জাফরান
জাফরান
ভূমিকা
বিশ্বের সবচেয়ে দামি মশলার নাম জাফরান। ইংরেজিতে একে বলা হয় Saffron। হাজার বছরের ইতিহাসে জাফরান শুধু রান্নার স্বাদ ও রঙে নয়, বরং চিকিৎসা, সুগন্ধি ও ধর্মীয় আচারেও বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
জাফরানকে বলা হয় লাল সোনা। তবে মূল্যমান এবং দুষ্প্রাপ্যতার দিক থেকে জাফরান যেন সোনাকেও হার মানায়। ১ কেজি জাফরানের দাম প্রায় ৪ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। খাদ্যদ্রব্য থেকে, প্রসাধন সামগ্রী এমনকি ওষুধ তৈরীতেও জাফরানের ব্যবহার হয়ে থাকে।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে জাফরানের চাহিদা আকাশছোঁয়া, কিন্তু এর উৎপাদন সীমিত। আর সেই কারণেই জাফরান শুধু মশলা নয়, বরং বিলাসিতা আর সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
জাফরান কী
জাফরান মূলত Crocus sativus নামের এক ধরনের ফুলের শুকনো লাল রঙের স্তবক বা গর্ভকেশর। এই ফুলে মাত্র তিনটি স্তবক থাকে, যা খুব যত্নসহকারে হাতে তুলে শুকানো হয়। এই ছোট্ট থ্রেড বা সুতার মত অংশই জাফরান নামে পরিচিত। এর গাঢ় লাল রঙ রান্নায় সোনালি আভা যোগ করে এবং বিশেষ এক ধরনের মিষ্টি-তেতো ঘ্রাণ ছড়িয়ে দেয়। এর রাসায়নিক উপাদান crocin রঙের জন্য, picrocrocin স্বাদের জন্য এবং safranal সুগন্ধ উৎপাদন করে।
যেকোন রান্নায় জাফরান খুব অল্প পরিমাণে ব্যবহৃত হয় এবং রান্নার আগে গরম পানি বা দুধে ভিজিয়ে দিলে এর রঙ ও সুবাস ভালোভাবে ছড়ায়। এটি মিষ্টান্ন, ঝাল খাবার ও শরবত বা লাচ্ছির মত নানা ধরনের পানীয়তে জনপ্রিয়। প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ, ইউনানি ও চীনা চিকিৎসায় জাফরানের ব্যবহার হয়ে আসছে। হজমশক্তি বাড়ানো, মন ভালো রাখা ও প্রদাহ কমাতে জাফরান কাজে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, জাফরানের মধ্যে থাকা crocin ও safranal মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে এবং হালকা বিষণ্ণতায় উপকার আনতে পারে। এছাড়া এর রঙ ও ঘ্রাণের জন্য উচ্চমানের প্রসাধনী ও সুগন্ধিতেও জাফরানের ব্যবহার রয়েছে।
জাফরান এত দামি কেন?
বিশ্বের সমস্ত অঞ্চলে জাফরান চাষ করা সম্ভব হয় না। জাফরান চাষের জন্য বিশেষ ধরনের আবহাওয়ার দরকার হয়। সাধারণত শুষ্ক-গরম গ্রীষ্ম এবং শীতকাল আদর্শ। পানি দ্রুত নিস্কাশন হতে পারে এমন বালুমিশ্রিত মাটিতে গ্রীষ্মের শেষদিকে Crocus sativus এর কন্দ রোপণ করা হয়। তারপর শরৎকালে এসব গাছে ফুল ফোটে। ফুল ফোটার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে সব ফুল তুলতে হয়, নইলে ফুলের গর্ভকেশর নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিটি stigma সতর্কতার সাথে হাত দিয়ে আলাদা করা হয়, তারপর হালকা তাপে শুকিয়ে প্যাকেজিং করা হয়। এই সূক্ষ্ম প্রক্রিয়ার কারণেই জাফরানের মান ও বাজারদর নির্ধারিত হয়।
জাফরান বিশ্বের সবচেয়ে দামি মশলা হওয়ার মূল কারণ হল এর দুষ্প্রাপ্যতা এবং অত্যন্ত শ্রমনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা। এক কেজি জাফরান তৈরি করতে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার ফুলের গর্ভকেশর হাত দিয়ে তুলে সংগ্রহ করতে হয়। এই ফুল ফোটার মৌসুমও খুব সীমিত সময় স্থায়ী হয়। সাধারণত বছরে মাত্র কয়েক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে জাফরান সংগ্রহ করতে হয়, তাই দ্রুত সময়ে বিপুল শ্রম দিতে হয়। যন্ত্রের বদলে হাত দিয়ে তোলা এবং শুকানোর প্রতিটি ধাপের জন্য অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়, যা উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া ফুল থেকে স্তাবক আলাদা করে শুকানোর পর এর ওজন অনেক কমে যায়। যার কারনে প্রচুর পরিমাণ ফুল থেকে অতি সামান্য পরিামাণ জাফরান উৎপন্ন হয়। আর এমন দুষ্প্রাপ্যতার কারনেই জাফরান বিশ্বের সবচেয়ে দামি মশলার তকমা অর্জন করেছে।
বিশ্বের কোন কোন দেশের জাফরান উৎপাদন হয়?
ইরান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জাফরান উৎপাদনকারী দেশ। বিশ্বের মোট জাফরানের ৯০ শতাংশই উৎপন্ন হয় ইরানে। এছাড়া আফগানিস্তান, ভারতের কাশ্মীর, স্পেন, মরক্কো, গ্রিস, ইতালি এবং তুরষ্কেও অল্প কিছু জাফরান উৎপাদন হয়। প্রতিটি অঞ্চলের জলবায়ু, মাটি ও প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির কারণে জাফরানের স্বাদ, ঘ্রাণ ও রঙে কিছুটা পার্থক্য থাকে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফগানিস্তান জাফরান উৎপাদনে বেশ উন্নতি করেছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানের হেরাত, ফারাহ ও বালখ প্রদেশের আবহাওয়া ও মাটি জাফরান চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ২০২২ সালে আফগানিস্তানের উৎপাদন ছিল প্রায় ২০ মেট্রিক টন, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪৬ মেট্রিক টনে। আফগান সাফ্রন গাঢ় লাল রঙ, উচ্চ crocin মান এবং তীব্র সুবাসের জন্য বিশ্ববাজারে প্রশংসিত। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—আফগানিস্তানে জাফরান সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে নারীদের অংশগ্রহণ ৮০ শতাংশেরও বেশি, যা একদিকে দেশটির গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে, অন্যদিকে আফগানিস্তানের মত দেশে নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে।