নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে এত বিতর্ক কেন
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে এত বিতর্ক কেন
বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কয়েকটি শ্রেণীতে নতুন কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যসূচি ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পরিবেশে পড়ানোর পাশাপাশি, সৃজনশীলতা এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি শেখাতেই এই শিক্ষাক্রম চালু করা হচ্ছে।
কিন্তু শিক্ষাক্রমের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষক সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। দেশের শিক্ষবিদদের মধ্যেও কেউ কেউ এর পক্ষে আবার অনেকেই নতুন কারিকুলামের বিপক্ষে মত দিয়েছেন।
নতুন শিক্ষাক্রম
১৮৮২ সালে Sir William Wilson Hunter এর নেতৃতে উপমহাদেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গড়ে উঠেছিল; যা হান্টার কমিশন নামে পরিচিতি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। সেই কমিশন ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন নামে বেশি পরিচিত। এরপর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নে আরো বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদের নেতৃত্বে ৬টি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ এর মাধ্যমে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২২ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে ৬২ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন কারিকুলামের পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশের মূল ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৪ সাল থেকে এই পদ্ধতি ২য়, ৩য়, ৮ম ও ৯ম এবং ২০২৫ সালে এটি ৪র্থ, ৫ম ও ১০ম শ্রেণিতে চালু হবে। পর্যায়ক্রমে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে উচ্চমাধ্যমিকেও এই পদ্ধতি চালু হবে।
মুখস্ত নির্ভর পড়াশোনা এবং যেকোন উপায়ে শুধুমাত্র ভালো রেজাল্ট করার প্রবণতা হ্রাস করে, শিক্ষার্থীদেরকে সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন করানোর জন্যই নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের করা হয়েছে বলে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
নতুন সংযোজন
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরের আগে শিশুদের জন্য কোন বই থাকবে না। নার্সারী এবং প্লে গ্রুপ হিসেবে পরিচিত এসব শ্রেণীর বাচ্চাদেরকে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরাই সরাসরি শেখাবেন। এরপর প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদেরকে মাত্র তিনটি বই পড়ানো হবে। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের কোনও পরীক্ষা নেওয়া হবে না। এক্ষেত্রে সারা বছর শিক্ষকরা তাদেরকে যা শেখাবেন, তার উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। তৃতীয় শ্রেণীর উপরের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা রাখা হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রেও শ্রেণীকক্ষে শেখার সময়ই শিক্ষার্থীদের ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন করা হবে। পরীক্ষা ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের যাচাইয়ের এই পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে, ধারাবাহিক শিখনকালীন মূল্যায়ন। শিক্ষার্থীদের যোগাযোগের দক্ষতা, উপস্থাপন, ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট বা বাড়ির কাজসহ বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে।
বাংলাদেশের নতুন শিক্ষাক্রমে, পাঠ্যক্রমও আর আগের মত থাকছে না। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের মত মৌলিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি আরো ১০ টি বিষয়ে যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া হবে। বিষয়গুলো হল: ১. ভাষা ও যোগাযোগ ২. গণিত ও যুক্তি ৩. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ৪. ডিজিটাল প্রযুক্তি ৫. পরিবেশ ও জলবায়ু ৬. সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব ৭. জীবন ও জীবিকা ৮. ধর্ম, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ৯. শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা ১০. শিল্প ও সংস্কৃতি।
বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের মত মৌলিক বিষয়গুলোতে ৬০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে; এবং ৪০ শতাংশের জন্য পরীক্ষা নেওয়া হবে। জীবন ও জীবিকা, তথ্যপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির মত বাকি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে। অর্থাৎ এই বিষয়গুলোর জন্য কোন পরীক্ষা থাকবে না।
নতুন শিক্ষাক্রমের একটি বড় পরিবর্তন হল, শিক্ষার্থীদের এখন থেকে নবম ও দশম শ্রেণিতে অভিন্ন সিলেবাসে পড়ানো হবে। তারমানে নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান, মানবিক এবং বানিজ্য শাখার মত আলাদা বিভাগ পছন্দ করার আর কোন সুযোগ নেই। সকল শিক্ষার্থী একই বিষয় পড়বে। একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য এই তিন বিভাগে ভাগ হবে৷ এখান থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো বিভাগ বেছে নিতে পারবেন। এছাড়া নতুন পাঠক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন থেকে শুধুমাত্র দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি অনুসারে অভিন্ন দশটি বিষয়ের ওপর এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে।
