্থলবন্দরে ঢুকে পণ্য খালাস করল। সেই পণ্য বাংলাদেশি ট্রাকে করে আবার ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তঘেষা আখাউড়া স্থলবন্দর গিয়ে নামিয়ে দেয়া হলো; যা আবার ভারতীয় ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি কে বলা হয় ট্রান্সশিপমেন্ট। বাংলাদেশের সাথে ভারতের ট্রান্স শিপমেন্ট চুক্তি ও কার্যকর রয়েছে।
বাংলাদেশ এখনও ভারতের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানির ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। এছাড়া বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে অবাধে গাড়ি চলাচলের জন্য ২০১৫ সালে বিবিআইএন চুক্তি সই করা হয়েছিল। বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তি ২০১৫ সালে সই হলেও এখনও কার্যকর হয়নি। সবশেষ ২০২২ সালের মার্চে নয়া দিল্লিতে এক বৈঠকে চুক্তি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু এখনও সেটি কার্যকর করা যায়নি।
নেপাল ও ভুটান ট্রানজিট
বাংলাদেশ ও দীর্ঘদিন থেকে ভারতের ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে নেপাল ও ভুটানের যাতায়াত করতে চায়। সড়কপথে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানি করতে বাংলাদেশের ভারতের সড়কপথ ব্যবহার করা দরকার। কিন্তু এখনও ট্রানজিটের সুযোগ না মেলায় বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাক সরাসরি নেপাল বা ভুটানে যেতে পারছে না। ভারত এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশকে এই সুবিধা দিতে সম্মত হয়নি। নেপাল ও ভুটান যথাক্রমে ১৯৭৬ ও ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের সাথে ট্রানজিট চুক্তি করেছিল। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা কাজ করছে না।
বর্তমানে নেপাল ও ভুটানের ট্রাক বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে পণ্য পরিবহণ করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতর প্রবেশ করে মংলা বা চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশি ট্রাকে পণ্য নিয়ে ভারতীয় সীমান্তে গিয়ে তা খালাস করা হয়। তারপর আবার ভারতীয়, নেপালি বা ভুটানি ট্রাক তা তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে চলে যায়। এই ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থা অনেকদিন থেকে চালু থাকলেও, ভারত সরাসরি বাংলাদেশকে ট্রানজিট সুবিধা দিচ্ছে না।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি অনুযায়ী, একটি দেশ আরেকটি দেশের উপর দিয়ে তৃতীয় কোন দেশে পণ্য পরিবহন করতে চাইলে, দ্বিতীয় দেশ ট্রানজিট সুবিধা দিতে বাধ্য। কিন্তু একটি দেশ আরেকটি দেশের উপর দিয়ে আবারো নিজের দেশের ভূখণ্ডে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে; মধ্যবর্তী দেশটি ট্রানজিট সুবিধা দিতে বাধ্য নয়। ভারত বাংলাদেশকে ট্রানজিট সুবিধা দিতে বাধ্য হওয়ার পরও, বাংলাদেশ এই সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ভারতের ট্রানজিট সুবিধা পাবার যোগ্য দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেশী দেশটি আমাদেরকে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখেছে।
বাংলাদেশের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি
বাংলাদেশ থেকে প্রচুর রোগী ভারতে চিকিৎসার জন্য যায়। বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসা সেবা আরো সহজ করতে, ভারত বাংলাদেশের জন্য ই-মেডিকেল ভিসা চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। সেই সাথে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের সুবিধার্থে রংপুরে একটি নতুন সহকারী হাইকমিশন খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ভারতকে দেয়া ট্রানজিট সুবিধার বিনিময়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তির বিষয়টি সেভাবে দৃশ্যমান নয়। সে কারণেই একটা ধারণা বেশ জোরাল যে, প্রায় একতরফাভাবে ভারতকে সুবিধা দেয়া হয়েছে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় প্রকাশ করা এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ভারতের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে বিনা মাসুলে ট্রানজিট দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এখনও নেপাল-ভুটানে ট্রানজিট সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না।
ভারতের সাথে বিদ্যমান বড় বাণিজ্য ঘাটতি, তিস্তাসহ ৫৩টি অভিন্ন নদীর পানি বন্টন বিষয়ে সুরাহা না হওয়া, সীমান্তে হত্যা শূন্যতে নামাতে না পারা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের সাথে সন্তোষজনক সমঝোতা না হওয়ায়; বাংলাদেশে ভারতের ট্রানজিট সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী ক্রমেই বাড়ছে।