জোহরান মামদানি
জোহরান মামদানি
ভূমিকা
নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র পদপ্রার্থী তরুণ নেতা জোহরান মামদানি, শুধু নিউইয়র্ক বা যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সমগ্র বিশ্বেই আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
৩৩ বছর বয়সী এই ডেমোক্র্যাটিক নেতা সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র পদের জন্য ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাইমারি নির্বাচনে জিতেছেন। জেতার পর তিনি বাংলাদেশী আন্টিদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন, [ক্লিপ] যারা তার নির্বাচনী প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
জোহরান মামদানিই প্রথম মুসলিম এবং দক্ষিণ এশিয়ান বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের যাত্রায় এতটা সাফল্য অর্জন করেছেন।
তাছাড়া জোহরান মামদানি বলেছিলেন, তিনি যদি নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র হন, তাহলে নেতানিয়াহু নিউ ইয়র্ক সফর করলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এবং যোহরান যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীদের সুরক্ষায় কাজ করার ব্যাপারে, ট্রাম্প বলেছেন অভিবাসীদের গ্রেপ্তারে বাধা দিলে মামদানিকেও গেফতার করা হবে।
যোহরান মামদানি এখনও চূড়ান্তভাবে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হননি। সামনের নভেম্বরের জেনারেল ইলেকশনে নির্ধারিত হবে জোহরান মামদানি নিউ ইয়র্কের পরবর্তী মেয়র হতে পারবে কিনা।
নিউ ইয়র্কের নির্বাচন ব্যবস্থা
বাংলাদেশী বিভিন্ন গণমাধ্যমে জোহরান মামদানির খবর এমনভাবে প্রচারিত হয়েছে যে, তিনি যেন ইতোমধ্যে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হয়ে গেছেন। কিন্তু বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়। মামদানি কোন নির্বাচনে জিতেছে তা েবাঝার জন্য, আগে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে।
নিউ ইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচন বেশ কয়েকটা ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান দুই ধাপ হলো প্রাইমারি ইলেকশন এবং জেনারেল ইলেকশন।
প্রাইমারি ইলেকশন হলো দলের ভেতরের নির্বাচন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, রিপাবলিকান পার্টি বা অন্য যে কোনো বড় রাজনৈতিক দল, নিজেদের প্রার্থী নির্ধারণের জন্য প্রাইমারি নির্বাচন করে। অর্থাৎ, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভেতরেই একাধিক নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই পার্টির অফিসিয়াল প্রার্থী হন।
নিউ ইয়র্কে প্রাইমারি নির্বাচন র্যাঙ্কড-চয়েস ভোটিং পদ্ধতিতে হয়। ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে ক্রম নির্ধারণ করে ভোট দেন। যদি কোনো প্রার্থী প্রথমেই ৫০% ভোট না পান, তাহলে সর্বনিম্ন ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী বাদ পড়েন এবং তার ভোটগুলো ভোটারদের পরবর্তী পছন্দের প্রার্থীর মধ্যে ভাগ হয়। এভাবে চলতে থাকে যতক্ষণ না কেউ ৫০% ভোট পান। [মামদানির ভিডিও আছে]
তারমানে একটি দলের একাধিক প্রার্থী থাকলে, কে দলীয় মনোয়ন পাবে তা ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। কিন্তু সেই নির্বাচনের আয়োজন করে নিউ ইয়র্ক সিটি বোর্ড অফ ইলেকশনস। অর্থাৎ সরকারি কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক দলের প্রার্থী বাছাইয়ের ভোট আয়োজন করে দেয়।
এরপর হয় জেনারেল ইলেকশন। এখানে সব দলের অফিসিয়াল প্রার্থী, স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং কখনও ছোট দলের আন-অফিশিয়াল প্রার্থীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই মেয়র হন।
জোহরান মামদানি কেন আলোচিত
জোহরান মামদানি গত ২৪ জুন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি এখনও মেয়র হননি। তবু তাকে ঘিরে এত আলোচনার কারণ হচ্ছে, তিনি নিউ ইয়র্কের প্রভাবশালী নেতা অ্যান্ড্রু কুওমোকে পরাজিত করেছেন। এই অ্যান্ড্রু কুওমো নিউ ইয়র্কের তিনবারের সাবেক গভর্নর এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একজন প্রভাবশালী নেতা। শুধু তাই নয়, অ্যান্ড্রু কুওমোর বাবা মারিও কুওমোও তিনবার নিউ ইয়র্কের মেয়র ছিলেন। এমনকি অ্যান্ড্রু কুওমোর স্ত্রীও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার কেনেডি পরিবারের সদস্য। তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাতিজি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বহুল আলোচিত এটর্নি জেনারেল ববি কেনেডির কন্যা।
অ্যান্ড্রু কুওমোর নিজের এবং শ্বশুর বাড়ির দিক থেকে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির বাইরেও, তার পেছনে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। যারা কুওমোর প্রচারণায় বহু অর্থ খরচ করেছে।
অন্যদিকে জোহরান মামদানি শুধুমাত্র সামাজিক মাধ্যমে অভিনব কন্টেন্ট আর জনসংযোগ করে শুধু নিউ ইয়র্কেরই নয়, বরং সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাস বদলে দিয়েছে। মামদানির প্রচারণার মূল বক্তব্য হল, অ্যান্ড্রু কুওমোর মত হেভিওয়েট প্রার্থীদের Organised Money এর বিপরীতে, জোহরান মামদানি Organised People কে কাজে লাগাতে চান। তারমানে তিনি সংঘবদ্ধ জনগণের শক্তি দিয়ে, বড় বড় কর্পোরেট জায়ন্টদের আর্থিক ভিত নাড়িয়ে দিয়েছেন।
