পোপের আসলে কাজ কী

পোপের আসলে কাজ কী
কি কেন কিভাবে

পোপের আসলে কাজ কী

ভূমিকা

পোপ হলেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা এবং বিশ্বব্যাপী প্রায় ১২০ কোটিরও বেশি ক্যাথলিক খ্রিস্টানের আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক। তাঁকে ‘পৃথিবীর সর্বোচ্চ পাদ্রী’ বা ‘হোলি ফাদার’ বলেও সম্মান করা হয়। পোপ শুধুমাত্র একজন ধর্মীয় নেতা নন; তিনি একজন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক ব্যক্তিত্বও, যিনি ভ্যাটিকান সিটির শাসক হিসেবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকাও পালন করেন।

মধ্যযুগীয় ইউরোপে পোপ ছিল ক্ষমতার সর্বোচ্চ কেন্দ্র। তৎকালীন সময়ের ছোট খাট রাজা থেকে শুরু করে সম্রাট পর্যন্ত সবাই পোপের ভয়ে কাঁপত। এমনকি অতীতে টাকার বিনিময়ে পোপরা স্বর্গে যাওয়ার টিকিটও বিক্রি করত।

অতীতে পোপের ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহারের কারণে খ্রিস্টান অর্থডক্স ধারার জন্ম হয়। এবং পোপের ভয়াবহ দুর্নীতির কারণেই মূলত প্রোটেস্ট্যান্ট নামে খ্রিস্টান ধর্মের আলাদা শাখা তৈরী হয়। তাই পোপ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সকল খ্রিষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু নন। অর্থডক্স ও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানরা পোপের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে।

পোপের ইতিহাস

প্রায় দুই হাজার বছর আগে, খ্রিস্টধর্মের একেবারে গোড়ার দিকে, যিশুখ্রিস্ট যখন তাঁর শিষ্যদের মধ্যে একজনকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন তখন থেকেই পোপের ইতিহাস শুরু হয়। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, যিশুর সেই বিশেষ শিষ্য ছিলেন সেন্ট পিটার (Saint Peter)। বলা হয়, যিশু তাঁকে বলেছিলেন, “তুমি পাথরের মতো শক্ত, আমি এই পাথরের ওপর আমার চার্চ গড়ে তুলব।” এই পিটারকেই পরবর্তীতে প্রথম পোপ হিসেবে গণ্য করা হয়।

খ্রিস্টধর্ম প্রথমদিকে একটি অত্যন্ত নির্যাতিত ধর্ম ছিল। রোম সাম্রাজ্যের অধীনে খ্রিস্টানরা প্রায়ই অত্যাচারের শিকার হতেন। কিন্তু সেই সময়েই, পিটার রোম শহরে আসেন এবং খ্রিস্টানদের সংগঠিত করে ধর্ম প্রচার শুরু করেন। ৬৪ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট নিরোর নির্দেশে সেন্ট পিটারকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। এবং তাঁর কবরের ওপরেই গড়ে ওঠে সেন্ট পিটার্স বাসিলিকা, যা আজকের ভ্যাটিকান সিটির মূল কেন্দ্র।

পিটারকে যেহেতু যিশুর সরাসরি নিযুক্ত প্রতিনিধি হিসেবে দেখা হয়, তাই রোম শহরে যাঁরা পরবর্তী সময়ে চার্চের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদেরও ‘পোপ’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। “পোপ” শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষার pappas থেকে, যার অর্থ হলো ‘পিতা’। এটি একটি সম্মানসূচক ডাকনাম, যা প্রাচীন কালে সম্মানিত ধর্মীয় ব্যক্তিদের জন্য ব্যবহৃত হতো।

মধ্যযুগে পোপের প্রভাব

প্রথম দিকে পোপের ক্ষমতা শুধুই রোম শহর ও তার আশেপাশের এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ক্ষমতা ও প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপ এবং পরে সারা বিশ্বে। মধ্যযুগে এসে পোপ শুধু ধর্মীয় নেতা নয়, বরং ইউরোপের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। রাজা-সম্রাটদের অভিষেক, যুদ্ধ-বিরতি, এমনকি ক্রুসেডের মত ধর্মযুদ্ধের নেতৃত্ব পর্যন্ত দিতেন পোপ। তৎকালীন সময়ে পোপকে প্রায় ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে মানা হতো।

