দেশের কোন মেগা প্রকল্পে কত খরচ হল
দেশের কোন মেগা প্রকল্পে কত খরচ হল
মেগা প্রকল্প কি
২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পর্যায়ক্রমে বহু মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যে প্রকল্পে অনেক বড় রকমের বিনিয়োগের দরকার হয়, এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে নানা ধরনের জটিলতার সম্ভাবনা থাকে সে ধরনের প্রকল্পকেই মেগাপ্রকল্প বলা হয়। তবে মেগাপ্রকল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই প্রকল্প থেকে অর্থনীতি, সমাজ এবং পরিবেশের উপর দীর্ঘেমেয়াদে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে হবে। তা না হলে, মেগাপ্রকল্প আর্শিবাদের বদলে, অভিশাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশের দশটি অগ্রাধিকার প্রকল্প সহ প্রধান ১২ টি মেগাপ্রকল্পে প্রায় ৫ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে। সংশোধিত হিসেবে এই পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।
বাংলাদেশের মেগা প্রকল্প
বাংলাদেশের সকল মেগাপ্রকল্পগুলোকে মোটাদাগে ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন: ১. সড়ক ও পরিবহণ অবকাঠামো প্রকল্প ২. বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন প্রকল্প এবং ৩. বন্দর নির্মাণ প্রকল্প।
এসব প্রকল্পের বেশ কয়েকটির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আওয়ামীলীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষের দিকে এবং সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিগত কয়েক মাসে নিয়মিত এসব প্রকল্পের অনেকগুলো উদ্বোধনও করা হয়েছে। কিছু কিছু প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ শেষ না হলেও, আংশিক উদ্বোধন করা হয়েছে। সম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার আগেই, উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি স্বাভাবিক বিষয়। প্রথমে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়েছিল রেল যোগাযোগ ছাড়া। মেট্রোরেল চালু করা হয়েছিল, অর্ধেক পথ পর্যন্ত। যদিও পরবর্তীতে পদ্মা সেতুতে রেল যোগাযোগ এবং মেট্রোরেলের আগারগাঁও অংশ চালু হওয়ার পর এই দুটি উন্নয়ন প্রকল্প পূর্ণতা পেয়েছে। এর বাইরে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসেওয়ে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনালও আংশিক উদ্বোধন করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু
পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মান করার মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ টি জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। সেই সাথে পদ্মা সেতু জাতীয় অর্থনীতিতে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
শুরুতে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করতে আগ্রহ দেখিয়েছিল। ২০১১ সালে এ প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তিও স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে ২০১২ সালে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনায় পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর প্রাথমিক কাজ শুরু হয়।
২০০৭ সালে একনেকে পাস হওয়া নকশায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালের নকশায় সেতুতে রেল লাইন সংযুক্ত করার ফলে, ব্যয় বাড়িয়ে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা করা হয়। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। তারপর আরো কয়েক দফা প্রকল্পের সময় বৃদ্ধির পর ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা।
২০১৮ সালে পদ্মাসেতু ও এর দুই প্রান্তে রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন বসানোর পাশাপাশি স্টেশন ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করে। পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়া রেল প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের অর্থায়ন করছে চীন।
ঢাকা মেট্রো রেল
রাজধানী ঢাকা শহরের পরিবহণ খাতের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হল ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প। বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কাউন্সিল, একনেক ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্প অনুমোদন করে। এরপর ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়।
মেট্রোরেলের প্রথম রুট উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। তারপর মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার লাইন সম্প্রসারণ করার কারণে এর ব্যয় আরো ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। ব্যয় বাড়ানোর পর সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রোরেলের প্রথম লাইনটি নির্মাণ করতে প্রায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে আরো পাঁচটি মেট্রোরেল তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে এমআরটি লাইন-১ এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এবং এমআরটি লাইন ৫ এর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। এমআরটি লাইন-১ ই হবে দেশের প্রথম পাতালরেল। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত অংশটি মাটির নিচ দিয়ে গড়ে তোলা হবে। এবং বসুন্ধরা থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত অংশটি হবে উড়ালপথে। পাতাল রেল সহ এই অংশটির নির্মান ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকা। হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত এমআরটি লাইন ৫ এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। তারমানে ঢাকা মেট্রোর প্রধান তিনটি লাইন নির্মান করতেই প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে।
কর্ণফুলী টানেল
