নীরব ঘাতক মাইক্রো প্লাস্টিক

maxresdefault (34)
জীবনযাপন

নীরব ঘাতক মাইক্রো প্লাস্টিক

প্লাস্টিক সর্বপ্রথম আবিষ্কার করা হয়েছিল ১৮৫০ সালে। আলেকজান্ডার পার্ক নামের এক জন বিজ্ঞানী প্লাস্টিক আবিষ্কার করেছিলেন, তাই প্রথম দিকে প্লাস্টিক এর নাম ছিল পার্কজাইন। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৮৩০ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক উৎপাদন করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬৩০ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক সরাসরি আবর্জনায় পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবীতে উৎপাদিত প্লাস্টিকের প্রায় ৮০ শতাংশই বর্জ্য হিসেবে রয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর প্রায় ৮০ লক্ষ টন প্লাস্টিকের আবর্জনা নদী-নালা, খাল-বিল হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। এখন পর্যন্ত যত প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরী হয়েছে, তার সব যদি এক জায়গায় জড়ো করা হয়, তবে সেই আবর্জনার স্তূপ পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চেয়েও উচু হবে। প্লাস্টিক আবর্জনারই সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ হল, মাইক্রো প্লাস্টিক। আমাদের নিত্যব্যবহার্য জিনিস পত্র থেকে মাইক্রো প্লাস্টিক আমাদের শরীরে এবং রক্তে প্রবেশ করে। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে মায়ের বুকের দুধেও মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। নীরব ঘাতক মাইক্রো প্লাস্টি মানব সভ্যতাকে এক নজির বিহীন হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

মানব সভ্যতার নীরব ঘাতক মাইক্রো প্লাস্টিক !