মধ্যযুগের ইউরোপ মানেই ছিল চার্চ-নিয়ন্ত্রিত সমাজ, আর চার্চের শীর্ষে ছিলেন পোপ। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস ছিল, পোপ হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং যিশু খ্রিস্টের উত্তরসূরি সেন্ট পিটার এর চেয়ারে বসা ব্যক্তি। তাই পোপ এর সিদ্ধান্ত ‘স্বর্গীয় অনুমোদন’ হিসেবে বিবেচিত হতো। অনেক সময় দেখা যেত, রাজা হতে হলে পোপের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হত। এমনকি কাউকে পোপ নিজ হাতে রাজমুকুট পরিয়ে দিতেন।

মধ্যযুগে পোপ চাইলেই যে কাউকে গির্জা থেকে বহিষ্কার করতে পারতেন। আর তার মানে ছিল ঐ ব্যক্তি কখও স্বর্গে যেতে পারবে না। এই কারণে তৎকালীন ইউরোপের রাজা এবং সম্রাটেরাও পোপের ভয়ে কেঁপে উঠত। ১১শ শতকে জার্মান সম্রাট হেনরি পোপ গ্রেগরি সপ্তমের বিরাগভাজন হন এবং ক্ষমা চাইতে পোপের প্রাসাদের সামনে তিন দিন বরফে দাঁড়িয়ে থাকেন। একে বলা হয় “Walk to Canossa” – যা মধ্যযুগে পোপের ক্ষমতার প্রতীক হয়ে আছে।

১০৯৫ সালে পোপ আর্বান দ্বিতীয় First Crusade বা প্রথম ধর্মযুদ্ধের ঘোষণা দেন। তাঁর আহ্বানে হাজার হাজার ইউরোপীয় খ্রিস্টান যোদ্ধারা জেরুজালেম পুনরুদ্ধারে বেরিয়ে পড়ে। এই ক্রুসেড যুদ্ধগুলো শুধু ধর্মীয় নয়, বরং রাজনীতি ও ভূখণ্ড দখলের খেলা ছিল। তখনকার সময়ে কোন কোন পোপ ক্ষমতালোভী সম্রাাটদের মতই আচরণ করতেন। শুধু তাই নয়, তৎকালীন সময়ে চার্চ ইউরোপের সবচেয়ে বেশি জমির মালিক ছিল। মানুষ ‘স্বর্গে যাবার আশায়’ তাদের জমি এবং সোনা-দানা চার্চে দান করত। এর বাইরে পোপ ট্যাক্সও নিতেন, যাকে বলা হতো “tithe”। অর্থাৎ মানুষের আয় বা ফসলের ১০% র্চােচ দান করতে হত।

অতীতে চার্চই ছিল শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার মূল কেন্দ্র। চার্চের ছায়াতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয়েছে। সেসময় ধর্মযাজকরা বই লেখা ও সংরক্ষণের কাজ করতেন। সেকারণেই মধ্যযুগীয় ইউরোপে ধর্ম ছিল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু।

পোপের ক্ষমতা লোপ

প্রাচীন সময়ে খ্রিস্টান চার্চ একটাই ছিল। কিন্তু ১০৫৪ সালে ঘটে এক বিশাল ধর্মীয় বিভাজন, যাকে বলে The Great Schism। এই বিভাজনের ফলে খ্রিস্টধর্ম দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়: যার একদিকে ছিল ১. রোমান ক্যাথলিক এবং অন্যদিকে ২. ইস্টার্ন অরথডক্স।

পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো ছিল রোমান ক্যাথলিক, তারা পোপের কর্তৃত্ব মেনে চলত। কিন্তু পূর্ব ইউরোপে যেমন যেমন গ্রিস, রাশিয়া বা ইথিওপিয়ার মত খ্রিষ্টান অঞ্চল মনে করতে শুরু করে, পোপ রোম শহরের একজন বিশপ মাত্র, তাঁর সর্বোচ্চ ক্ষমতা নেই। অরথডক্সদের মতে প্রত্যেক দেশে নিজস্ব ধর্মীয় নেতা থাকবে যাঁকে Patriarch বলা হয়। তাদের মতে, পোপ অন্য ধর্মীয় নেতাদের উপরে নয়; বরং সবাই সমান।

তবে পোপের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার পেছনে অন্যতম একটি কারণ ছিল চার্চ এবং পোপের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ব্যাপক দুর্নীতি । ক্ষমতা থাকলে দুর্নীতি হবে এটাই স্বাভাবিক। পোপতন্ত্রের বেলায়ও তাই ঘটেছে। টাকা কামানোতে ক্যাথলিক চার্চগুলো এতটাই মত্ত হয়ে ওঠে যে, তার অর্থের বিনিময়ে পাপমুক্তির চিঠি দিতে শুরু করে। এগুলোকে বলা হত “indulgence”। অর্থাৎ কেউ যদি টাকা দিত, তবে চার্চ বলত, “তোমার আত্মা এখন স্বর্গে যাবে!” এগুলো অনেকটা স্বর্গের টিকেটের মত বিক্রি হত। এই ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেন মার্টিন লুথার নামে এক জার্মান ধর্মযাজক। তিনি ১৫১৭ সালে ৯৫টি অভিযোগ লিখে চার্চের দরজায় টাঙিয়ে দেন। এর থেকেই শুরু হয় প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন, যার ফলে ক্যাথলিক বনাম প্রোটেস্ট্যান্ট নামে খ্রিস্টান চার্চ দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়।

প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের বিশ্বাস হল ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্কের জন্য পোপ বা গির্জার দরকার নেই। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই সরাসরি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারে; তাই বাইবেলই শেষ কথা, পোপ নয়।

১৫৩৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি দ্বিতীয় বিয়ে করলে, পোপ তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নেয়নি। তখন রাজা হেনরি রোমের পোপকে অস্বীকার করে নিজেই “Church of England” প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমেও রোমান ক্যাথলিক চার্চ দুর্বল হয়ে পড়ে।

পরবর্তীতে ইউরোপীয় রেঁনেসা বা নবজাগরনের সময় মানুষ যুক্তি, বিজ্ঞান, মানবতা নিয়ে ভাবতে শুরু করে। সেই সাথে গুটেনবার্গ প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কৃত হবার পর, বাইবেলসহ হাজারো বই সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছাতে শুরু করে। আগে যা শুধু গির্জার ভেতর ছিল, তখন মানুষ নিজে পড়ে বুঝতে পারল – ধর্মে পোপের কোনই বিশেষত্ব নেই। তাই এক সময় ধীরে ধীরে ইউরোপ তথা বিশ্বজুড়ে পোপের কর্তৃত্ব হ্রাস পেতে থাকে।

অধুিনক যুেগ পোপ

আধুনিক যুগে এসে পোপের ভূমিকা কিছুটা বদলেছে। এখন তিনি সরাসরি রাজনীতি করেন না, বরং শান্তি, ন্যায়বিচার, আন্তঃধর্ম সম্প্রীতি এবং পরিবেশ রক্ষার মত বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। যেকোনো বড় সংকটে বা যুদ্ধবিরোধী আহ্বানে তাঁর কণ্ঠস্বর বিশ্বনেতারাও গুরুত্বের সঙ্গে শোনেন।

 একজন পোপ মারা যাবার পর প্যাপাল কনক্লেভ নামের একটি বিশেষ ধর্মীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। যার মাধ্যমে পরবর্তী পোপ নির্বাচিন করা হয়। এবং একজন ব্যক্তি পোপ হিসেবে নির্বাচিত হবার পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পোপের দ্বায়িত্ব পালন করেন।

পোপের কাজ কী ?

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।