পাকিস্তানে ইমরান খানের পতন হল কেন
পাকিস্তানে ইমরান খানের পতন হল কেন
সাম্প্রতিক সময়ে ইমরান খানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের রজনীতিতে বেশ টালমাটাল অবস্থা যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে, দেশটিতে সেই অর্থে কখনও রাজনৈতিক স্থিরতাই আসেনি। কারণ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও পাকিস্তানের কোন সরকার তার পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। দেশটির রাজনীতিতে সাপ লুডু খেলার মত, এক দলেকে আরেক দলের টেনে হিচড়ে ক্ষমতাচূত করার সংস্কৃতি বেশ পুরনো।
ইমরান খানের আবির্ভাব
পাকিস্তানে দুটি রাজনৈতক দল সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল। একটি হল পাকিস্তান পিপল পার্টি এবং আরেকটি হল পাকিস্তান মুসলিম লীগ। এই দুটি দলই বিভিন্ন মেয়াদে পালাক্রমে পাকিস্তানের ক্ষমতায় এসেছে। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ইমরান খান একটি আলাদা রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার দলের নাম পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফ, সংক্ষেপে পিটিআই। পাকিস্তানের নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের বিকাশ, মুক্ত চিন্তার বিকাশ এবং ধর্মীয় বৈষম্যের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে এই দলটি যাত্রা শুরু করে। তবে ইমরান খানের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল দুর্নীতি বিরোধী শ্লোগান দিয়ে। ১৯৯৭ সালে ইমরান খান দটি কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে দাড়ালেও দুটিতেই গেরে যান। তবুও তিনি থেমে যাননি। এরপর ২০০২ সালের নির্বাচনে তিনি জয়ী হন। ২০০৭ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ মোশারফ সেনা প্রধানের পদে থেকেই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। সেকারণে নির্বাচনের বিরোধিতা করে ইমরান খান ৮৫ জন পার্লামেন্ট সদস্য কে নিয়ে পদত্যাগ করেন। সেবারের নির্বাচনে পারভেজ মোশারফ প্রেসিডেন্ট হয়ে পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা জারি করে। তখন ইমরান খান কিছুদিন গৃহবন্দী থাকেন এবং কিছুদিন তাকে কারাবন্দী থাকতে হয়। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের ১০ম নির্বাচনে ইমরান খানের দল পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আসন জেতে। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরান খানের দল আসন সংখ্যার বিচারে পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ দলে পরিণত হয়। এর আগে পাকিস্তানে অন্য কোন দল এত ভোট পায়নি। ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট, পাকিস্তান ক্রিকেটের সাবেক অধিনায়ক, বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু পাকিস্তানের অন্যান্য প্রধানমন্ত্রীদের মত তিনিও তার ক্ষমতার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারলেন না। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল ইমরান খানের বিরোধীরা জাতীয় পরিষদে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে। যেখানে ১৭৪ ভোটে পরাজিত হয়ে, ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অপসারিত হন।
ইমরান খানের নাটকীয় পতন
জনগণের ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা সত্ত্বেও ইমরান খান কে কেন গদি ছাড়তে হল? এর কারণ হল পাকিস্তানের সংসদে ইমরান খান তার সংখ্যা গরিষ্ঠতা হারিয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসার জন্য একক ভাবে যে পরিমাণ আসন দরকার ছিল, সেই পরিমাণ আসন কোন রাজনৈতিক দলই পায় নি। তাই ইমরান খানের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলগুলো একটি জোট তৈরী করে, সরকার গঠন করে। পাকিস্তানের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়ই এরকম জোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। পরবর্তীতে কোন এক বা একাধিক দল জোট থেকে বেরিয়ে আসলে, সরকার গঠনে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল এবং সরকার প্রধান সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হরায়। ইমরান খানের বেলায়ও ঠিক তেমনটিই ঘটেছে। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শাহরাজ শরীফ এবং বিলওয়াল ভুট্টো জোট বদ্ধ অন্যান্য দলগুলোকে ইমরান খানের বিরুদ্ধে উসকে দেয়। পরবর্তীতে তারা একত্রিত হয়ে ইমরান খানের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব আনে। প্রথমে প্রস্তাবটিকে সংবিধান সম্মত নয় আখ্যা দিয়ে, পাকিস্তানের ডেপুটি স্পিকার এই অনাস্তা প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। এরপর ইমরান খানে অনুরোধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। এরপর পাকিস্তানের আদালত, পার্লামেন্ট পুর্নবহাল করে অনাস্থা ভোট গ্রহণের নির্দেশ দেয়। এরপর অনেক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধান মন্ত্রীর পদ হারায় ইমরান খান। এরপর পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিরোধী দলীয় নেতা শাহবাজ শরীফ পাকিস্তানের ২৩ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তার শপথ গ্রহনও হয় কিছুটা অস্বাভাবিক পরিস্তিতিতে। রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথ গ্রহণ করলেও, শাহবাজ শরীফের শপথ গ্রহণের সময় রাষ্ট্রপতি আরিফ আলভি উপস্থিত ছিলেন না।
ইমরান খানের পতনের শুরু যেভাবে
পাকিস্তানের দুর্নীতি মোকাবেলা করা এবং দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৮ সালে ইমরান খান ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তার শাসন আমলে পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকায় এবং বিদেশি দেনার বোঝা আকাশচুম্বী হওয়ার কারণে, দেশটির অর্থনীতিতে সংকট দেখা দেয়। পাকিস্তানের জীবন যাত্রার মান এবং খাদ্য দ্রব্যের দাম অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানী রুপির দামও অনেক কমে যায়। ইমরান সমর্থকরা বলেন, মহামারির কারণে সমগ্র পৃথিবীতেই জিনিস পত্রের দাম উর্দ্ধমুখী। কিন্তু প্রকৃত পক্ষেই প্রতিবেশী দেশে গুলোর তুলনায় পাকিস্তানের জীবন যাত্রার ব্যায় অনেক বেড়ে গিয়েছে। এসব কারণে ইমরান খানের সমর্থন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। ইমরান খানের পতনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ইমরান খান ক্ষমতায় এসেছিলেন। সেকারণে সমালোচকরা ইমরান খানের শাসনকালকে ‘হাইব্রিড; সরকার বলে আখ্যা দিয়ে এসেছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে ইমরান খান ও সেনাবাহিনীর সেই সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে। এটি ইমরান খানের অনেক বড় রাজনৈতিক দুর্বলতা হিসেবে দেখা দেয়। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন বর্তমান সংকটের শুরু হয়, যখন ইমরান খান পাকিস্তানের প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর নতুন গোয়েন্দা প্রধানের নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের বিষয়টি নিয়ে সরকারের সাথে সেনাবাহিনীর জোড়ালো দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এছাড়াও ইমরান খানের বেশ কিছু রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের কারণেও তিনি জনগণের মাঝে আস্থা হারান। যেমন, পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি একজন অজ্ঞ রাজনীতিবিদকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও সেখানে কোন যোগ্য লোককে নিয়োগ দেননি তিনি। ক্ষমতা হারালেও পাকিস্তানের জনগণের বিরাট অংশের মধ্যে এখনো ইমরান খানের জনপ্রিয়তা আছে। ইমরান সরকার পতনের পর থেকে পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় তার সমর্থকেরা সমাবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করলেও, পাকিস্তানের অর্তনীতি এখনও পর্যন্ত ভালো কোন ভালো জায়গায় পৌছাতে পারেনি। কারণ এই দীর্ঘ সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো সুযোগ পেলেই একে অপরকে টেনে হিচড়ে ক্ষমতাচূত করেছে। একটি দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য সুস্থ্য রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত জরুরী। কিন্ত পাকিস্তানে সেই পরিবেশ কখনও সৃষ্টি হয়নি। কোন সরকার তার পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় টিকতে না পারার কারণে, তাদের মতাদর্শ এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী দীর্ঘ মেয়াদী কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এছাড়া দেশটির সেনাবাহিনীর সাথে সাধারণ জনগণের একটা বৈরী ভাব রয়েছে। সুযোগ পেলেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করে। অতীতে সাতবার সামরিক অভ্যূত্থান ঘটেছে, যার মধ্যে চারবার সামরিক বাহিনী দেশটির ক্ষমতা দখলে নিতে সক্ষম হয়েছে। পাকিস্তানের অভ্যুদয় থেকে শুরু করে প্রায় অর্ধেক সময় দেশটির সেনাবাহিনী সরাসরি দেশ শাসন করেছে। দীর্ঘ সময় সেনা শাসন কোন দেশের পক্ষেই মঙ্গল জনক নয়। সেনা শাসনের কারনে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়া থেকে শুরু করে, কোন দেশ দেউলিয়াও পতে পারে।