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ। শুধু তাই নয় এটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে কোন নদীর তলদেশের নির্মিত প্রথম সড়ক সুড়ঙ্গ।
কর্ণফুলী নদীর ১৫০ ফুট গভীরে সুড়ঙ্গটি নির্মান করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কিলোমিটার। তবে সুড়ঙ্গ ছাড়াও এই প্রকল্পের অধীনে ৫ কিলোমিটারের বেশি সংযোগ সড়ক এবং ৭২৭ মিটার দীর্ঘ একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে।
সুড়ঙ্গ নির্মানের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। পরবর্তীতে তা বেড়ে হয় ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। কিন্তু নির্মাণ সম্পন্ন করতে মোট ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লক্ষ টাকা। তবে সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী টানেলের মোট ব্যয় ১১ হাজার কোটি টাকার ছাড়িয়ে যেতে পারে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার ব্যয় করেছে ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। বাকি ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা চীনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
বাংলাদেশের চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুরু হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী এলাকায় গিয়ে এই উড়াল পথটি শেষ হবে। ঢাকার বাইরের গাড়িগুলোকে বাইপাস করে শহর পার করে দেওয়া এবং রাজধানীর যানজট নিরসনের উদ্দেশ্য নিয়ে ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ নির্মাণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে হল ঢাকা-মাওয়া-ভাঙা এক্সপ্রেসওয়ে। তবে সেই এক্সপ্রেসওয়েটি সাধারণ রাস্তার মত ভূমির সমতলেই ছিল। কিন্তু এক্সপ্রেসওয়েকে যখন পিলারের সাহায্যে মাটি থেকে উপরে নির্মাণ করা হয়, তখন তাকে বলে এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। সে হিসেবে এই এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে খরচ হয়েছে ১৯১ কোটি টাকারও বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক।
কক্সবাজার রেল সংযোগ
বাংলাদেশে জনপ্রিয় পর্যটন শহর কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রামের দোহাজারি পর্যন্ত রেললাইন ছিল। এই প্রকল্পের অধীনে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি রেলওয়ে সংযোগ স্থাপন হবে।
কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।
গত অগাস্ট মাসের শুরুতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিপাত এবং পাহাড়ি ঢলে রেললাইনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পানিতে ডুবে নষ্ট হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পে নকশাগত ত্রুটি থাকার অভিযোগ করেন।
রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের একক বৃহত্তম প্রকল্প। এখনও পর্যন্ত বাস্তবায়িত হওয়া দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প ধরা হয় পদ্মা সেতুকে। কিন্তু এই পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে এটিই হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প। কারণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের বাজেট ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকা। যেখানে পদ্মা সেতুর বাজেট ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা। তারমানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানে যত টাকা খরচ হবে, তা দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু বানানো যাবে।
বাংলাদেশের সর্বকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই প্রকল্পে, কয়েক বছর আগে নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য বহুতল ভবন নির্মান করা হয়। এসব ভবনের ফ্ল্যাটগুলোর জন্য ১ হাজার ৩২০টি বালিশ কেনা হয়েছিল, যার প্রতিটি বালিশের মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় ছয় হাজার টাকা। এছাড়া একেকটি বালিশ নিচ থেকে উপরে তোলার জন্য ৭৬০ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এর প্রতিবাদে অনেকেই বিক্ষোভ করে, বিষয়টিকে ‘ইতিহাসের সেরা লুট’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত ১০ টি মেগা প্রকল্পের একটি। কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নের ১ হাজার ৪১৪ একর জমির উপর মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক নাম, মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট। কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের দ্বারা পরিবেশ ক্ষয়-ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য যে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তাকে বলে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি।
এখানে ৬০০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরী করা হবে। ফলে এর মোট উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট।
সরকারী তথ্যমতে, এই প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের ৮৩ শতাংশ দিয়েছে জাপানী সহায়তা সংস্থা জাইকা। জাইকার কাছ থেকে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার দিয়েছে ৬ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এবং ১ হাজার ৫২৭ কাটি টাকা প্রকল্পের নিজস্ব অর্থায়ন রয়েছে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর
মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা আনার জন্য এখানে কয়লাবাহী জাহাজ ভেড়ানোর একটি জেটি স্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সেই জেটিকে সম্প্রসারণ করে পূর্ণাঙ্গ একটি বানিজ্যিক বন্দর নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়। বাংলাদেশের প্রধান দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা ৯ মিটারের কম গভীর। সেকারণে এসব বন্দরে বেশি কন্টেইনার বাহী বড় জাহাজ সরাসরি বন্দরে ভিড়তে পারে না। মাতারবাড়ি বন্দরের গভীরতা ১৬ মিটার। এখানে ৮ হাজারের বেশি কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের দুটি অংশে বিভক্ত। এর একটি হলো মূল বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং অপর অংশটি বন্দরে যাতায়াতের জন্য সড়ক নির্মাণ প্রকল্প। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মানের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল বন্দর নির্মাণ করতে খরচ হবে ৮ হাজার ৯৫৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা এবং সড়ক নির্মাণ করতে খরচ হবে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার পায়রায় পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এই বিদ্যুৎ কন্দ্রটিও আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরী করা হয়েছে। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৬৬০ মেগাওয়াট এর মোট ২টি ইউনিট নির্মাণ করা হয়েছে, যার ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে এটি বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ কেন্দ্র। ২০১৭ সালে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। ২০২২ সালে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে সময় আর ব্যয় বৃদ্ধি করা যেখানে স্বাভাবিক একটি বিষয়। সেখানে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পূর্ণ বিপরীত। নির্ধারিত সময়ের আগেই এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মানের জন্য যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, তার চেয়েও কম অর্থ এখানে খরচ হয়েছে। অথচ এই প্রকল্পটি সরকারের ১০ অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকায়ও ছিল না।
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৯ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে প্রকল্প ব্যয় এবং সময় না বাড়িয়ে, উল্টো টাকা সাশ্রয় করার এটি এক অনন্য নজির।
পায়রা বন্দর
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশে আরেকটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণেরও পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই সমুদ্র বন্দর প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে এটিই বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বন্দর নির্মাণ প্রকল্প হওয়ার কথা। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ৫ বছর কাজও করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নানা কারণে পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। এর প্রধান কারণ হল, এই বন্দরের জন্য রাবনাবাদ চ্যানেল হিসেবে পরিচিত প্রায় ৬৫ কিলোমিটার নৌপথ খনন করতে হবে, এবং ভবিষ্যতে নিয়মিত এই পথ রক্ষণাবেক্ষন করতে বিপুল পরিমাণ খরচ হবে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় দেখা যায়, রাবনাবাদ চ্যানেলের ৪০ কোটি ঘনমিটার বালিমাটি অপসারণ করতে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। অথচ মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর এবং চট্টগ্রামের বে টার্মিনাল নির্মানের মোট ব্যয় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। তারমানে পায়রার বালু উত্তোলনের চেয়ে দশ হাজার কোটি টাকা কম খরচে আলাদা দুটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা যায়। নির্মাণ খরচের বাইরেও আরো বেশ কিছু ভূরাজনৈতিক কারণে পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। তবে এখানে চট্টগ্রাম এবং মোংলার মত একটি সাধারণ সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হবে।
বে টার্মিনাল
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বন্দরকে গভীর সমুদ্রবন্দরের মত কার্যক্ষম করতে, চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা ও হালিশহর সমুদ্র উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায়, বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল।
২০১৮ সালে প্রকল্পটি উদ্বোধন করার সময় ধারণা করা হয়েছিল ২০২১ সালেই বন্দরটি চালু করা যাবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এর নির্মাণ কাজে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে সম্মত বিনিয়োগকারী না পাওয়ায় প্রকল্পটির নির্মাণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।
প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল নির্মানের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরে নির্মাণ সামগ্রীর ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পের সামগ্রিক ব্যয় বাড়বে বলে জানিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কারিগরি এবং যাত্রীসেবার অসুবিধা দূর করতে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ যাত্রী দেশের প্রধান বিমান বন্দরটি ব্যবহার করে। নতুন এই টার্মিনালের মাধ্যমে বছরে অতিরিক্ত ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকা। আর বাকি ৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
মোট ব্যয়
বাংলাদেশের চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবগুলো যেহেতু শেষ হয়নি, তাই সকল মেগা প্রকল্পের জন্য ঠিক কত টাকা দরকার তার সঠিক হিসেব বের করাটা মুশকিল। তবে বাতিল হওয়া পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর বাদে বাকি প্রকল্পগুলোর জন্য মোট প্রায় ৪ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোরেলের নির্মাণাধীণ দুটি লাইনের নির্মাণের ব্যয় অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। লাইন দুটির নির্মাণ কাজ যেহেতু শেষ হয়নি, তাই এসব প্রকল্পে কত টাকা লাগবে তা আগে থেকেই বলা যাচ্ছে না। এসব মেগাপ্রকল্পের বাইরেও দেশে বহু উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে। সে হিসেবে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৫ লক্ষ কোটি টাকারও অনেক বেশি অর্থ খরচ হয়েছে।