প্রাচীন আরব নগরী পেত্রা
প্রাচীন আরব নগরী পেত্রা
জর্ডানের ওয়াদি রাম মরুভূমিতে অবস্থিত এক বিষ্ময়কর প্রাচীন শহর পেত্রা। পাহাড় খোদাই করে নির্মিত, অদ্ভূত এই শহরটি সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম। পেত্রা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যেও শীর্ষে রয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ১০ লক্ষ পর্যটক এই ঐতিহ্যবাহী নগরীতে ঘুরতে আসে। সভ্যতা, সংস্কৃতি আর ক্ষমতায় পেত্রা যে একসময় কতটা সমৃদ্ধ ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে পেত্রার ধ্বংসাবশেষ জুড়ে।
পেত্রা নামটি গ্রিক শব্দ পেট্রোস থেকে এসেছে, যার অর্থ “পাথর”। পাথরের তৈরি বলে এমন নামকরণ হতে পারে। নগরীটিকে আরবি ভাষায় “আল-বুত্তা” নামেও ডাকা হয়। মিশরীয়রা আবার একে সেলা নামে ডাকত। সেলা অর্থ শিলা। পেত্রা নগরী ওয়াদি রাম নামের যে মরুভূমির মাঝে অবস্থিত, তার সৌন্দর্য শ্বাসরুদ্ধকর। এখানকার বালি, পাহাড় আর প্রকৃতি দেখলে মনে হবে আপনি যেন, হাজার বছর আগের পৃথিবীতে ফিরে গেছেন। এখানকার মরুভূমিতে বালিঝড় শুরু হলে, মনে হয় এটি যেন অন্য কোন গ্রহ। প্রায় তিন কোটি বছর আগে এক ভৌগলিক চুত্যির ফলে এই উপত্যকার সৃষ্টি হয়েছে। এই মরুভূমির পাহাড়গুলোর সর্বোচ্চ উচ্চতা প্রায় ৪০০ মিটার। আরবরা এগুলোকে বলে হিসমা। এসব পাহাড়ের গায়ে সাড়ে তিন হাজার বছর আগের চিত্রকর্ম এবং লিখিত বর্ণনা পাওয়া গেছে। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের বানিজ্য পথ গুলোর মধ্যে পেত্রা নগরীর অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। ঐতিহাসিকরা পেত্রাকে প্রাচীন বানিজ্যের হৃদপিন্ড হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অতি প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এই অঞ্চল দিয়ে উটের কাফেলা নিয়ে যেত। হেজাজ, আরব এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে এসব পরিচালনা করা হত। বিস্তৃত অঞ্চলের মধ্যে যাতায়াত করার সময় মানুষ এখানে যাত্রাবিরতি করত। এখানে বহু ধরনের ব্যবসা বানিজ্যও হত। আরব থেকে আসা চামড়া, ভারত এবং চীন থেকে আসা মসলা, সিল্ক এবং কাপড় এখানে লেনদেন করা হত। শুধু ব্যবসা বানিজ্যই নয়, প্রাচীন কালে পেত্রা নগরী তারা অনুপম নির্মাণ শৈলীর জন্যও অত্যন্ত বিখ্যাত ছিল।
পেত্রা শহরটি মূলত নাবাতিয়ান জনগোষ্ঠীর বাসস্থান ছিল। এটি ছিল নাবাতিয়ানদের রাজধানী। এই শহরে তারা পাহাড় খোদাই করে প্রাসাদ, মন্দির এবং সমাধি গড়ে তুলেছিল। পাহাড় খোদাই করে নির্মিত প্রাসাদ চাড়াও, এখানে আছে অর্ধগোলাকৃতির এক নাট্যশালা। এখানে প্রায় তিন হাজার দর্শক একসাথে বসার সুযোগ ছিল। বহু গবেষনার পরেও, সম্বৃদ্ধ এই সভ্যতার অধিকাংশ বিষয় এখনও রহস্যই রয়ে গেছে। পেত্রা শহরে শুধুমাত্র একটি দিক দিয়েই প্রবেশ করা যায়। এই প্রবেশদ্বারের সবচেয়ে সরু অংশটি মাত্র দুই মিটার প্রশস্ত। এই সরু রাস্তার কারণেই পেত্রা শহরটি ছিল দুর্ভেদ্য। অতীতের কিংবদন্তি নাবাতিয়ানদের বেশ কিছু বংশধর এখনও এখানে বসবাস করেন। নাবাতিয়ানরা মূলত ইয়েমেন থেকে এই অঞ্চলে এসেছিল। বহু আগে থেকে তারা এখানকার পাহাড় খোদাই করে, প্রাসাদ তৈরী করতে শুরু করে। পরবর্তীতে তারা পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ খ্রিষ্ট্রপূর্বাব্দে পেত্রাকে রাজধানী হিসেবে গ্রহণ করেছিল। সেসময় প্রায় ২০ হাজার নাবাতিয়ান এই শহরে বসবাস করত। তখন তাদের রাজা ছিলেন প্রথম আরিতাস। এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ আরিতাসও নাবাতিয়ানদের রাজা হিসেবে এখানকার প্রাসাদ থেকে রাজ্য পরিচালনা করেছেন। প্রাচীন যুগে পেত্রা এতটা গুরুত্বপূর্ণ জায়াগায় পরিণত হবার অন্যতম প্রদান কারণ হল, এর গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থান। তৎকালীন সময়ে এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য পথের একটি। এই পথকে বলা হত ইনসেন্স রোড। ইনসেন্স অর্থ ধূপ। এই পথে ধূপ, সুগন্ধি, জাফরান, গোলমরিচ, দারুচিনির মত বহু মশলা পরিবহণ করা হত। অতীতকালে এসব মসলা এবং সুগন্ধি স্বর্ণের মত মূল্যবান ছিল। এসব পণ্যই ছিল তৎকালীন সময়ের বিশ্ব বানিজ্যের প্রধান উপকরণ। প্রথমদিকে নাবাতিয়ানরা এই অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করা বানিজ্যিক কাফেলা গুলোতে ডাকাতি করত। এই পথে যাতায়াতের সময় ব্যবসায়ীরা নাবাতিয়ানদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকত। সেই থেকে নাবাতিয়ানরা চমৎকার এক ব্যবসার আইডিয়া পায়। তারা এই অঞ্চল দিয়ে পরিচালিত কাফেলায়, নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবসা শুরু করে। অর্থের বিনিময়ে নাবাতিয়ানরা ব্যবসায়ীদের পণ্য নিরাপদে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত পৌছে দিত। অন্যের মালামাল পাহারা দিতে দিতে, এক সময় নাবাতিয়ানরা নিজেরাও, ব্যবসা শুরু করে দেয়।
