ট্রাম্প কেন পুতিন কে বন্ধু বানাচ্ছে

maxresdefault (3)
জীবনযাপন

ট্রাম্প কেন পুতিন কে বন্ধু বানাচ্ছে

ভূমিকা

আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।

শুধু তাই নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট যখন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার জন্য হোয়াইট হাউসে হাজির হয়েছিল, তখন ট্রাম্প সকল কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করে ভ্লাদিমির জেলেনস্কিকে রীতিমত অপমান করে হোয়াইট হাউজ থেকে বের করে দিয়েছে। যার সূত্রপাত হয়েছিল জেলেনস্কি পুতিন সম্পর্কে কটু কথা বলা থেকে।

ট্রাম্পের এই আচরণে শুধু ইউক্রেন নয়, ইউরোপ, আমেরিকা সহ পুরা বিশ্ব বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে। তারপর থেকেই বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি প্রশ্নই বারবার উঠছে; আর তা হল – ট্রাম্প কেন যুক্তরাষ্ট্রের জাত শত্রু পুতিনকে বন্ধু বানাতে চায়?

ট্রাম্প কেন পুতিনকে বন্ধু বানাতে চায় ?

তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সম্ভবনা

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই ইউক্রেন এবং গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করার বিষয়ে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে আসছিল। বর্তমানে আমেরিকান ও রাশিয়ান কূটনীতিকদের ইউক্রেন শান্তিচুক্তির অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় নি। তবে এই আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র এবার ইউক্রেনে সহায়তা করা বন্ধ করছে।

ভ্লাদিমির পুতিন যেখানে মাত্র সপ্তাহের ব্যবধানে সমগ্র ইউক্রেন দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল, সেখানে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর সহায়তার কারণে দীর্ঘ ৩ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ হয়নি।

বিগত তিন বছরের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়েই ইউক্রেনের যুদ্ধ সবচেয়ে বিপদজনক পর্যায় চলে গেছে। ২০২৪ এর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে রাশিয়ান ভূখণ্ডের ভেতরে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেয়। তারপর ইউক্রেন আমেরিকার তৈরী ATACMS ও ব্রিটিশদের তৈরী Storm Shadow ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।

এসব হামলার পর পুতিন বুঝতে পারে যে NATO-র কারিগরি সহায়তা ছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে এসব জটিল অস্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব নয়। আর এসব অস্ত্র ব্যবহার করা মানেই NATO সরাসরি রাশিয়ায় হামলা চালাচ্ছে।

এর জবাবে ২০২৪ এর নভেম্বরেই রাশিয়া নতুন একটি পারমাণবিক নীতি প্রকাশ করে, যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের শর্ত শিথিল করে বলা হয়, এখন থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের মত পারমানবিক শক্তি বিহীন দেশেও পারমানবিক হামলা চালাতে পারবে। এবং তার পরপরই ইউক্রেনকে হুশিয়ার করতে তাদের এক সামরিক ঘাঁটিতে পারমাণবিক ওয়ারহেড ছাড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে রাশিয়া। এরপর ২০২৫ এর ফেব্রুয়ারিতেও রাশিয়া একটি ড্রোন দিয়ে সাবেক চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এতে চেরনোবিলের রেডিয়েশন শিল্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদিও তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর প্রমাণ মেলেনি।

এইসব ঘটনা পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাব্য ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে, তাই যুদ্ধবিরতির আলোচনা এখন অত্যন্ত জরুরি। সেকারণে হোয়াইট হাউজের সাক্ষাতে জেলেনস্কি যখন শান্তিচুক্তির প্রতি অনমনীয় মনোভাব পোষণ করে, তখন ট্রাম্প তাকে বলে আপনি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছেন।

শান্তিচুক্তি ও ট্রাম্পের রাজনীতি

মার্কিন কংগ্রেস ইউক্রেনের জন্য মোট ১৮০ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৫ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার সহায়তা অনুমোদন করেছে। সেকারণে জেলেনস্কির প্রতিবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ট্রাম্প মোটেও সহ্য করছিলেন না।

ট্রাম্প তার অভিষেক ভাষণেই বলেছিলেন, তিনি শান্তি এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে সুনাম অর্জন করতে চান। সেকারণে ট্রাম্প তড়িঘড়ি করে পুতিনের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করতে চাইছেন। এই চুক্তির আওতায় ইউক্রেনকে নিজের ভূখণ্ড, সম্পদ ও সার্বভৌমত্ব রাশিয়াকে দিয়ে দিতে হবে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে ট্রাম্প রাশিয়াকে এত সুবিধা দিতে চাইছে কেন? ট্রাম্পের এই কৌশলের পেছনে মূল কারণ হল চীনকে থামানো। ট্রাম্পের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি রাশিয়া ও চীনের মধ্যে বিদ্যমান কৌশলগত মৈত্রিতা ভাঙতে চান। তার ভাষায়, “আপনি কখনোই চাইবেন না রাশিয়া আর চীন একজোট হোক।” ইউক্রেনে রাশিয়াকে সুবিধা দেওয়ারবিনিময়ে ট্রাম্প চাইছেন, পুতিন যেন চীনের বিপক্ষে গিয়ে আমেরিকার সাথে একজোট হয়।

