বাংলাদেশে বন্যার কারণ কী
বাংলাদেশে বন্যার কারণ কী
সূচনা
হঠাৎ করেই বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা এবং নোয়াখালী জেলায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই বন্যায় মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার কয়টি উপজেলাও প্লাবিত হয়েছে। এই সবগুলো জেলা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রতিবেশি।
ভারত ত্রিপুরার ডম্বুর পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গেট খুলে দেওয়ার কারণেই, বিগত ৩০ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টি হয়েছে। তাই এবারের বন্যা যতটা না প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার চেয়েও অনেক বেশি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, বাংলাদেশের ত্রিপুরায় গোমতী নদীর বাঁধ খুলে দেওয়ার জন্য বন্যা তৈরি হয়নি, এই অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা হয়েছে। তবে অনেকেই একে ভারতের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন।
ত্রিপুরায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত
আবহাওয়াবিদরা বলছেন ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের উপর চারটি বিশেষ আবহাওয়া পরিস্থিতি তৈরি হবার কারণে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। ১. এল-নিনো ২. মেডেন-জুলিয়ান দোলন যাকে সংক্ষেপে বলা হয় এমজেও ৩. জেট স্ট্রিম এবং ৪. বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মৌসুমি লঘু চাপ। এই চারটি বিষয়ের প্রত্যেকটি আলাদা আলাদাভাবে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। এই চার ধরনের আবহাওয়া পরিস্থিতি একসাথে তৈরি হওয়ার ফলেই ভারত ও ত্রিপুরা রাজ্যের উপর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি ও বন্যা হয়েছে।
সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্যে পুরো আগস্ট মাস জুড়ে বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল ২১৪ মিলিমিটার; সেখানে আগস্টের ২০ তারিখে বৃষ্টি হয়েছে ৩৭৫ মিলিমিটার এবং ২১ তারিখে বৃষ্টি হয়েছে ২৪৭ মিলিমিটার। সবমিলিয়ে আগস্ট মাসের ২১ তারিখ পর্যন্ত সর্বমোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫৩৮ মিলিমিটার। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ১৫১ শতাংশ বেশি। এছাড়া গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অধীনে ডুম্বুর জলাধারটি যেখানে অবস্থিত, সেখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল ১৯৬.৫ মিলিমিটার। অথচ সেখানে বৃষ্টি হয়েছে ৬৫৬.৬ মিলিমিটার। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২৩৪ শতাংশ বেশি। সে কারণে ত্রিপুরা রাজ্যের সবগুলো নদী বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ডুম্বুর জলাধার পানি ধারণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালে, এর গেটগুলো নিজে থেকেই খুলে যায়। বাংলাদেশের উত্তর দিকে তিস্তা অববাহিকায় বন্যা হলে, তা বাংলাদেশে আসতে ২ থেকে ৩ দিন সময় লাগে। কিন্তু ত্রিপুরা থেকে পানি বাংলাদেশে আসতে সময় লেগেছে মাত্র ২ থেকে ৩ ঘন্টা। সেকারণে বাংলাদেশের বন্যা দুর্গত এলাকায় প্রস্তুতির তেমন কোন সুযোগ ছিল না।
বন্যার আসল কারণ কী
সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিকভাবে হওয়া অধিক বৃষ্টিপাতই এই অঞ্চলের বন্যার প্রধান কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু বাঁধ খুলে দেওয়ার বিষয়ে ভারতের বক্তব্য পুরোপুরি বিশ্বাস করাটা মুশকিল। কারণ ভারত ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের সাথে নিয়মিত মিথ্যাচার করে আসছে।
কুমিল্লা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদী ও ফেনী জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত মুহুরী নদীর উজানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে একাধিক বাঁধ দিয়েছে দেশটির সরকার। এসব বাঁধ ও ব্যারেজের কোনোটি পানি সংরক্ষণের জন্য, কোনোটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কিংবা কৃষিকাজের জন্য।
১৮ আগস্ট এর আগেই ভারতের এইসব ড্যাম পানিতে পূর্ণ ছিল। এরপর ১৯ এবং ২০ আগস্ট দুই দিনের বৃষ্টিতে ত্রিপুরা রাজ্যের সকল ড্যাম ও ব্যারেজের পানি ধারণক্ষমতা অতিক্রম করলে ২০ আগস্ট রাতের হঠাৎ করেই, শুধু ডুম্বুর নয় ত্রিপুরার অধিকাংশ ব্যারেজের গেট খুলে দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা। এসব গেট খুলে দেওয়ার আগে ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ কিংবা ভারত সরকার বাংলাদেশকে কোনরকম তথ্য দেয়নি।
ডুম্বুর বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে এই গেট খুলে দেওয়া হয়েছিল। তারমানে বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের এই অঞ্চলের নদীগুলো তাদের স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে বঞ্চিত। উজানে বাঁধ এবং ডাইভারশন প্রকল্পের মাধ্যমে পানি আটকে রাখার ফলে নদীগুলোর ন্যূনতম প্রবাহ বজায় থাকে না, এবং বর্ষাকালে হঠাৎ করে প্রচুর পানি ছাড়া হলে বাংলাদেশের নদীগুলো অস্বাভাবিকভাবে ফুলে-ফেঁপে ওঠে এবং বন্যা হয়। অর্ধ শতাব্দী ধরে নদীগুলো তাদের নাব্যতা হারিয়ে অতিরিক্ত পানি সংরক্ষণ এবং নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। নদীকে যদি তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া হত, তাহলে প্রাকৃতিক কারণে অধিক বৃষ্টিপাত হলেও, তার বন্যা পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হতো না। আর তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, ২০২৪ সালের এই মহাপ্লাবন সুদীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা ভারতের পানি আগ্রাসনেরই ফসল।
বারবার আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন করার পরও ভারতকে কোন ধরনের জবাবদিহিতার অধীনে না নিয়ে আসা বাংলাদেশের একটি মারাত্নক কূটনৈতিক ব্যার্থতা।
আমাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির মূল কারণ হলো অর্থনৈতিক সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়া। আগামীর বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, সামরিক দিক থেকে অপরাজেয় এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে অগ্রগামী করতে আমাদেরকে শিক্ষা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করতে হবে।
