বয়কট কোকাকোলা

maxresdefault (10)
কি কেন কিভাবে

বয়কট কোকাকোলা

 ইসরাইল ফিলিস্তিনে গণহত্যা শুরু করার পর থেকে, এমন সব পশ্চিমা ব্র্যান্ড বর্জনের ডাক উঠেছিল যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করে। কোকা কোলা এমনই একটি ব্র্যান্ড যারা ইসরায়েলের সমর্থনে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করার কারণে বারবার বয়কটের শিকার হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপন কে কেন্দ্র করে কোকা কোলা বয়কটের বিষয়টি আবারও নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

কোকা কোলার নতুন এই বিজ্ঞাপনটিতে বলা হয়, “ওই জায়গা” র সাথে অর্থাৎ ইসরায়েলের সাথে কোকাকোলার কোন সম্পর্কই নেই। এমনকি আরো দাবি করা হয় ফিলিস্তিনে কোকাকোলা ফ্যাক্টরিও আছে।

কোকাকোলা কি আসলেই “ওই জায়গার” ?

কোকাকোলার সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক

১৯৬৮ সালে একটি বোতলজাতকরণ কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কোকা কোলা ইসরাইলে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল। কোকাকোলার এই ব্যবসায়িক পদক্ষেপ সে সময় মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বেশ অস্থিরতার জন্ম দিয়েছিল। ইসরাইলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৯৬৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আরব লীগ কোকা-কোলার উপর বয়কট ঘোষণা করে। এই সময়ের মধ্যে বেশকিছু আরব দেশে কোকা কোলা বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল; যে কারণে মধ্যপ্রাচ্যে কোকা কোলা তাদের একটি বড় মার্কেট শেয়ার হারায়। তারপরও সময়ের সাথে সাথে কোকা কোলা ইসরাইলে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে এবং ইসরায়েলের বেভারেজ মার্কেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

কোকাকোলা ইসরায়েল আটারোট নামের একটি ইসরায়েলী স্যাটেলমেন্টে কারখানা স্থাপন করেছে। যে জায়গাটি অতীতে ফিলিস্তিনীদের ছিল; এবং ইসরায়েল তা জোড় করে কেড়ে নিয়েছে। এ ধরনের অঞ্চলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার করা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। সেই সাথে কোকাকোলা জেনে শুনে ইসরায়েলের দখলদারি থেকে লাভবা হবার চেষ্টা করেছে। তাছাড়া ইসরায়েল করপোরেশন অথরিটির একটি নথি থেকে জানা যায়, কোকাকোলা ২০১৫ সালে ইম তির্তজু নামের একটি জায়নবাদী বেসরকারী প্রতষ্ঠানকে ৫০ হাজার শ্যাকেল সহায়তা দিয়েছে। ইসরায়েলের স্বার্থে কাজ করা এবং জায়নবাদীদের শত্রুদের দমন করাই এদের প্রধান কাজ।

২০২২ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা করেছিল, তখন কোকাকোলা রাশিয়া থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েল ফিলিস্তিনের গাজায় তার চেয়ে লক্ষ কোটি গুণ বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও, কোকাকোলা এ ধরনের কোন পদক্ষেপ নেয় নি।

কোকাকোলা যে ইজরায়েল এবং জায়নবাদীদের সমর্থন করে সে বিষয়ে আরো যথেষ্ট আলামত রয়েছে।

কোকাকোলার সাথে ফিলিস্তিনের সম্পর্ক

কোকা কোলা ১৯৯৮ সালে সর্বপ্রথম ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের রামাল্লায় একটি বোতলজাতকরন কারখানা স্থাপন করে। কোকাকোলার এই কারখানা স্থাপিত হয়েছিল ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন ন্যাশনাল বেভারেজ কোম্পানি বা এনবিসির সাথে যৌথ উদ্যোগে। এই এনবিসির মালিক হলেন জাহি খৌরি নামের একজন মার্কিন ফিলিস্তিনী খ্রিস্টান। কোকা কোলার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে এনবিসি একটি স্বাধীন কোম্পানি; তবে তারা কোকাকোলার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ভাবে পরিচালিত হয়। জাহি খৌরির এনবিসি ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনে কোকা কোলার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

