ঢাকা মেট্রোরেল

maxresdefault (18)
জীবনযাপন

ঢাকা মেট্রোরেল

রাজধানী ঢাকা শহরের জনভোগান্তির সবচেয়ে বড় উপাদান পরিবহণ খাত। পরিবহণ খাতের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হল ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প। এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক নাম ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট, যা সংক্ষেপে এমআরটি নামে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মেগাপ্রকল্প গুলোর মধ্যে অন্যতম। ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড বা উগঞঈখ নামে একটি সরকারী মালিকানাধীন কম্পানি গঠন করা হয়েছে। মেট্রোরেলের কয়েকটি ভাগ রয়েছে। প্রথমদিকে এটি উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত নির্মান করা হচ্ছে। প্রথম ধাপ শেষ করতে খরচ হবে মোট ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বিমান বন্দর থেকে কমলাপুর এবং পূর্বাচল থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত পাতাল রেল সহ নির্মান ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে হেমায়েতপুর থেকে ভাটার পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মানের খরচ হবে ৪১ হাজার কোটি টাকা। তারমানে এই তিনটি লাইন নির্মান করতেই প্রায় এক লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। এর বাইরেও মেট্রোরেলের আরো বেশ কয়েকটি লাইন নির্মানের পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে যাতায়াতের ব্যবস্থা সহজ হলে, এই শহরে বসবাসের ভোগান্তি অনেকটাই কমে আসবে। ইতোমধ্যে উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে।