ধারণাটি বেশ অস্বাভাবিক মন হল, এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মোটেও নতুন কৌশল নয়। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সত্তরের দশকে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কে একঘরে করতে, চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছিলেন। এবার ট্রাম্প রাশিয়াকে পাশে টেনে চীনকে কোনঠাসা করতে চাইছে।

ট্রাম্পের এই “ডিভাইড অ্যান্ড কনকোয়ার” বা বিভাজন ও দখলের কৌশল বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকরা সন্দিহান। কারণ সত্তরের দশকে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তীব্র বিরোধে ছিল। কিন্তু বর্তমানে রাশিয়া ও চীন আদর্শিকভাবে এক না হলেও, আমেরিকার আধিপত্যের বিরুদ্ধে দুই দেশেরই ঘৃণা রয়েছে এবং পারস্পরিক স্বার্থে তারা একত্রে কাজ করছে।

২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে চীন হয়ে ওঠে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ভরসা। গত দুই বছরে রাশিয়ার ৪০% আমদানি এসেছে চীন থেকে, আর রপ্তানির ৩০% গেছে চীনে। তাছাড়া চীন ও রাশিয়ার যৌথ সামরিক মহড়া, প্রযুক্তি আদান-প্রদান এবং কৌশলগত সহযোগিতা সাম্প্রতিক সময়ে এক নতুন উচ্চতায় পৌছেছে।

ট্রাম্প পুতিনকে কি দিবে?

ট্রাম্প যদি সত্যিই রাশিয়াকে চীনের বিপক্ষে নিতে যেতে চায়, তবে ট্রাম্পকে এমন কিছু দিতে হবে, যা পুতিন চীনের কাছ থেকে পাচ্ছে না। তাই ট্রাম্পের প্রস্তাব হল: পোল্যান্ড ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর মত ন্যাটোর পূর্বাঞ্চল থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা। ইউরোপে প্রায় ১ লাখ মার্কিন সেনা মোতায়েন থাকে, এর মধ্যে শুধু পোল্যান্ডে ১০,৫০০, রোমানিয়ায় ৩,৩০০ এবং বাল্টিক রাষ্ট্রে কয়েক হাজার। এই সেনা প্রত্যাহার রাশিয়ার বহুদিনের দাবি।

আরেকটি বিষয় হল, ট্রাম্প ইতোমধ্যেই USAID বন্ধ করে দিয়েছে। USAID এর মাধ্যমে আমেরিকা সারা বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সফট পাওয়ার চর্চা করতো, যা রাশিয়া বরাবরই বিরক্তির চোখে দেখত। এবং সবশেষে ট্রাম্প ইউক্রেনকে ন্যাটো থেকে দূরে রাখবে।

যুক্তরাষ্ট্র এইসব বিষয়ে ছাড় দিলে, তা রাশিয়ার জন্য অবশ্যই আকর্ষণীয়। তবে এর বিপরীতে রাশিয়া চীনের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদে যেসব আর্থিক ও কৌশলগত সহযোগিতা পেয়ে আসছে, তার তুলনায় ট্রাম্পের প্রস্তাব খুবই নগণ্য।

তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের এটিই শেষ মেয়াদ। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বদলে গেলে সেই চুক্তিও বাতিল হয়ে যেতে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পুতিনের বন্ধুত্ব হয়তো খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কিন্তু অন্যদিকে বড়োসড়ো কোন ভূরাজনৈতিক দুর্ঘটনা না ঘটলে,  পুতিন এবং শি জিং পিং আমৃত্যু রাশিয়া এবং চীনের নেতৃত্ব দিয়ে যাবেন। তাই ট্রাম্পের ব্যাপক আগ্রহ ও আন্তরিকতা সত্ত্বেও পুতিন হয়তো ট্রাম্পকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে গ্রহন নাও করতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ক্ষতি

ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য, পুতিনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে মরিয়া হয়ে উঠার কারণে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু ক্ষতি হতে পারে। ইউক্রেন ইতোমধ্যেই নিজেদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা প্রতারিত বলে মনে করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইউরোপীয় মিত্ররাও আমেরিকার ওপর আস্থা হারাতে পারে। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী আমেরিকার গণতন্ত্রপ্রেমী যে ভাবমূর্তি রয়েছে, পুতিনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের মাধ্যমে ট্রাম্প আমেরিকার সেই ভাবমূর্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলবে।

ট্রাম্প হয়তো মনে করছেন তিনি বিশ্ব রাজনীতির ছক নতুন করে আঁকবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে রাশিয়া এবং পুতিন। তাছাড়া বিশ্লেষকরা মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি পুতিনকে আরো বড়সড় কোন সুবিধাও দেয় তবুও, পুতিন ও শি জিনপিংয়ের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত বন্ধুত্ব ভাঙা প্রায় অসম্ভব। তাই ট্রাম্পের চুক্তি, যদি ব্যর্থ হয়, তবে তা শুধু ইউক্রেন নয়, পুরো পশ্চিমা জোটের ভরসা ও স্থিতিশীলতাকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।