চীন-রাশিয়া কি ইরানকে সাহায্য করবে?

maxresdefault (1)
কি কেন কিভাবে

চীন-রাশিয়া কি ইরানকে সাহায্য করবে?

ভূমিকা

মাত্র এক সপ্তাহ আগেও বিশ্ব ছিল অনেকটাই শান্ত। কিন্তু ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলোর ওপর ইসরায়েলের আকস্মিক হামলা, এক ধাক্কায় পুরো অঞ্চলের পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে। স্বল্পমেয়াদে এই উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এই সংঘাত পুরো মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্য বদলে দিতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।

চীন-রাশিয়া কি ইরানকে সাহায্য করবে ?

পুতিনের কৌশলী অবস্থান

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান উত্তেজনায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পড়ে গেছেন এক অদ্ভুত কূটনৈতিক টানাপোড়েনে। কারণ, একদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে রাশিয়ার দীর্ঘদিনের উষ্ণ সম্পর্ক, অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তি। দুই পক্ষের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে পুতিন এখন এক ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে পুতিন এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট একটি নতুন কৌশলগত অংশীদারিত্বের চুক্তি সই করেন। এই চুক্তিতে উভয় দেশের জন্য যৌথ হুমকি মোকাবেলার অঙ্গীকার থাকলেও, সরাসরি সরাসরি সামরিক জোটের কোনও কথা বলা হয়নি।

তাই ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলার পরও রাশিয়া সরাসরি সামরিক সহায়তা দিতে এগিয়ে আসেনি। বরং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসরায়েলের অভিযানকে কঠোরভাবে নিন্দা করেছে। রাশিয়ার ভাষায়, “এটি একটি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত হামলা এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদের লঙ্ঘন।”

মৌখিক নিন্দা জানানোর চেয়ে, রাশিয়ার কাছ থেকে ইরানের প্রত্যাশা ছিল আরো বেশি। পশ্চিমা সহ বিশ্ব জনমতের তোয়াক্কা না করে, ইউক্রেন যুদ্ধে ইরান রাশিয়াকে ড্রোন দিয়ে সাহায্য করেছিল। তাই ইরানের আশা ছিল এই সংকটে হয়তো রাশিয়া আরও শক্ত অবস্থান নেবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ ধরনের সংকট রাশিয়ার জন্য এক ধরনের সুযোগও তৈরি করেছে। কারণ, বিশ্বব্যাপী এখন মিডিয়ার নজর ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে সরছে। ফলে রাশিয়া কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে এসেছে।

আরেকটি বড় বিষয় হলো, ইসরায়েলি হামলার ফলে ইরানের তেল শোধনাগারে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। যার প্রভাবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে। এতে রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য স্বল্পমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কারণ, এতে তাদের তেল বিক্রির আয় বাড়ছে।

রাশিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক বহু পুরনো। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এই সম্পর্কের ভিত্তি তৈরী হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট পুতিন ও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক বহুবার প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধের আগে নেতানিয়াহু নিয়মিত রাশিয়া সফর করতেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান এবং ইসরায়েল দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলার ফলে রাশিয়ার সামনে একটি শক্তিশালী মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

তবে অন্যদিকে অনেক বিশ্লেষক আবার মনে করছেন, ইরান বা ইসরায়েল কেউই রাশিয়ার মধ্যস্থতায় খুব একটা আস্থা রাখবে না। বরং ইরান দ্রুতই রাশিয়াকে বিশ্বাসঘাতক ভাবতে শুরু করতে পারে।

চীনের অবস্থান ও উদ্বেগ

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে চীনের অবস্থান বেশ স্পষ্ট হলেও, তা ইরানের খুব বেশি উপকার করতে পারছে না। চীন ইসরায়েলের আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালনের ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে সরাসরি সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রশ্নে চীন বরাবরই নিরপেক্ষতা বজায় রাখছে। চীন বরং জাতিসংঘের কাঠামোর মধ্য দিয়েই সংকট নিরসনের পক্ষে।

জাতিসংঘ মূলত গঠিতই হয়েছিল এ ধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা জন্য। তবে সাম্প্রতিক সংঘাতগুলোতে জাতিসংঘের ভূমিকা খুবই দুর্বল। ইউক্রেন বা গাজায় যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘ একটি নিরব দর্শক ছাড়া আর কিছু না। বর্তমানে চলমান ইরান-ইসরায়েল সংঘাতেও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ আসবে না, বলেই মনে করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে চীনের জন্য সেটা একটি স্পর্শকাতর বিষয় হবে। তবে চীন সম্ভবত সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়ার দিকে যাবে না এবং বরং কূটনৈতিক চাপের মাধ্যমেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করবে।