একইভাবে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ধরনেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার পরিবর্তে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দু’টি আলাদা পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ন করে এইচএসসি’র চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হবে। উচ্চ মাধ্যমিকের আবশ্যিক বিষয়গুলোর জন্য ৩০ শতাংশ এবং প্রায়োগিক বা ঐচ্ছিক বিষয়গুলোর জন্য শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
পরিবর্তন সমূহ
বাংলাদেশে এতদিন যে শিক্ষাক্রম চালু ছিল, মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সেটিতে পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে সেই জায়গা থেকে সরে আসা হয়েছে। এখন পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর শিখনকালীন মূল্যায়ন বা ধারাবাহিক মূল্যায়নকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আগে যেখানে প্রথম শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হতো, সেখানে এখন প্রাথমিক স্তরে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পরীক্ষা থাকছে না। এছাড়া চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষার পাশাপাশি ধারাবাহিক মূল্যায়নের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে আবশ্যিক বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয়ভাবে আগে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী (পিইসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হত। কিন্তু এসব পরীক্ষা এখন আর থাকছে না। বরং শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানেই পরীক্ষা নেওয়ার পাশাপাশি ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে এবং সে অনুযায়ী সনদ দেওয়া হবে।
আগে নবম শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের মধ্য থেকে পছন্দমতো যেকোনও একটি বিভাগ বেছে নিতে পারতো। কিন্তু এখন দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সবাইকে একটি অভিন্ন সিলেবাসে পড়ানো হবে। এক্ষেত্রে নবম ও দশম শ্রেণির বই আলাদা হবে এবং কেবল দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের উপরে ভিত্তি করেই এসএসসি ও সমমানের পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে।
একই ভাবে এইচএসসি পরীক্ষাতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আগে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি পড়ার পর একটি বোর্ড পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে ফলাফল প্রকাশ করা হতো। সেটি পরিবর্তন করে এখন একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দু’টি আলাদা পরীক্ষা নেওয়া হবে। এরপর দুই পরীক্ষা ও শিখনকালীন মূল্যায়নের সমন্বয় করে এইচএসসির ফলাফল প্রকাশ করা হবে।
বিতর্ক কেন?
নতুন শিক্ষাক্রমকে অনেকে আধুনিক এবং যুগোপযোগী হিসেবে স্বাগত জানালেও, অনেকেই বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে এই শিক্ষাক্রমের বিরোধীতা করছেন। কারিকুলাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাধারণত আগের কারিকুলামের ১০ থেকে ২০% পরিবর্তন করার কথা বলা হয়। কিন্তু, নতুন শিক্ষাক্রমে পূর্বের প্রায় সম্পূর্ণ কাঠামোই বদলে ফেলা হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায়, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের উপর জোড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখনও অধিকাংশ শিক্ষককেই ট্রেনিং দেওয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষকরা বলছেন, তারা কিছুটা ট্রেনিং পেলেও, যেভাবে পরিবর্তন আনা হয়েছে, হুট করে তার সাথে তাল মেলানো সবার পক্ষেই কঠিন। তাছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে যেহেতু ব্যাপকহারে ধারাবাহিক শিখনকালীন মূল্যায়ন চালু করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে অধিকাংশ নম্বরই রয়েছে শিক্ষকদের হাতে। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকদের স্বজনপ্রীতি বা অবমূল্যায়নের শিকার হবার আশঙ্কা করছেন অভিভাবকরা। তাছাড়া যেকোন শিক্ষা কার্যক্রমে ২৫ শতাংশের বেশি শিখনকালীন নম্বর থাকা উচিত নয় বলে মনে করছেন গবেষকেরা।
শিক্ষাবিদদের অনেকে মনে করছেন, নতুন শিক্ষাক্রম ভালো হলেও, একে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাস্তবায়ন করাটা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। এবং বর্তমান শিক্ষা অবকাঠামো এই ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত নয়। কারণ বাংলাদেশে এমনিতেই শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তাবায়ন করতে স্বাভাবিক ভাবেই আরো বেশি দক্ষ শিক্ষকের দরকার হবে। আর যারা ইতোমধ্যে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকতা করছেন, তাদের অধিকাংশই নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পড়ানোর জন্য প্রস্তুত নন।
নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক বিষয় বাড়ির কাজ বা দলীয় কাজ হিসেবে দেওয়া হয়েছে, সেসব বিষয় সকল শিক্ষার্থী নিজেরাই করছে কিনা তা নিশ্চিত করা মুশকিল। অভিভাবকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হয়েছে যে, নতুন শিক্ষা কার্যক্রমে ইন্টারনেট ভিত্তিক ডিভাইস ব্যবহার করার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই শিক্ষাকার্যক্রম বর্হিভূত সাইটগুলোতে সময় কাটাচ্ছে। তাছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরীক্ষা না থাকায়, পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরো বেশি পরীক্ষাভীতি কাজ করতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ফিনল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া সহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের কারিকুলাম দেখেই, নতুন শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সাথে খাপ খাওয়াতে গেলে, বাংলাদেশেও এই ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিকল্প নেই।