টেস্টটিউব বেবি কি

Test Tube Baby 1
জীবনযাপন

টেস্টটিউব বেবি কি

ভূমিকা

টেস্ট টিউব বেবি শব্দটি আমরা অনেক শুনেছি। কিন্তু এই টেস্ট টিউব বেবি আসলে কি সে সম্পর্কে আমাদের খুব কমই ধারণা আছে। হাস্যকর হলেও সত্য যে, আমরা অনেকেই হয়ত মনে করি, টেস্ট টিউব বেবি হয়ত গবেষণাগারের টেস্ট টিউবের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়।

টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তির আসল নাম ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশ; যা IVF নামে পরিচিত। ১৯৭৮ সালে সফল আইভিএফ এর মাধ্যেমে পৃথিবীর প্রথম টেস্ট টিউব বেবি জন্ম গ্রহণ করেছিল। এই পদ্ধতির আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি বিশাল অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হয়, যা মানুষের বন্ধ্যাত্বের সমস্যার বৈপ্লবিক সমাধান নিয়ে এসেছে।

টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তির সূচনা

১৯৭০-এর দশকে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট এডওয়ার্ডস এবং চিকিৎসক প্যাট্রিক স্টেপ্টো টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য কাজ করতে শুরু করেন। তারা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটাতে সফল হন। এটি মূলত নারীর দেহের বাইরে ডিম্বাণু নিষিক্ত করার প্রযুক্তি।

১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই, ইংল্যান্ডের ওল্ডহ্যামে লুইস ব্রাউন নামে বিশ্বের প্রথম টেস্ট টিউব বেবি জন্মগ্রহণ করে। তার জন্মের মধ্য দিয়ে টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তি সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। এই প্রযুক্তি প্রমাণ করে যে, বন্ধ্যাত্ব সমস্যা একটি শারীরিক সীমাবদ্ধতা হলেও, বিজ্ঞানের সাহায্যে এটি সম্পূর্ণ সমাধানযোগ্য।

প্রথমদিকে টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তি নিয়ে অনেক বিতর্ক এবং চ্যালেঞ্জ ছিল। কিছু মানুষ এই পদ্ধতিকে অপ্রাকৃতিক এবং অনৈতিক বলে মনে করত। অনেকেই টেস্ট টিউবে নিষিক্ত ভ্রূণকে “কৃত্রিম সন্তান” হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করার কারণে, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতেও এই প্রযুক্তি নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। তবে লুইস ব্রাউনের জন্মের পরে এই ধারণা অনেকটাই পাল্টে যায়, এবং এই পদ্ধতি ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে। ২০১০ সালে, রবার্ট এডওয়ার্ডসকে টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

বন্ধ্যাত্ব সমস্যা আসলে কী?

অতীতে নিঃসন্তান দম্পতিদের ক্ষেত্রে মনে করা হত, হয়ত শুধুমাত্র নারীর সমস্যার কারণেই সন্তান হচ্ছে না। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিকায়নের পর জানা যায়, নারী বা পুরুষ উভয় লিঙ্গের মানুষই বন্ধ্যা হতে পারে। তবে এই বন্ধ্যাত্বের সমস্যাও আবার সবার এক রকম নয়।

নারীরা তাদের প্রজনন তন্ত্রের নানা ধরনের রোগের কারণে সন্তান ধারণে অক্ষম থাকেন। তবে মোটা দাগে এই সমস্যাগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একধরনের নারীরা কখনই গর্ভধারণ করেননি এবং অন্যরা অতীতে সন্তান ধারণ করেছেন কিন্তু নতুন করে গভীধারণে সমস্যা হচ্ছে।

প্রথম ধরনের সমস্যা হল, নারীর ফ্যালোপিয়ান টিউবের ব্লক বা জরায়ুর গঠনগত সমস্যায় ডিম্বাণু না ফোটার কারণে নারী কখনও গর্ভধারণ করতে পারেনা। এবং দ্বিতীয় ধরণটি হল, একজন নারী একবার গর্ভধারণ করেছেন বা সন্তান জন্ম দিয়েছেন, কিন্তু তার পরবর্তীতে গর্ভধারণে সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় জরায়ু বা ডিম্বাশয়ের জটিলতা, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা কিংবা বয়স বৃদ্ধির কারণে এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। এসব সমস্যার অধিকাংশই উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব।

অন্যদিকে পুরুষদের মূলত তিন ধরনের বন্ধ্যাত্ব দেখা যায়। কোন পুরুষের শুক্রাণু কম থকে, কারো শুক্রাণু বেশ দুর্বল হয় অথবা কারো শুক্রাণু একেবারেই থাকে না। প্রথম দুই ক্ষেত্রে চিকিৎসার মাধ্যমে টেস্ট টিউব বেবির সাহায্যে সন্তান লাভ করা সম্ভব। কিন্তু কারো শুক্রাণু একেবারেই না থাকলে, তখন কোন একজন দাতার কাছ থেকে শুক্রানু গ্রহণ করতে হয়। এই ক্ষেত্রে বংশগতির ক্রমধারা রক্ষা করা যায় না। কারণ এই পদ্ধতিতে জন্মানো সন্তানের Biological Father বা জৈবিক পিতা হবেন শুক্রাণু দানকারী ব্যক্তি।

কিন্তু এই বিষয়টি বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে গ্রহনযোগ্য নয়। এবং ইসলাম ধর্মেও এই বিষয়টি জায়েজ নয়। তবে প্রথম দুই ধরনের ব্যক্তির ক্ষেত্রে ইসলামি শরীয়তের পর্দার বিধান মান্য করে চিকিৎসার নিতে পারলে, টেস্ট টিউব বেবি গ্রহণে কোন বাঁধা নেই।

টেস্ট টিউব বেবি কিভাবে কাজ করে?