যৌথ নদী কমিশন
ভারতের সাথে বাংলাদেশের ৫৪ টি অভিন্ন নদী রয়েছে। এইসব নদীর পানির ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভারত বরাবরই বাংলাদেশকে বঞ্চিত করেছে। অথচ এই অধিকার নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান একটি বহুমাত্রিক বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের জল সম্পদ বন্টন, সেচ, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়। তার মানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার নদীবাহিত পানি বন্টনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল বহু আগেই। কিন্তু দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময় পার হলেও যৌথ নদী কমিশন কোন ধরনের উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের সর্বোচ্চ সফলতা গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি সম্পাদন করা। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরপরই তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়ার সাথে গঙ্গা নদীর পানি সম্পদের সঠিক বন্টন ও উন্নয়ন সম্পর্কিত একটি চুক্তি করেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের লাভ ওই কাগজে-কলমে চুক্তি পর্যন্তই।
এর মাঝে ভারত ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণ করে গঙ্গার পানি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীতে প্রবাহিত করে, বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে মারাত্মক পানি সংকট তৈরি করেছে। তিস্তা নদীর উপর ধাপে ধাপ বহু বাঁধ এবং ব্যারেজ নির্মাণ করে পানি আটকে রাখার ফলে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ কে মরুভূমিতে পরিণত করেছে। ভারত মনিপুর রাজ্যে উৎপন্ন বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর প্রবাহ বন্ধ করেছে। এভাবে বাংলাদেশের সাথে থাকা ৫৪ টি নদীর অধিকাংশতেই ভারত নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করছে।
গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তির ২৬ বছর পর মাত্র একটি নদীর পানি বন্টন নিয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে সেটি হল কুশিয়ারা। শেখ হাসিনা ২০২২ সালে তার ভারত সফরে এই চুক্তিটি করেছিলেন। যদিও সেই সফরে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তিস্তা চুক্তি। কিন্তু ভারত বরাবরের মতই কৌশলে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি এড়িয়ে গেছে; এবং আওয়ামীলীগ সরকারও বিষয়টি হাসিমুখে মেনে নিয়েছে।
সমাধানের পথ
পানি বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন যাবত বলে আসছেন, ভারত বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলোর পানি বন্টনে দ্বিপাক্ষিকভাবে অগ্রগতি না হওয়ায় এখন কোন আন্তর্জাতিক তৃতীয় পক্ষের সহযোগিতা নেওয়া উচিত। ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় ভারত ও পাকিস্তান “সিন্ধু পানি চুক্তি” স্বাক্ষর করেছিল। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক থাকার পরও সেই চুক্তির আওতায় তারা বছরের পর বছর ধরে ছয়টি নদীর পানি ভাগাভাগি করছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের চুক্তির ক্ষেত্রে ভারত অন্য কোন আন্তর্জাতিক পক্ষকে শামিল করতে নারাজ।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সাথে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এই সুসম্পর্কে বাংলাদেশের কোনই লাভ হয়নি। দ্বিপাক্ষিক আলোচন দুই দেশের দেওয়া নেওয়ার যে বিষয় থাকে সেখানে ভারত তাদের প্রত্যাশার সবই পেয়ে গেছে। এর ফলে নদীর পানি বন্টনের ভারতের আগ্রহ নেই বললেই চলে।
অতীতে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের একটি অভিযোগ ছিল যে, ভারতের বিভিন্ন সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূমিতে প্রশ্রয় দেয়া হয়। কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় এবং ভারত সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। এরপর ভারতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা ছিল বাংলাদেশের উপর দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ট্রানজিট সুবিধা আদায় করা। আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে রেল ট্রানজিট, নৌ ট্রানজিট, সড়ক ট্রানজিট, বাস ট্রানজিট এবং বিদ্যুৎ ট্রানজিট সহ সকল ধরনের ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে দিয়েছে। শেখ হাসিনা ভারতকে সকল সুবিধা দিয়ে বসে আছে, কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষের সুবিধা আদায় করার ব্যাপারে কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
১৯৭৬ সালের ১৬ ই মে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী ভারতের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ এর ডাক দিয়েছিলেন। সেই লংমার্চে তিনি বলেছিলেন, “শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির ওপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও, তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার যে হরণ করেছে তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।”
দেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা লিখেছিলেন, “ভারত ঠান্ডা মাথায় যে কাজটি করে যাচ্ছে, তা হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর অমানবিক বোমা বর্ষণের চাইতে কম নিষ্ঠুর নয়। তার প্রলয়ঙ্করী প্রতিক্রিয়াগুলো একসঙ্গে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি না বলে আমাদের বেশির ভাগ মানুষ চোখ বুঁজে এই জুলুম সহ্য করে যাচ্ছি।”
বিশ্ব রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এটি বিষয়ে অনেক আগে প্রচলিত ছিল যে, কোন দেশের আমেরিকার মতো বন্ধু থাকলে, তাদের শত্রুর দরকার হয় না। এই কথাটা ভারতের ক্ষেত্রেও একেবারে যথার্থ। ভারত মৌখিকভাবে বাংলাদেশকে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করলেও; সুদীর্ঘ ৫০ বছরের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের সাথে শত্রুর চেয়েও জঘন্য আচরণ করেছে।