ঢাকা মেট্রোরেল | কি কেন কিভাবে

২০১২ সালের ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বা মেট্রো রেল প্রকল্প অনুমোদন লাভ করে। ঢাকা এবং ঢাকার আশেপাশের এলাকা থেকে যাতায়াত সহজ করতে মেট্রোরেলকে বেশ কয়েকটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। তবে প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত অংশটি নির্বাচন করা হয়। এরপরই বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত পাতাল রেল এবং নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল টার্মিনাল পর্যন্ত উড়াল পথের সমন্বয়ে আরেকটি রুটের নির্মান কাজ চলমান রয়েছে। ৩১.২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথ ২০২৬ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবার কথা। এরপরই আছে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত উড়াল পথ এবং পাতাল রেলের সমন্বয়ে আরেকটি এমআরটি প্রকল্প। এর দৈর্ঘ্য হবে ২০ কিলোমিটার, যা ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ করা কথা। এছাড়া গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত উড়াল এবং পাতাল রেলের সমন্বয়ে ১৭.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি রুট ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মিত হবে। একই সময়ের মধ্যে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পাতাল ও উড়াল রেল প্রকল্প পরিকল্পনাধীন রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে কমলাপুর থেকে নারায়নগঞ্জের মধ্যেও ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি মেট্রোরেল নির্মান করা হবে। প্রকল্পের নির্ধারিত সময় না বাড়লে, ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকাবাসী শহরের যে কোন প্রান্ত থেকে সহজে যাতায়াত করতে পারবে বলে, আশা করা যায়।
মেট্রোরেলের প্রথম পর্যায়, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়। এই অংশটির নাম এমআরটি লাইন ৬, যা প্রায় ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ। ধারণা করা হচ্ছে, মেট্রোরেলের প্রথম ধাপ চালু হলে, প্রতিঘন্টায় ৬০ হাজার যাত্রী এতে যাতায়াত করতে পারবে। ২০১৬ সালের ২৬ জুন এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল। এই রুটের প্রাথমিক নকশা অনুযায়ী ১৬টি স্টেশন থাকার কথা। স্টেশনগুলো হল – উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্ট্রাল, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় এবং মতিঝিল। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। কিন্তু পরবর্তীতে পরিকল্পনাকারীদের মাথায় আসে, এই লাইনকে মতিঝিলে শেষ না করে, কমলাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত করা সম্ভব। কমলাপুর সহ এমআরটি লাইন-৬ এর স্টেশন সংখ্যা দাড়াবে ১৭ টি। বাংলাদেশের অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্পই কেন জানি সংশোধনী বাজেট ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বরাবরের মতই এমআরটি প্রকল্পেরও সংশোধনী প্রস্তাব সড়ক পরিবহন বিভাগে পাঠানো হয়। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত এমআরটি লাইনের দৈর্ঘ্য ১.১৬ কিলোমিটার। অতিরিক্ত এই অংশ নির্মানের খরচ ধরা হয় ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে প্রকল্পের মোট বাজেট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। তারমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রেলপথ তৈরী করতে খরচ হচ্ছে ২২ হাজার কোটি টাকা। আর মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মাত্র ১ কিলোমিটার তৈরীতে খরচ হবে ১১ হাজার কোটি টাকা। কর্তৃপক্ষ বলছে, বাড়তি কাজ বাস্তবায়নসহ অন্যান্য বিভিন্ন খাতের কারণেও প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে। তবে ঢাকা মেট্রোরেলের এমআরটি লাইন ৬ একসাথে পুরোটা চালু করা যাবে না। এই প্রকল্পের উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার অংশের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এই রুটে মেট্রোরেলের নিয়মিত পরীক্ষামূলক কার্যক্রমও চলছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরেই মেট্রোরেলের এই অংশের উদ্বোধন করা হবে। এই লাইনের বাকি অংশের কাজও পুরোদমে চলছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত লাইনের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ার জন্য, পুরো প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে আরও প্রায় এক বছর বেশি সময় লাগবে। ধারনা করা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে মেট্রোরেলের প্রথম ধাপের সম্পূর্ণ প্রকল্পটি শেষ করতে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।
ঢাকা মেট্রোরেলের বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর এবং নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত অংশটি এমআরটি লাইন ১ হিসেবে পরিচিত। এটিও দেশের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফাস্টট্রাক বা অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্প। এই লাইন দুটি অংশে বিভক্ত। একটি হল বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রুট এবং নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল রুট। বিমানবন্দর রুটের দৈর্ঘ্য ১৯.৮৭ কিলোমিটার। এই পথে ১২ টি পাতাল স্টেশন থাকবে। পাতাল স্টেশনগুলো হল, কমলাপুর, রাজারবাগ, মালিবাগ, রামপুরা, হাতিরঝিল পূর্ব, বাড্ডা, উত্তর বাড্ডা, নতুন বাজার, নদ্দা, খিলখেত, বিমানবন্দর টার্মিনাল ৩ এবং বিমানবন্দর। এই রুটেই বাংলাদেশে প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল বা পাতাল রেল চালু হতে যাচ্ছে। যদিও ঢাকা পাতালরেল বা উযধশধ ঝঁনধিু নামে আরেকটি ভুগর্ভস্থ রেল নেটওয়ার্কের পরিকল্পনা আছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ঢাকা সাবওয়ের পরিকল্পনা করেছে। মেট্রোরেলের পাতালরেল আর ঢাকা সাবওয়ে দুটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ আলাদা অলাদা প্রকল্প। তবে ভবিষ্যতে কোন এক সময় এই দুই রুট একক গণপরিবহণ ব্যবস্থা হিসেবে পরিচালিত হবে। এমআরটি লাইন ১ এর পূর্বাচল রুটের দৈর্ঘ্য ১১.৩৬ কিলোমিটার। এই অংশে থাকবে উড়াল পথ, যেখানে স্টেশন থাকবে ৯টি। এখানকার নতুন বাজার এবং নদ্দা স্টেশনটি থাকবে পাতাল পথে। উড়াল পথের বাকি ৭টি স্টেশন হল জোয়ার সাহারা, বোয়ালিয়া, মস্তুল, শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, পূর্বাচল সেন্ট্রাল, পূর্বাচল পূর্ব, এবং পূর্বাচল টার্মিনাল। পরবর্তীতে অন্যান্য এমআরটি লাইনগুলো নির্মান সম্পন্ন হলে, বেশ কয়েকটি স্টেশনের মধ্যে ইন্টারচেঞ্জ তৈরী হবে। ইন্টারচেঞ্জ স্টেশনের মাধ্যমে এক রুট থেকে অন্য রুটে সহজেই যাতায়াত করা যাবে। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম পাতালরেল নির্মানে শব্দহীন টানেল বোরিং মেশিন ব্যবহার করা হবে। বিমানবন্দর রুটে মাটির উপর থেকে ১০ মিটার গভীরে পাশাপাশি দুটি সুরঙ্গ তৈরী করা হবে। মালিবাগ থেকে রাজারবাগ এলাকায় সড়কের প্রশস্ততা কম হওয়ায়, এবং ফ্লাইওভারের পাইল থাকায় দুটি টানেল পাশাপাশি নির্মান না করে, উপর নিচে করে তৈরী করা হবে। একটি টানেল মাটিরর উপর থেকে ১০ মিটার এবং আরেকটি ৩০ মিটার গভীরে নির্মান করা হবে। ২৫ সেট মেট্রো ট্রেন দিয়ে এই পথে যাত্রা শুরু হবে। প্রতিসেট মেট্রো ট্রেনে ৮টি কোচ থাকবে। দূর নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য থাকবে বিশেষায়িত অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার। মেট্রোরেল সম্পূর্ন বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত হবে। সেজন্য মেট্রোরেলের নিজস্ব বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা সহ একাধিক উৎস থেকে বিদ্যুৎ সংগ্রহ করা হবে। ট্রেন চালানোর জন্য ঘণ্টায় ১৩.৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দরকার হবে। উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁ এবং বাংলা একাডেমি এলাকার পাঁচটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থেকে এসব বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। প্রতিবার টিকেট কাটার ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে, এমআরটি পাস এবং র‌্যাপিড পাস ব্যবহার করে যাত্রীরা সহজে যাতায়াত করতে পারবে।
মেট্রোরেলের মতই বাংলাদেশের আরেকটি মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের বাজেট ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকা। যদিও মেট্রোরেলের প্রথম তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতেই প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার মত খরচ হবে। সম্পূর্ণ মেট্রোরেল প্রকল্প শেষ করতে এরচেয়ে বহুগুণ বেশি অর্থ খরচ হবে। তবে মেট্রোরেলের প্রতিটি অংশ আলাদা আলাদা ভাবে তৈরী করার কারণে এটি একক প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।