টেস্ট টিউব বেবি বন্ধ্যা নারী পুরুষের সন্তান ধারণের জন্য পরীক্ষিত এবং কার্যকরী একটি পদ্ধতি। যারা স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান ধারণ করতে পারছেন না, চিকিৎসকেরা টেস্ট টিউব বেবি বা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশ পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের সহায়তা করেন। এটিও সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে সন্তান প্রসব করার মত একটি বিষয়। প্রাকৃতিক উপায়ের সাথে টেস্ট টিউব বেবির মূল পার্থক্যটি হল, এই পদ্ধতিতে সন্তান ধারণের প্রক্রিয়াটি আংশিকভাবে শরীরের বাইরে সম্পন্ন করা হয়।

প্রথমে নারীর শরীরে কিছু হরমোনাল ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, যা একসঙ্গে অনেক ডিম্বাণু তৈরি করতে সাহায্য করে। ডিম্বাণু পরিপক্ক হলে, একটি ছোট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সেগুলো সংগ্রহ করা হয়।

এরপর পুরুষের শুক্রাণু সংগ্রহ করা হয়। শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু পরীক্ষাগারে একত্রে রাখা হয়, যাতে তারা স্বাভাবিকভাবে নিষিক্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে একটি শুক্রাণু সরাসরি ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। নিষেকের পর ডিম্বাণু থেকে ভ্রূণ তৈরি হয়, যা পরীক্ষাগারে কয়েকদিন রাখা হয়। এর মধ্যে যে ভ্রূণটি সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর মনে হয়, সেটি একটি সহজ এবং ব্যথাহীন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর ভ্রূণটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে জরায়ুতে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং শেষ পর্যায়ে গর্ভধারণ হয়।

গর্ভধারণ সফল হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের ১০-১৪ দিন পর রক্তপরীক্ষা করা হয়। যদি ভ্রূণ জরায়ুতে ঠিকভাবে স্থাপন হয়ে যায়, তবে স্বাভাবিক গর্ভধারণের মতোই প্রক্রিয়াটি এগিয়ে চলে।

তারমানে টেস্ট টিউব পদ্ধতিতেও একটি শিশু তার মায়ের পেটেই বেড়ে ওঠে। শুধুমাত্র পিতামাতার শুক্রানু এবং ডিম্বানু নিষিক্ত করার কাজটি ঘটে টেস্টটিউবের মধ্যে। সাধারণত, বন্ধ্যা দম্পতি প্রাকৃতিকভাবে তাদের শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর নিষেক প্রক্রিয়া ঘটাতে পারে না বলেই; বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা পরীক্ষাগারে টেস্ট টিউবের মধ্যে সেই কাজটি করে দেন। কিন্তু পরবর্তীতে একটি টেস্ট টিউব বেবিও আর দশটি স্বাভাবিক শিশুর মত মায়ের গর্ভেই বেড়ে ওঠে। সেকারণে প্রাকৃতিকভাবে যারা সন্তান ধারণে অক্ষম, তাদের জন্য টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তি আশীর্বাদ হিসেবে ধরা দিয়েছে।

বাংলাদেশে টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তির ইতিহাস

বাংলাদেশে ১৯৯০-এর দশকেই টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তির আগমন ঘটেছিল। তবে ঢাকা শহরে প্রথম টেস্ট টিউব বেবির জন্ম হয় ২০০১ সালে। মজার বিষয় হল, ফিরোজা বেগম ও আবু হানিফ দম্পতি ১৬ বছর ধরে সন্তানহীন থাকার পরে, টেস্টটিউব বেবির প্রযুক্তির মাধ্যমে হীরা, মনি ও মুক্তা নামে একসঙ্গে তিন কন্যাসন্তান লাভ করেন।

তারপর থেকে ধীরে ধীরে এই প্রযুক্তি বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রে টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তি সহজলভ্য। দীর্ঘদিন ধরে টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তি শুধুমাত্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ২০২৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো সরকারি ব্যবস্থাপনায় টেস্ট টিউব বেবির জন্ম হয়। টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তি এখনও অনেকের জন্য ব্যয়বহুল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই চিকিৎসার খরচ প্রায় ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এই প্রযুক্তির সেবা চালু হওয়ায় নিম্নআয়ের দম্পতিরাও এখন এই সুবিধা গ্রহণ করতে পারছেন ।

টেস্ট টিউব বেবি প্রযুক্তি চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এটি বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় ভোগা দম্পতিদের জন্য নতুন আশা তৈরি করেছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে এই পদ্ধতি বন্ধ্যাত্বকেও একটি সাধারণ রোগের মত চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলছে। যা নিঃসন্তান দম্পতিদের মুখে হাসি ফুঁটিয়ে, তাদের জীবনকে আরও আনন্দময় করে তুলেছে।

টেস্টটিউব বেবি কিভাবে হয় ?

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।