মাইক্রো প্লাস্টিক হল প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রতম কণা। সাধারণত ৫ মিলিমিটারের ছোট আকারের প্লাস্টিক কে মাইক্রো প্লাস্টিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ ১ ইঞ্চির প্রায় ৫ ভাগ ছোট আকৃতির প্লাস্টিক কণাকে মাইক্রো প্লাস্টিক বলা হয়। তবে মানব স্বাস্থের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মাইক্রো প্লাস্টিকগুলো আরো অনেক ছোট হয়। এমন সব অতি ক্ষুদ্র মাইক্রো প্লাস্টিক আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে যা খালি চোখে দেখাও যায় না। আমাদের সভ্যতা অনেকাংশেই প্লাস্টিক নির্ভর হয়ে পড়েছে। বর্তমানে প্লাস্টিক ছাড়া আপনি চলতেই পারবেন না। দিনের শুরু থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত আমরা প্লাস্টিকের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করি। যেখানেই যাবেন, সেখানেই প্লাস্টিক। পানির বোতলগুলো সব প্লাস্টিকের, আমাদের বাজারের ব্যাগ প্লাস্টিকের, হোটেল রেস্তোরার খাবার প্লাস্টিকের পাত্রে পার্সেল দেওয়া হয়, নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার থেকে শুরু করে মুখোরোচক সকল খাবারের প্যাকেট প্লাস্টিকের। প্রতিদিন সকালে ব্যবহার করা টুথপেস্ট থেকে শুরু করে ফেসওয়াশ, বডিওয়াশ, নেইলপলিশের মত প্রসাধনী, এবং ডিটারজেন্ট পাউডারেও মাইক্রো প্লাস্টিক থাকে। এর বাইরেও বিভিন্ন ধরনের খাবারের মাধ্যমে মাইক্রো প্লাস্টিক আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। বর্তমানে প্রায় ৫১ ট্রিলিয়ন মাইক্রো প্লাস্টিক সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে। সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্য সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে ভেঙে মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হয়। সমুদ্রের অতিক্ষুদ্র প্রাণীগুলো এসব মাইক্রো প্লাস্টিক খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। এরপর ধীরে ধীরে বড় থেকে বড় মাছগুলো সেই সব ছোট মাছগুলোকে খায়। এক পর্যায়ে খাদ্যশৃঙ্খলের ধারাবাহিকতায় সেই সব মাইক্রো প্লাস্টিক মানবশরীরেও চলে আসে। এত এত প্রাণীর দেহ ঘুরে মানুষের শরীরে আসলেও, কোন প্রানীর পাকস্থলিতেই মাইক্রো প্লাস্টিক হজম হয় না। সামুদ্রিক প্রাণী ছাড়াও, সামুদ্রিক পাখিদের পেটেও যাচ্ছে মাইক্রো প্লাস্টিক। প্লাস্টিক বা মাইক্রো প্লাস্টিক অনেক প্রাণীর গলায় আটকেও মারা যায়। ২০১৮ সালে স্পেনের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় একটি মৃত তিমি ভেসে এসেছিল, সেই তিমির পেটে প্রায় ৩২ কেজি প্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছিল। বিশেষ কতকগুলো জায়গায় অধিক হারে মাইক্রো প্লাস্টিক পাওয়া যায়। সেই জায়গাগুলোর মধ্যে স্পেনের উপকূল, চীনের ইয়াংজি নদী, গ্রেট অস্ট্রেলিয়ান বাইট, মারিয়ানা ট্রেঞ্চে এবং যুক্তরাজ্যের হ্রদ ও নদী গুলো উল্লেখযোগ্য।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সারাদিন ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বিভিন্ন উপকরণ থেকে মাইক্রো প্লাস্টিক মানুষের রক্তে মিশে যাচ্ছে। এছাড়া আমাদের ফুসফুসেও অনেক মাইক্রো প্লাস্টিক রয়েছে। যা মানুষের শরীর থেকে নিঃশেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। মানুষের শরীরে যত মাইক্রো প্লাস্টিক পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হল পিইটি প্লাস্টিক। সাধারণত পানির বোতলগুলো এই ধরনের প্লাস্টিক দিয়ে তৈরী করা হয়। এরপরেই পলিস্টেরিন জাতীয় প্লাস্টিক মানব শরীরে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। সাধারণত খাদ্য পণ্য এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্যাকেজিং করতে এ ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়। এবং মানব রক্তের পাওয়ার অন্যতম আরেক ধরনের প্লাস্টিক হল পলিথিন। এই উপাদান আমরা সবাই চিনি, পলিথিন দিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগ বানানো হয়। বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক এমন সব রাসায়নিক নিঃসরণ করে, যার এস্ট্রোজেনিক এক্টিভিটি আছে। অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা মানব শরীরে প্রবেশ করে এস্ট্রোজেন হরমোনের মত কাজ করা শুরু করে। এই বিষয়টিই এস্ট্রোজেনিক এক্টিভিটি হিসেবে পরিচিত। বেশিরভাগ প্লাস্টিক সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসার পর এস্ট্রোজেনিক এক্টিভিটি তৈরী হয়। আমেরিকার ৯২ শতাংশের বেশি মানুষের শরীরে এই ধরনের ক্ষতিকারক লক্ষণ দেখা গেছে। ১১ বছরের কম বয়সী শিশুদের দেহে এই ক্ষতির মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া মানব দেহে থাকা মাইক্রো প্লাস্টিকের উপর বিভিন্ন ক্ষতিকর অনুজীব বাসা বাঁধার সুযোগ পায়। মাইক্রো প্লাস্টিক আমাদের শরীরে থাকা হরমোনের নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। এছাড়া মাইক্রো প্লাস্টিক ক্যান্সারের ঝুকি বাড়িয়ে দেয়। মাইক্রো প্লাস্টিক দুষণ একেবারেই নতুন একটি বিষয়, তাই এ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এখনও হয়নি। সেকারণে এই ক্ষতিকর উপাদান মানব শরীরের জন্য কী কী ধরনের হুমকি নিয়ে আসতে পারে, তার সঠিক ধারণা করা মুশকিল। তবে প্লাস্টিক প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে যে, ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, তা থেকেই বোঝা যায়, এই উপাদান মানব শরীরে কেমন ক্ষতি করতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের দুই দল গবেষক, বাংলাদেশের খাবার লবণ এবং চিনি নিয়ে পৃথক দুটি গবেষনা করেছেন। দেশের নামকরা ১০ টি ব্র্যান্ডের লবণসহ স্থানীয় দোকান থেকে খোলা লবণের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা চালানো হয়। প্যাকেটজাত এবং খোলা উভয় লবণেই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক রয়েছে। প্রতি কেজি সামুদ্রিক লবণে ৩৯০ থেকে ৭ হাজার ৪০০ আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের মাত্রা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। বঙ্গোপসাগর থেকে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা খাবার লবণে পলিস্টেরিন, ইথিলিন-ভিনাইল অ্যাসিটেট, পলিথিলিন, নাইলন, পলিথিলিন টেরেপথ্যালেেেটর মত প্লাস্টিক উপাদান পাওয়া গেছে। আরেকটি গবেষণায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চিনি ও টি ব্যাগে আশঙ্কাজনক মাত্রায় ক্ষতিকর মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি মেলে। শুধু মাত্র চিনির মাধ্যমেই, প্রতিবছর বাংলাদেশের মানুষের শরীরে, গড়ে ১০ টনেরও বেশি মাইক্রো প্লাস্টিকের কণা প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া ৫টি ব্র্যান্ডের টি ব্যাগের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, পলিটেট্রা ফ্লুরো ইথিলিন, হাই ডেনসিটি পলিথিলিন, পলিকার্বোনেট, পলিভিনাইল ক্লোরাইড, নাইলন, ইথিলিন ভিনাইল এসিটেট, সেলুলোজ এসিটেট, এবিএস প্রভৃতি প্লাস্টিক কণা রয়েছে। শুধু মাত্র তিনটি ভোগ্য পণ্যেই এই অবস্থা। বাজারের সকল খাদ্য পণ্য নিয়ে গবেষণা করলে, কেমন ভয়াবহ চিত্র উঠে আসবে, তা সহজেই অনুমেয়। এসব খাদ্য পণ্য থেকে এত ভয়াবহ মাত্রায় মাইক্রো প্লাস্টিক আমাদের রক্তে মিশে যাচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে মায়ের দুধেও মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বিশ্বের সকল প্লাস্টিক পণ্যের ৮০ শতাংশই বর্জ্য হিসেবে প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণ করছে। এছাড়া ১২ শতাংশ প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলা হয়, সেটিও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এবং বাকি মাত্র ৮ শতাংশ প্লাস্টিক পণ্য রিসাইকেল করা হয়। ২০১৪ সালে জতিসংঘ পরিবশে সম্মেলনে, প্লাস্টিক দুষণকে শীর্ষ ১০ পরিবশেগত সমস্যার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মাইক্রো প্লাস্টিক সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণে, ২০১৫ সালের জতিসংঘ পরিবশে সম্মেলনে, মাইক্রো প্লাস্টিক গবেষণাকে দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেহেতু প্লাস্টিক ছাড়া আমাদের চলেই না। তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হল, এমন উন্নত ধরনের প্লাস্টিক উৎপাদন করতে হবে, যা থেকে মাইক্রো প্লাস্টিক দূষণ কম হয়। এছাড়া প্লাস্টিক পণ্যের রিসাইক্লিংয়ের উপর জোড় দিতে হবে। মাইক্রো প্লাস্টিক দূষণ লোকচক্ষুর অন্তরালে ভয়ংকর গতিতে এগিয়ে চলছে। তাই এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। একবার ব্যবহার করার মত প্লাস্টিক পণ্য বর্জন করতে হবে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।