২০১৬ সালে কোকা কোলা ফিলিস্তিনের গাজায় তাদের কারখানা চালু করার ঘোষণা দিয়েছিল। কোকা কোলার দাবি গাজায় কোকাকোলা ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। কোকা কোলার ওয়েবসাইটে আরো বলা হয়েছে এনবিসির সঙ্গে কোকাকোলা গাজায় স্কুল পরিচালনা, রোজায় ইফতার বিতরণ থেকে শুরু করে নানা ধরনের সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড করে থাকে। বর্তমানে ফিলিস্তিনে চারটি কোকাকোলা বোতলজাতকরণ কারখানা এবং তিনটি কোকাকোলা সরবরাহ কেন্দ্র রয়েছে।

অতীতেও একাধিকবার ফিলিস্তিনী সমর্থকরা কোকাকোলা বয়কট করেছে; কারণ ইসরাইল অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোতে কোকাকোলা কারখানা স্থাপন সহ ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। ২০১৭ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল বেশকিছু ইসরাইলি কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল। কারণ এসব কোম্পানি ইজরায়েলের অবৈধভাবে দখলকৃত ফিলিস্তিনি এলাকগুলোতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করত। সেই তালিকায় কোকাকোলা ইসরায়েলের ও নাম ছিল। যদিও সর্বশেষ প্রকাশিত কালো তালিকা থেকে কোকাকোলার নাম বাদ দেওয়া হয়।

শেয়ার এ কোক

বাংলাদেশে সম্প্রতি আলোচিত বিজ্ঞাপনটিতে কোকা কোলা সরাসরি ইসরায়েলের নাম উল্লেখ না করে ইসরাইল কে “ওই জায়গা” বলে সম্বোধন করেছে। তবে সত্যিকার অর্থে অতীতে তারা ফিলিস্তিনের নামও মুখে আনতে চায়নি।

কোকা কোলা একবার Share a Coke নামে একটি ক্যাম্পেইন চালু করেছিল। সেই ক্যাম্পেইনে কোকা কোলা বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের জনপ্রিয় নাম গুলো বোতলের গায়ের ছেপে বাজারজাত করেছিল। গ্রাহকরা চাইলে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিজেদের ইচ্ছেমতো ডিজাইন এবং নাম দিয়েও কোকাকোলা বোতল তৈরি করে নিতে পারত। কিন্তু সেই ক্যাম্পেইনে প্যালেস্টাইন শব্দটি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্লক করে রাখা হয়েছিল। ফিলিস্তিনের নাম দিয়ে বোতল কাস্টমাইজ করতে চাইলে ইরোর মেসেজ দেখাত। প্যালেস্টাইন শব্দটি ব্লক করা থাকলেও, ইসরায়েল এর নামে ঠিকই বোতল প্রিন্ট করা যেত। একইভাবে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ইসলামী নামও তারা ব্লক করে রেখেছিল। যেমন ওই ক্যাম্পেইনে মোহাম্মদ নাম লিখে কোন বোতল কাস্টমাইজ করা যেত না। অথচ মোহাম্মদ বিশ্বব্যাপী একটি জনপ্রিয় ইসলামি নাম। এমনকি যুক্তরাজ্যে শিশুদের সবচেয়ে জনপ্রিয় নামের একটি মোহাম্মদ। অথচ “নাৎসি” র মত ঘৃণ্য কুখ্যাত নামও কোকাকোলা তাদের বোতলে প্রিন্ট করার জন্য এলাউ করেছে।

কোকাকোলা যেহেতু আগে থেকে পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিন আর মোহাম্মদ নাম দুটি ব্লক করে রেখেছিল; তাই এ থেকে সহজেই কোকাকোলা কম্পানির ইসলাম বিদ্বেষের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই বিষয়টি নিয়ে মাত্র কয়েক বছর আগেও কোকাকোলা বিশ্বের বেশ কিছু অঞ্চলে বয়কটের শিকার হয়েছিল।

কার লাভ কার ক্ষতি?