বহুকাল মানুষ ধারণা করত, নাবাতিয়ানরা এখানে তাদের গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে গেছে। এখানকার চমকপ্রদ এক প্রাসাদকে মনে করা হত, সেই গুপ্তধনের ভান্ডার। সেকারণে এর নাম দেওয়া হয়েছিল, আল খাজনি। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, এটি আসলে নাবাতিয়ান রাজ পরিবারের সমাধিক্ষেত্র। এসব প্রাসাদের কারুকার্য দেখলে, তাদের ক্ষমতা এবং শিল্পবোধ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নাবাতিয়ান সভ্যতার স্বর্নযুগে তারা দামেস্কাস পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি জেরুজালেমও তারা অবরোধ করে রেখেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা রোমান সা¤্রাজ্যের কাছে নতি শিকার করে, এবং নাবাতিয়ানরা রোমানদের ভূমিদাসে পরিণত হয়। তখন নাবাতিয়ান সা¤্রাজ্য রোমানদের পেত্রেইয়া প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়। এত সম্বৃদ্ধ নগর সভ্যতা কিভাবে বিলীন হয়েছিল, সে সম্পর্কে পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, তৃতীয় শতকে সিরিয়ার পালমিরা নগরী বানিজ্যিক দিক থেকে পেত্রার প্রতিদ্বন্দী হয়ে ওঠে। তখন থেকেই পেত্রার দাপট কমতে থাকে। এছাড়া পেত্রার অর্থনৈতিক পতনের আরেকটি কারণ ছিল, সুমদ্রকেন্দ্রিক বানিজ্য। বড় বড় জাহাজে করে, সমুদ্রপথে মালামাল পরিবহণ অনেক সহজ হবার পর থেকে পেত্রা নগরীর গুরুত্ব অনেক কমে যায়। এছাড়াও পেত্রায় বেশ কয়েকটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল বলে ধারনা করা হয়। তারপর থেকেই হয়ত বিষ্ময়কর এই শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে ওঠে।
পেত্রা নগরীর নির্মানশৈলী নিয়ে ইউনেস্কো এখনও গবেষনা করছে। পেত্রার প্রাসাদগুলোতে গ্রিসের হেলেনিস্টিক শৈলীর প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। নাবাতিয়ানরা যেহেতু ব্যবসা বানিজ্যের সাথে জড়িত ছিল, এবং তারা গ্রিসের সাথেও বানিজ্য করেছে। তাই তারা সেখান থেকেই হয়ত, গ্রিসের আর্কিটেকচারাল স্টাইল দ্বারা অনুপ্রানিত হয়েছে। কিন্তু তাই বলে নাবাতিয়ানদের নিজস্ব উদ্ভবনের কোন কমতি ছিল না। বর্তমানে ভারি বর্ষণের ফলে পাহাড়ে জমে থাকা পানি দ্বারা পেত্রার অবকাঠামোগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হল, নাবাতিয়ানরা এই সমস্যার অত্যন্ত চমৎকার সামাধান বের করতে পেরেছিল। নাবাতিয়ানরা ছিল অসাধারণ প্রকৌশলী। এমনকি হাইড্রোলিক ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কেও তাদের ধারণা ছিল। সেজন্যই তারা বৃষ্টির পানিকে চমৎকার ভাবে প্রবাহিত করতে পেরেছিল। ফলে তাদের সময় এসব স্থাপনায় পানি জমে বন্যার সৃষ্টি হত না। শুধু তাই নয়, পানি জমা করে, দৈনন্দিন জীবনে বাসাবাড়িতে পানি ব্যবহারের জন্যও তারা উন্নত পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। সেই সব বৈশিষ্ট্য পেত্রা শহরের অবকাঠামোগুলোতে এখনও দৃশ্যমান রয়েছে। বর্তমান সময়ে প্রতœত্তাত্ত্বিকেরা নাবাতিয়ানদের পুরনো সেই পানির লাইনগুলোই আবারো চালু করার চেষ্টা করছেন। যেন ঐতিহাসিক এই স্থানে বন্যার ঝুঁকি মোকাবেলা করা যায়। পেত্রা নগরীকে বন্যা এবং ভূমিকম্পের ক্ষতি থেকে বাঁচাতে ইউনেস্কোর বহু গবেষকরা এখানে কাজ করছেন। পাহাড়ের উপর বড় বড় বহু আলগা পাথর রয়েছে। যেগুলো ঝড়ের সময় নিচে পড়ে, পেত্রার সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এসব আলদা পাথরগুলোকে বিশেষ ধরনের লোহার জালের সাহায্যে আটকে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। সম্পূর্ন কাজ শেষ করতে আরো বহু বছর সময় লাগবে। কিন্তু এসব সংস্কার কাজ সম্পন্ন হলে, বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।