পাকিস্তান কীভাবে পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে উঠল
পাকিস্তান কীভাবে পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে উঠল
ভূমিকা
সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল ইরানের পারমানবিক সক্ষমতা ধ্বংস করার জন্য ১২ দিনের যুদ্ধ নামে পরিচিত ভয়াবহ আগ্রাসন চালায়। তবে কোন মুসলিম দেশের পারমানবিক স্থাপনা ধ্বংসের চেষ্টা ইসরায়েলের জন্য এটিই প্রথম নয়। অতীতেও ইসরায়েল ভারতে সহায়তায় বিশ্বের একমাত্র পারমানবিক শক্তিধর মুসলিম দেশ পাকিস্তানের পারমানবিক সক্ষমতা ধ্বংস করার বহু চেষ্টা করেছে।
পাকিস্তানের পারমানবিক কর্মসূচির সূচনা
১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের Atoms for Peace কর্মসূচির অধীনে পাকিস্তান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের পরিকল্পনা, যার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা কিছুটা কমানো। এর আওতায় দেশগুলোকে বোমা তৈরি না করার শর্তে বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি উন্নয়নে সহায়তা দেওয়া হতো।
সেসময় পাকিস্তান ৩৭ জন বিজ্ঞানীকে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষিত করে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় পারমাণবিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে। তারপর ১৯৬১ সালে পাকিস্তান লাহোরে নিজেদের প্রথম পারমানবিক গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলে। তার মাত্র দুই বছর পর ইসলামাবাদের কাছেই একটি ছোট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও তৈরি করা হয়।
তবে এরপর পরই শুরু হয় ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। সেসময় পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করত যুুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকা থেকে কেনা মার্কিন অস্ত্র ভারতের বিপক্ষে ব্যবহার করার জন্য, যুক্তরাষ্ট পাকিস্তানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তখন পাকিস্তান কূটনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর নতুন মিত্র দেশের সন্ধান করতে থাকে। আর তখন থেকেই চীনের সাথে পাকিস্তানের শুরু হয় কৌশলগত বন্ধুত্ব।
প্রজেক্ট ৭০৬
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় থেকেই ভারত গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করেছিল। সেসময় জুলফিকার আলি ভুট্টো বলেন, “যদি তাদের কাছে বোমা থাকে, তাহলে আমাদেরও থাকতে হবে। এমনকি প্রয়োজনে ঘাস খেয়ে বাঁচব।”
সেসময় চীনের সহায়তা, প্রযুক্তিগত ধারণা বা নেপথ্যের সহযোগিতা পাকিস্তানের পারমানবিক কর্মসূচিকে ত্বরান্বিত করে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলদেশ গড়ে ওঠার পর, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নিয়ে পাকিস্তানের ভাবনা আরও জোড়ালো হয়ে উঠে।
১৯৭৪ সালে ভারত “স্মাইলিং বুদ্ধ” নামে তাদের প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালায়। পাকিস্তান এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা দাবি করে। কিন্তু তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে সেই বাস্তবতা মেনে নেওয়ার পরামর্শ দেয়।
এরপর জুলফিকার আলি ভুট্টো মুলতানে এক গোপন বৈঠক ডাকেন। সেখানে শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী ও আমলাদের ডেকে পাকিস্তানকে পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নের শপথ করান। এ গোপন কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় “প্রজেক্ট ৭০৬”, যাকে পাকিস্তানের নিজস্ব ম্যানহাটন প্রজেক্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম যে পারমানবিক বোমা তৈরী করেছিল, সেই গোপন প্রকল্পের নাম ছিল প্রজেক্ট ম্যানহাটন।
খান ফ্যাক্টর
পাকিস্তানের এমন ক্রান্তিলগ্নে পারমানবিক প্রকল্পের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন আব্দুল কাদির খান। তিনি একজন পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি ইউরোপীয় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রতিষ্ঠান URENCO-তে কাজ করছিলেন। ১৯৭৪ সালে আব্দুল কাদির খান নিজে থেকেই পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করার জন্য ভুট্টোকে প্রস্তাব দেন।
এ কিউ খান পরবর্তীতে তার লেখা একটি বইতে বলেছিলেন,“যদি খ্রিস্টান বিশ্ব বোমা রাখতে পারে, যদি ইহুদিরা বোমা রাখতে পারে, হিন্দুরাও বোমা রাখতে পারে, কমিউনিস্টরাও বোমা রাখতে পারে, তাহলে কেন মুসলিম দেশ বোমা রাখতে পারবে না?”
তাঁর সেই আদর্শিক জায়গা থেকেই নেদারল্যান্ডস থেকে তিনি পাকিস্তানে ফিরে আসার সময় ইউরোপের সেন্ট্রিফিউজ ডিজাইন চুরি করে নিয়ে আসেন। এটি পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়।
ড. খান রাজধানীর কাছেই এক শান্ত-নিরিবিলি শহর কাহুটায় একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ গবেষণাগার স্থাপন করেন। এখান থেকেই পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি নতুন দিগন্তে প্রবেশ করে।
ইউরোপ থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনতে এ কিউ খান, একটি ছদ্মবেশী মাখন কারখানা খোলেন। এই মাখন কম্পানির আড়ালেই তিনি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ওয়াশিং মেশিন, ও প্রিসিশন ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রপাতি আমদানি করে দেশে নিয়ে আসেন।
১৯৭৭ সালে ভুট্টো একটি অভ্যুত্থানে মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়। ভুট্টোর পর পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসে জেনারেল জিয়া উল হক। তিনি আব্দুল কাদির খান কে ভুট্টোর চেয়েও অনেক বেশি সহযোগীতা করতে থাকেন।
শেষ পর্যন্ত সেই অপারেশন বাটার ফ্যাকটরির মতো কৌশল এবং সরকারী গোপন সহয়োগীতাই পাকিস্তানকে একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হতে সহায়তা করে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইসরায়েল ও ভারতের পরিকল্পনা
জার্মানীর একটি গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে পাকিস্তানের পারমানবিক সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টার বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। পাকিস্তান যেন কোন পারমানবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালাতে না পারে, সেকারণে ভারতের সহায়তায় ইসরায়েল পাকিস্তানের কাহুদায় (Cahuta) সামরিক হামলার পরিকল্পনা করছিল।
ইসরায়েল সবসময়ই সাবধান ছিল যে, কোন একটি মুসলিম দেশের হাতে পারমানবিক বোমা থাকলে, তা ইসরায়েলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সেসময় একটি ধারনা প্রচলিত ছিল যে, ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনের পর থেকে সকল মুসলিম দেশ গোপনে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সমর্থন করে আসছিল।
তবে পাকিস্তানের তৎকালীন জেনারেল জিয়ার উল হকের শাসনামলে, পাকিস্তান বারাবরই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরীর বিষয়টি অস্বীকার করেছে। কিন্তু ১৯৮৩ সালের মার্চে পাকিস্তান তাদের প্রথম পারমাণবিক ডিভাইসের পরীক্ষা চালায়। এর পরপরই ইসলামাবাদ তাদের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি প্রকাশ্যে আনে।
তখন ইসরায়েল ও ভারত পাকিস্তানের পারমাবিক সক্ষমতা ধ্বংসের জন্য আরো উঠেপড়ে লাগে। এই যৌথ অভিযানের নামকরণ করা হয়েছিল অপারেশন কাহুদা (Operation Cahuda)। সেসময় ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমান ভারতীয় বিমানঘাঁটি থেকে কাশ্মীরের উপর দিয়ে গিয়ে হামলার পরিকল্পনা করছিল। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে এই পরিকল্পনায় অনুমোদন দিলেও, পরে তা বাতিল করে দেন। পরবর্তীতে তার ছেলে রাজীব গান্ধি ক্ষমতায় আসার পর সংযম বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
পরবর্তীতে ১৯৮৬ থেকে ৮৭ সালের মধ্যে ভারত একটি বিশাল সামরিক মহড়া চালায়, যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন ব্রাস ট্যাক্স (Operation Brass Tax)। এতে প্রায় আট লক্ষ সৈন্য ও ভারী ট্যাংক পাকিস্তানের সীমানার কাছে মোতায়েন করা হয়। প্রথমদিকে ইসলামাবাদ একে সরাসরি যুদ্ধের ইঙ্গিত মনে করলেও, পরবর্তীতে বড় ধরনের কোন সংঘাত ঘটেনি।
চূড়ান্ত পরীক্ষা
১৯৯৮ সালে পাকিস্তান আরও পাঁচটি পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। আর সেসব পরীক্ষার মধ্য দিয়েই পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে একটি পারমানবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে। তখন আবারো খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ভারতীয় বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে ইসরায়েল পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর জবাবে ইসলামাবাদ নিজস্ব ধারাবাহিক পরীক্ষা চালিয়ে পারমাণবিক প্রতিরোধ শক্তি প্রতিষ্ঠা করে। এতে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্যই পাল্টে যায়নি, বরং বিশ্বশান্তির সমীকরণও অনেকটাই বদলে যায়।
তবে ২০০০ সালের শুরুতে পাকিস্তানের পারমানবিক বোমা নিয়ে নতুন বিতর্ক এবং নিষেধাজ্ঞার সূচনা হয়। তখন এ.কিউ. খান-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তিনি ইরান, উত্তর কোরিয়া ও লিবিয়ার কাছে পারমাণবিক গোপন তথ্য বিক্রি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ এ.কিউ. খান কে গৃহবন্দি করে। এবং জাতীয় টেলিভিশনে কে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু ২০০৭ সালে পারভেজ মুশাররফ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এ.কিউ. খানের বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়। পাকিস্তানের পারমানবিক বোমার প্রান পুরুষ আব্দুল কাদির খান ২০২১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
পাকিস্তানে সক্ষমতা
বিশ্লেষকের মতে পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা না থাকলে, দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও পর্যন্ত অসংখ্য ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ হতে পারত। পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র এই অঞ্চলের বহু যুদ্ধকে ঠেকিয়ে দিয়েছে।
পারমানবিক সক্ষমতা অর্জনের যাত্রায়, পাকিস্তানকে বহু চাপে ফেলার চেষ্টা করা হলেও, তারা কখনও পিছু হটেনি। এমনকি পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব টিকেই আছে মূলত এই সর্বোচ্চ শক্তির কারণে। আর সেটিই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ভারতের উপযুক্ত পাল্টা জবাব দেওয়ার আত্মবিশ্বাস যোগায়।
ইসরায়েল যেভাবে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর নির্বিচারে বোমা বর্ষণ সহ অনায়াসে আগ্রাসন চালাতে পারে, ভারতও তার প্রতিবেশীদের সাথে, বিশেষ করে পাকিস্তানের সাথে ঠিক একই আচরন করতে চায়। কিন্তু তারা জানে পাকিস্তানের হাতে আছে ‘চূড়ান্ত অস্ত্র’। আর সেকারণেই ভারত সবসময় পাকিস্তানের সাথে সর্বোচ্চ সংঘাত এড়িয়ে চলে।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যেও পারমানবিক অস্ত্র তৈরীর জন্য, সৌদি আরব পাকিস্তাকে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা দিয়ে গেছে। কথিত আছে যে, নিষেধাজ্ঞা জনিত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে, সৌদি আরব পাকিস্তানকে প্রতিদিন বিনামূল্যে প্রায় ৫০ হাজার ব্যারেল তেল দিয়েছে।