চীনের দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই স্পষ্ট, তারা কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। তবে তাদের মূল আগ্রহ হচ্ছে স্থিতিশীল প্রতিবেশী অঞ্চল তৈরি করা, যাতে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। ইরানে যদি কোনো ‘পশ্চিমাপন্থী’ সরকার আসে, তাহলে সেটা বেইজিংয়ের জন্য অবশ্যই উদ্বেগের বিষয় হবে। তাই তারা হয়ত গোপনে বর্তমান ইরান সরকারকে সহায়তা করতে পারে। তবে চীন কখনই ইরানের পক্ষ নিয়ে সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না। বরং চীন বিচক্ষণ ব্যবসায়ীর মত কৌশলগত সহযোগিতা বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করবে।

অন্যান্য প্রতিবেশীর ভাবনা

ইসরায়েল নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে গোটা অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দিতে চাইছে। গাজা, লেবানন, সিরিয়া এবং সর্বশেষ ইরান; পুরো অঞ্চলের সংঘাতগুলো আসলে একটি সুপরিকল্পিত প্রকল্পের অংশ। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের পর রাশিয়া এবং ইরানের যৌথ প্রভাব অনেকটাই কমে গেছে।

মিশর এবং Gulf Cooperation Council বা উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ GCC এর সদস্য দেশগুলো এই পুরো পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে। GCC এর সদস্য দেশগুলো হল বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। সবগুলো মুসলিম দেশ হলেও, এরা মাত্র বছর দুয়েক আগেও ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। গাজা পরিস্থিতির পর সেই মনোভাব যদিও অনেকটাই বদলে গেছে। তবে ২০২০ সালে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে বাহরাইন এবং আরব আমিরাত ইতোমধ্যেই ইসরায়েলের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধুত্ব করেছে। এদের এখন চাওয়া হল, ইসরায়েল বা ইরান কেউই যেন মধ্যপ্রাচ্যে একক আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে। GCC দেশগুলোর ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্র। এবং মধ্যপ্রাচ্যের এসব মুসলিম দেশগুলোর প্রত্যেকটিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এবং সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন সবাই যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা। আবার যুক্তরাষ্ট্র এই দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিও করেছে, ফলে তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে আমেরিকান অস্ত্রের ওপর।

ইরানের প্রতিবেশী সকল দেশই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মিত্র। বরং এদের অনেকেই তাদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে ইরানকে ঠেকানোর জন্য। তাই ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে ইরান তার কোন প্রতিবেশী দেশের সাহায্য পাওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই। বরং ইসরায়েল যেভাবে হুট কেরে ইরান আক্রমণ করে বসেছে, তাতে উপসাগরীয় দেশগুলো হয়ত নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে, উল্টো গোপনে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট করতে পারে।

তবে ইরান প্রসঙ্গে তুরস্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে কারণ তাদের ইরান, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া সবার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। সেই সাথে ইরানের ব্যস্ততার সুযোগে তুরস্ক আবার ইরাক ও সিরিয়ায় নিজের নিরাপত্তা ও জ্বালানি সংক্রান্ত স্বার্থ এগিয়ে নিতে পারে।

চলমান যুদ্ধে ইরানের অবস্থান যদি আরো দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে আব্রাহাম চুক্তির আওতায় আরো বেশ কিছু আরব দেশ ইসরায়েলের সাথে নতুন করে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। সেই সাথে ইরান যদি এই সংঘাতে দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে তার প্রভাব সীমান্ত ছাড়িয়ে আরও দূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। যেমন, আজারবাইজান ইরানের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বহুদিনের অমীমাংসিত ঝেঙ্গাজুর করিডোর নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে।

সবকিছু মিলিয়ে চলমান সংঘাতে ইরান এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। যেখানে তারা শত্রুরা তো বটেই, পুরনো মিত্ররাও ইরানের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। তাই বিপদের দিনে ইরান কাউকে তো পাশে পাচ্ছেই না, বরং হাতে গোনা দু একটি বন্ধুদের উপর থেকেও আস্থা হারাতে যাচ্ছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।