রাজনীতিবিদরা নির্বাচনের আগে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়, নিম্ন আয়ের মানুষের সাথে মেশে, কথা বলে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জোহরান মামদানি সেই কৌশলকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছেন। িতনি বলিউড পপ কালচার ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। সেই সাথে নিউ ইয়র্কের বড় একটি অংশ স্প্যানিশভাষীদের জন্য তাদের নিজেদের ভাষায় কন্টেন্ট ক্রিয়েট করে ভোটারদের কাছে টেনেছেন। শুধু তাই নয়, জোহরান মামদানি নিউ ইয়র্কের বাঙালী ভোটারদের আকৃষ্ট করতে, বাংলা ভাষায়ও কন্টেন্ট তৈরী করেছেন।
জোহরান মামদানির কন্টেন্টগুলো খুবই মজার, তরুণ প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় এবং অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তৈরী করা। তার নিজের সৃজনশীলতার পাশাপাশি, তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডও এক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে। কারণ তার মা মীরা নায়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা।
জোহরান মামদানির রাজনীতিতে পদার্পন
জোহরান মামদানি ১৯৯১ সালে উগান্ডার কামপালা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন । তার পরিবার দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত। তার বাবা মাহমুদ মামদানি একজন বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, গবেষক, প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তার মা মিরা নায়ার “Monsoon Wedding,” “The Namesake”-এর আরো বেশ কিছু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মান করেছেন।
সাত বছর বয়সে জোহরানের পরিবার উগান্ডা ছেড়ে নিউ ইয়র্কে চলে আসে। কারণ, তার বাবা মাহমুদ মামদানি কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা এবং গবেষণার সুযোগ পান। এভাবেই নিউ ইয়র্ক হয়ে ওঠে মামদানির নতুন ঠিকানা।
শৈশব থেকে জোহরান নিউ ইয়র্ক শহরের বাস্তবতা দেখেছেন খুব কাছ থেকে। উচ্চ ভাড়া, গরিব মানুষদের উচ্ছেদ, অভিবাসীদের সংগ্রাম, এসব কিছু তার ভেতর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ছেলেবেলার সেই অভিজ্ঞতাই পরবর্তীতে তাকে রাজনীতির দিকে টেনে এনেছে।
সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে নামার আগে, তিনি বেশ কয়েক ধরনের সমাজসেবার কাজ করেছেন। নিউ ইয়র্কে ভাড়া দিতে না পারা মানুষদের ঘর থেকে উচ্ছেদ হওয়া ঠেকাতে এবং ট্যাক্সি ড্রাইভারদের ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা থেকে উদ্ধার করতে জোহরান মামদানি অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন।
তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি রাজনীতিতে আসেন ২০২০ সালে। সে বছর জোহরান মামদানি নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি Democratic Socialists of America (DSA)-র সদস্য। রাজনীতিতে আসার আগে তিনি সখের বসে র্যাপ সঙ্গীত চর্চা করতেন।
রাজনৈতিক বিতর্ক
জোহরান মামদানি রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আসার অন্যতম দুটি কারণ হল, ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসনি নীতির কঠোর বিরোধীতা এবং ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের চালানোর গণহত্যায় মার্কিন সমর্থনের বিরোধীতা।
নির্বাচন বোর্ড থেকে জোহরানের জয় নিশ্চিত হওয়ার পর ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যদি মামদানি চূড়ান্ত নির্বাচনে জেতেন এবং মেয়র হিসেবে নিউইয়র্ক সিটিতে অভিবাসীদের গ্রেপ্তারে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন তিনি কীভাবে তা সামলাবেন। এর
জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘তাহলে তো তাঁকে আমাদের গ্রেপ্তার করতেই হবে।
এছাড়া প্রাইমারি নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত এক টেলিভিশন বিতর্কে জোহরান মামদানিকে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি যদি মেয়র হন, তবে ইসরায়েল সফর করবেন কি না। একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় সব প্রভাবশালী প্রার্থী তখন বলেছেন, তারা নির্বাচনে জয়ী হলে ইসরায়েল সফরে যাবেন।
কিন্তু জোহরান মামদানি বলেন, তিনি মেয়র হওয়ার পর নিউ ইয়র্কেই থাকবেন, ইসরায়েল সফর করবেন না। সেই সাথে তিনি অতীতে বলেছিলেন, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। নিউ ইয়র্কের মেয়র হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান জানিয়ে, নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করতে পারেন। তার এই অবস্থান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভেতরেও তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়। অনেকে তার বক্তব্যকে কট্টর পন্থী মনোভাব হিসেবে দেখছেন।
তেল আবিরেব বাইরে সবচেয়ে বেশি ইহুদি বাস করে নিউ ইয়র্কে। তাই কেউ কেউ মনে করছেন, নিউ ইয়র্কের মতো বিপুল ইহুদি বসবাসকারী একটি শহরে জোহরান মামদানির মত ব্যক্তি মেয়র হওয়া রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে ইসরায়েল সম্পর্কে জোহরান মামদানির স্পষ্ট অবস্থান তাকে অন্য প্রার্থীদের থেকে আলাদা করেছে এবং তার স্পষ্টভাষী রাজনৈতিক চরিত্রই তাকে নিউইয়র্কের মেয়র প্রার্থী হিসেবে নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতির এক পরিচিত মুখে পরিণত করেছে।