পেঁয়াজের দাম বাড়ে কেন
পেঁয়াজের দাম বাড়ে কেন
ভূমিকা
পেঁয়াজ বাংলাদেশের খাদ্য পণ্যের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। উদ্ভিদগতভাবে এটি সবজি হলেও, পেঁয়াজ মূলত একটি মশলা হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। আলু ভর্তা ডিম ভাজি থেকে শুরু করে, মাছ মাংস সহ সকল তরকারি রান্নায় পেঁয়াজ দরকার হয়। বাঙালীদের পছন্দ এমন খুব কম তরকারিই আছে, যা পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করা যায়।
পেঁয়াজ উৎপাদনের দিক থেকে সমগ্র বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। কিন্তু বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা এতই বেশি যে, ঘাটতি মেটানোর জন্য বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি করে।
ভারত, চীন, মিয়ানমার, মিশর, তুরষ্ক থেকে পেঁয়াজ আসে বাংলাদেশে। ভারত প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় এবং স্থল পথে কম খরচে আমদানি করার সুযোগ থাকায়, সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি করা হয় ভারত থেকে।
২০১৯ সালের পর থেকে প্রতিবছর শীতকালে, ভারত পেয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলেই বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজ নিয়ে অস্বাভাবিক অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়।
পেঁয়াজ কথন
বিশ্ব্যব্যাপি সর্বাধিক ব্যবহৃত মশলার মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। এর বৈজ্ঞানিক নাম Allium Cepa। খাবারের স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি, বিভিন্ন ঔষধি গুণাগুণের কারণেও পেঁয়াজের ব্যবহার হয়ে থাকে। পেঁয়াজে ভিটামিন এ, বি, সি, ই, পটাশিয়াম, আয়রন, সালফার, অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। এলিসিন নামক একটি উপাদানের কারণে পেঁয়াজ ঝাঁজালো হয়। এই উপাদানটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম থাকে ২০ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে। কিন্তু বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় এই খাদ্রপণ্যটি দাম প্রায় আড়াইশ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। অতীতে সামাজিক মাধ্যমে, কেজির বদলে হালি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করার মত বিষয়ও ভাইরাল হয়েছে।
বাংলাদেশে পেঁয়াজের বাজার মূলত চারটি ধাপে বিভক্ত। প্রথম ধাপে আমাদানিকারকরা পেঁয়াজ বিদেশ থেকে নিয়ে আসে। পরের ধাপে আড়তদাররা সেগুলো খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। এবং সবশেষে কাঁচা বাজার বা সাধারণ মুদি দোকান থেকে ভোক্তারা পেয়াজ কেনে। প্রতিটি হাত বদলের সময় পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশে পেঁয়াজ চাষ
বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষ দেশ হল চীন ও ভারত। পেঁয়াজ উৎপাদনের বাংলাদেশ বরাবরাই শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে থাকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় পাবনা এবং ফরিদপুরে। বাংলাদেশে সাধারণত তিন ধরনের পেঁয়াজ চাষ করা হয়। এগুলো হল ১. বাল্ব পেঁয়াজ ২. বারি পেঁয়াজ-৫ এবং ৩. দেশীয় জাতের মুড়িকাটা পেঁয়াজ। বাল্ব পেয়াজের মধ্যে বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-৪ এবং লালতীর কিং জাতের পেয়াজ সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। এবং গ্রীষ্মকালীন বারি পেঁয়াজ-৫ চাষ হয় অল্প পরিমাণে। এরকম নানা জাতের পেঁয়াজ আবাদ করেও দেশের চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে পেঁয়াজ নিয়ে সঠিক গবেষণা, সম্প্রসারণ, পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবকে দায়ী করছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশে সরকারি হিসেবেই চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের পেঁয়াজের চাহিদা ২৭ থেকে ২৮ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৪ লাখ ৬০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিগত ১০-১১ বছরে পেঁয়াজ উৎপাদিত জমির পরিমাণ ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হল, পেঁয়াজ উৎপাদনের পর শুকিয়ে যায়। এর ফলে প্রায় ১০ থেকে ১২ শতাংশ ওজন কমে যায়। তাছাড়া প্রতিবছর উৎপাদিত পেঁয়াজের অন্তত ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ ১০ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ার কারণে মোট উৎপাদন থেকে কমে নিট উৎপাদন দাঁড়ায় প্রায় ২২ থেকে ২৩ লাখ টন। ঘাটতি পূরণ করতে, বাকি পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, পেঁয়াজ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা গেলে আমদানি করার প্রয়োজন হবে না।
ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা
ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ রপ্তানিকারক দেশ। আর বাংলাদেশ সবেচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি কারক দেশ। যেসব ভোগ্যপণ্যের জন্য বাংলাদেশের ভোক্তারা ভারতের উপর অধিক নির্ভরশীল তার মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। গত কয়েক বছরে একাধিকবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়।
চলতি বছর অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে ভারতের বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে আসায়, দাম অনেক বেড়ে যায়। প্রথমে পেঁয়াজ রপ্তানি নিরুৎসাহিত করার জন্য, আগে যেখানে এক টন পেঁয়াজের মূল্য ছিল ২০০ থেকে ৩০০ ডলার, সেখানে একলাফে একটন পেঁয়াজের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৮০০ ডলার। সেই অতিরিক্ত মূল্যেই ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে আবারো বন্যা হবার কারণে, চার মাসের জন্য পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছে ভারত সরকার। আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভারত কোনো পেঁয়াজ রফতানি করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে।
পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ফলে শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের বাজারেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ভারতের মহারাষ্ট্রের নাসিকে পেঁয়াজের সব থেকে বড় পাইকারি বাজার রয়েছে। এখানে প্রতিদিন প্রায় হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আসত। কয়েকদিন আগেও কৃষকরা এক কুইন্টাল বা ১০০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করতেন চার হাজার রুপিতে। কিন্তু রপ্তানি বন্ধ হবার পর থেকে কৃষকরা এক কুইন্টাল পেঁয়াজের দাম পাচ্ছেন মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার রুপি।
ভারতের ব্যবসায়ীরাও পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের প্রতিবাদ করছে। তাদের মতে হুট করে রপ্তানি বন্ধ করে ভারত সরকার কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের চরম ক্ষতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ন
বাংলাদেশে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের খবর আসার প্রায় সাথে সাথে দাম প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায়। এজন্য তাৎক্ষণিকভাবে পেঁয়াজের সঙ্কট নয়, ব্যবসায়ীদের ঘৃন্য মুনাফালোভী মনোভাবই দায়ী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ ৬৪ হাজার টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। সে হিসেবে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলেও, দেশে পেঁয়াজের সঙ্কট থাকার কথা নয়। চাহিদার অতিরিক্ত পেঁয়াজ থাকা সত্তেও, কৃত্রিম সঙ্কট তৈরী করে দাম বাড়ানোর কাজ করছে দেশের বড় বড় আড়ৎদাররা।
দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি ব্যবসার কেন্দ্র চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের। এবং ঢাকার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার হল শ্যামবাজার। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মতে, খাতুনগঞ্জ এবং শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটই মূলত সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী। তাদেরকে আবার উসকে দিয়েছে আমদানিকারকদের সিন্ডিকেট। পরবর্তীতে সকল পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের মধ্যে অতি মুনাফার প্রবণতা তৈরী হয়। এর ফলে কেজিতে ১০০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট থেকে লুট করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা।
শুধু তাই নয়, ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আসার আগে কেনা পেঁয়াজ নতুন করে দেশে প্রবেশ করছে। কিন্তু কালোবাজারী ব্যবসায়ীরা ৯০ টাকা কেজি দরে কেনা সেসব পেঁয়াজের দাম ১৪০ টাকা পর্যন্ত দেখাচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা তাদের নৈরাজ্যকে কাগজে কলমে বৈধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
সমাধানের উপায়
ভারতে নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর, বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ করে দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের বাজারে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছিল। তখন গরুর মাংসের দাম এক লাফে কেজি প্রতি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা হয়ে যায়। পরবর্তী দুই বছর কোরবানীর ঈদের সময়ও তীব্র পশু সঙ্কট দেখা দেয়। সেই সংকটের কারণে কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে অনেক গরুর খামার গড়ে উঠে। এবং গত দুই বছর ধরে কোরবানির পশুর জন্য বাংলাদেশ ভারতের উপর নির্ভরশীল হওয়া তো দূরের কথা; বাংলাদেশ কোরবানীর পশুর জন্য শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়; বরং কোরবানীর পরও বহু পশু উদ্বৃত্ত থেকে যায়।
তারমানে ভারতীয় গরু প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য আর্শিবাদ হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঠিক একইভাবে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে, পেঁয়াজ উৎপাদনেও স্বংয়সম্পূর্ণতা লাভ করা সম্ভব।
ভারত সহ প্রচুর বিদেশী পেঁয়াজ আমদানির কারণে দেশের কৃষকরা নায্য দাম পায় না। বাংলাদেশের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পেঁয়াজের ক্ষেত্রে কেজি প্রতি ১০-১২ টাকা পায়। ভারত থেকে পেঁয়াজ না আসলে বাংলাদেশের কৃষকরা প্রতি কেজি পেঁয়াজে ৩০-৩২ টাকা পেতে পারত। কৃষকরা যদি পেঁয়াজের ভালো দাম পায়, তাহলে পরবর্তী বছর আরো বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন করতে তারা আগ্রহী হবে। কৃষকদের জন্য ভালো ও উন্নত বীজ সরবরাহ করা গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে। কৃষিবিদরা মনে করেন, বিদেশী পেঁয়াজ দেশে প্রবেশ বন্ধ হলে, সারা বছরই পেঁয়াজের দাম একটু বেশি হবে। সেক্ষেত্রে পেঁয়াজের দাম বছরজুড়ে হয়ত ৪০ থেকে ৪৫ টাকা থাকবে, কিন্তু কখনই আড়াইশ টাকা হবে না।
বাংলাদেশের পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্তা অর্জনের জন্য, অরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে, আর তা হল পেঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। দেশীয় পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করার কারণে উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩০ শতাংশই পঁচে যায়। পেঁয়াজ ভালোভাবে সংরক্ষণ করার জন্য মাইনাস ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার দরকার। কিন্তু কোল্ড স্টোরেজে এই তাপমাত্রা অর্জন করাটা বেশ সময় এব ব্যয় সাপেক্ষ। তাছাড়া যেসব অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়, সেখানে পের্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজই নেই। এর সামধানে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, দেশীয় পদ্ধতির উন্নতি সাধন করে বেশ কিছু কার্যকরী পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার তৈরী করেছে। যদিও এসব অবকাঠামো প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য; তবে ক্রমান্বয়ে চেষ্টা করে গেলে ভবিষ্যতে নিশ্চই দেশের সকল অঞ্চলে খুব সস্তায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যাবে। এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশে পেঁয়ান নিয়ে নৈরাজ্য বন্ধ করা সম্ভব হবে।