কোকা কোলার মত বৈশ্বিক একটি কোম্পানিকে বয়কট করার ফলে, সত্যি সত্যি কোকাকোলা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নাকি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা নিয়েও একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

কয়েক বছর আগে ইসরাইল গাজায় হামলা চালানোর পর; মালয়েশিয়ানরা ব্যাপকভাবে কোকা কোলা বর্জন করেছিল। তখন কোকাকোলা বলেছিল এই বয়কটের ফলে শুধু মালয়েশিয়ার অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ কোকাকোলা একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড হলেও এর সকল বোতলজাতকরণ কার্যক্রম স্থানীয়ভাবেই হয়ে থাকে।

কোন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বয়কটের শিকার হলে, কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নির্ভর করে কোম্পানিটি কিভাবে পরিচালিত হয়। এই বিষয়টি মোটা দাগের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত বৈশ্বিক কোম্পানিটি নিজেরাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করে। দ্বিতীয়ত কোন ব্র্যান্ড তাদের ট্রেডমার্ক দিয়ে ব্যবসা করার জন্য স্থানীয় কোন কোম্পানির কাছে ফ্র্যাঞ্চাইজি বিক্রি করে।

প্রথম ক্ষেত্রে, মূল কোম্পানির লাভ বলতে তাদের সমস্ত শাখার লাভের সমষ্টিকে বোঝায়। তাই যদি কিছু শাখা লাভ করতে না পারে তাহলে মূল কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, স্থানীয় ব্যবসায়ী মূল কোম্পানির ট্রেডমার্ক ব্যবহার করার কারণে, মূল কোম্পানিকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হয়। এখন ওই স্থানীয় ব্যবসায়ীর লাভ হোক বা ক্ষতি তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ মূল কোম্পানিকে দিতেই হবে। অর্থাৎ বয়কটের ফলে ক্ষতির কোন প্রভাব মূল কোম্পানির ওপর পড়বে না। এতে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হন ওই স্থানীয় বিনিয়োগকারী যিনি একটি দেশে বড় কোন ব্রান্ডের শাখা অফিস পরিচালনা করেন। এই ক্ষেত্রে বয়কটে স্থানীয় শ্রমিক, তাদের পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়ে।

কোকা কোলা ছাড়াও ম্যাকডোনাল্ডস, স্টারবাকস, ডমিনোস এর মত খাদ্যদ্রব্য প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ফেসবুক, মাইক্রোসফট, গুগল, এইচপি সহ আরো বেশ কিছু প্রযুক্তি কোম্পানি বয়কটের ডাক বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এর কারণ হল এই কোম্পানিগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে; এবং সেই টাকা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে অস্ত্রসহ নানা ধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে ফিলিস্তিনে জাতিগত নিধন চালাতে সহযোগিতা করছে। তাই ইসরাইলের প্রতি সহমর্মী প্রতিষ্ঠানগুলো বর্জনের মধ্য দিয়ে, ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র আমেরিকার অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেওয়াই বয়কটের মূল উদ্দেশ্য।

কোলা বর্জন

পেপসি কোকাকোলার মতো বৈশ্বিক কোলা ব্র্যান্ডগুলো বর্জনের পর বিভিন্ন স্থানীয় কোমল পানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রির মার্কেট শেয়ারে ভাগ বসাতে শুরু করেছে। মিশরের ১০০ বছরেরও পুরনো একটি স্থানীয় সোডা ব্র্যান্ড স্পিরো স্পাথিস নতুন করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে এসেছে। বাংলাদেশেও পেপসি কোকাকোলার বদলে মানুষ দেশীয় ব্র্যান্ড মোজো খাওয়ার প্রতি উৎসাহী হয়েছে। সে কারণে বিগত কয়েক মাসে মোজোর মার্কেট শেয়ার অনেক বেড়ে গেছে। এমনকি মোজো ফিলিস্তিনকে সহায়তা করে এমন ধরনের প্রচারণা চালিয়ে, তারা আরো বেশি বাজার ধরার চেষ্টা করছে।

তবে সত্যিকার অর্থে আপনি যে ব্র্যান্ডের কোমল পানীয়ই পান করেন না কেন, এগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যে ধরনের ক্ষতিকর উপাদান দিয়ে কোমল পানীয় তৈরি করা হয়, তা জানার পর একজন বিবেকবান মানুষ কখনোই আর কোন ধরনের সফট ড্রিংস খেতে চাইবেন না। সেকারণে ইসরাইলের সাথে কোকাকোলার কোন সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, ফিলিস্তিনে কোকের ফ্যাক্টরি থাকুক বা না থাকুক; সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের সকল ধরনের কোমল পানীয় বর্জন করা উচিত।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।