চা শ্রমিকদের দুঃসহ জীবন

maxresdefault (17)
জীবনযাপন

চা শ্রমিকদের দুঃসহ জীবন

বাংলাদেশের চা শ্রমিকেরা ২০ দফা দাবি নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ ধর্মঘট পালন করছেন। তাদের প্রধান দাবি তাদের দৈনিক মজুরী ৩০০ টাকা দিতে হবে। সারাদিন বাগানে অমানবিক শ্রমের পরও তারা নায্য মজুরী পাচ্ছেন না। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির বাজারেও তারা দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা মজুরীতে কাজ করেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি দুই বছর পর পর চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর কতা থাকলেও, গত দুই বছরে তাদের মজুরি বাড়েনি। বর্তমানে বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী একজন মানুষের দৈনিক নূন্যতম জীবন ধারণের খরচ ২৬০ টাকা। সেখানে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা মজুরী দিয়ে, কিভাবে তাদের পরিবার সহ জীবন যাপন করে, তা মালিকপক্ষ বুঝতে চায় না। বেতন বৈষম্যেরও একটা সীমা আছে, কিন্ত চা শ্রমিকদের মজুরী যেন বৈষম্যের সকল সীমা অতিক্রম করে গেছে।

চা শ্রমিকদের মজুরি এত কম কেন ?

চা বাগানের যাত্রা
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় দেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ আমলে ভারত বর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে দরিদ্র মানুষদের নিয়ে এসে চা বাগানের কাজ করানো হত। সেসব শ্রমিকেরা সীমাহীন দারিদ্রতার মধ্যে দিয়ে চা বাগানগুলোতে কাজ করতো। তখন মজুরি হিসেবে তাদেরকে এমন এক ধরনের মুদ্রা দেওয়া হত, যা বাজারে চলত না। সেই মুদ্রা শুধু বাগানের ভেতরেই ব্যবহার করা যেত। ফলে চা শ্রমিকরা যে কিছু টাকা জমিয়ে বাগানের বাইরে গিয়ে অন্য কাজ বা ব্যবসা করবে, সেই সুযোগও তাদের ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের বাকি জীবন বাগানেই কাটাতে হতো। শতাব্দী পেরিয়ে এসে সেই নির্মমতা হয়তো এখন নেই। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বঞ্চনা নিয়েই চা শ্রমিকরা বেঁেচ আছেন। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ কর্মকর্তাদের বলা হত বড় বাবু আর দেশীয় কর্মকর্তাদেরকে বলা হত ছোট বাবু। বড় বাবুরা চলে গেলেও, ছোট বাবুরা এখন বড় বাবুদেন জায়গা দখল করেছে। দেশ স্বাধীন হবার পর দৈনিক এক টাকা দুই আনা মজুরি পেত শ্রমিকরা। পরে সেটা বেড়ে দৈনিক পাঁচ টাকা হয়। এভাবে মজুরি বাড়তে বাড়তে এখন দৈনিক ১২০ টাকায় এসে ঠেকেছে। সেই সাথে দুই পূজায় কিছু বোনাস পায় তারা। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ চা সংসদের নিয়ম অনুযায়ী, শ্রমিকদের বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, রেশন, পানীয় জলের ব্যবস্থা এবং বোনাসসহ ন্যায্যমজুরি নিশ্চিত করবে বাগান মালিক। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও চা সংসদের মধ্যকার সমঝোতা অনুযায়ী প্রতি দুই বছর পর পর শ্রমিক ও মালিকপক্ষের আলোচনায় বসার নিয়ম। এই আলোচনা থেকে তাদের মজুরি বাড়ানো সহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধার চুক্তি হওযার কথা। চা শ্রমিকদের সঙ্গে সর্বশেষ দ্বি-বার্ষিক চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এর পরপরই বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশি চা সংসদের কাছে ২০ দফা সহ ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি দাবি করেন। সেই থেকে দাবি আদায়ে বহুবার বৈঠক হলেও, মালিকপক্ষ শ্রমিকদের নায্য অধিকার বাস্তবায়ন করেনি।


বেতন বৈষম্য
বাংলাদেশে বর্তমানে ১৬৭ টি চা বাগান আছে। এসব চা বাগানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ নাম মাত্র মজুরীতে কাজ করেন। এবং এসব শ্রমিকের পরিবার সহ প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষের ভাগ্য চা শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে। প্রতিবছর দেশে গড়ে প্রায় ৮ থেকে ৯ কোটি কেজি চা উৎপাদন হয়। সারাবিশ্বে উৎপাদিত মোট চায়ের ৩ ভাগ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। ২০২১ সালের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের চায়ের বাজার মূল্য প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এখান থেকে মাত্র এক শতাংশ অর্থ শ্রমিকদের বেতন ভাতা বৃদ্ধির জন্য ব্যয় করা হলেও, শ্রমকিদের সমস্যার সমাধান হতে পারে বলে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন। পাশের দেশের মজুরি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারতে একজন চা শ্রমিক দৈনিক ২০৩ থেকে ৩৪০ রুপি পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। এ ছাড়াও শ্রীলঙ্কায় একজন চা শ্রমিক পান দৈনিক ৩৫০ রুপি। নেপালের শ্রমিকরাও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি মজুরি পায়। বাগান কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা হলেও চা বাগানের শ্রমিকরা আরও অন্যান্য সুবিধা পান। প্রতি সপ্তাহে তাদেও একবার দুই টাকা কেজি দরে সাড়ে তিন কেজি আটা দেয়া হয়, চা দেয়া হয়, বাগানের জায়গায় থাকার যায়গাসহ শিক্ষা ও চিকিৎসা দেয়া হয়। এ সব মিলিয়ে তাদের দৈনিক বেতন ৪০০ টাকার বেশি আসে। যদিও শ্রম আইন অনুযায়ী এসব সুবিধা মালিকরা শ্রমিকের বেতন হিসেবে ধরতে পারেন না। তাই মালিকদের এই যুক্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তারচেয়েও বড় আরেকটি বিষয় আসলে পরিষ্কার করে বলা হয় না। আর তা হল চা বাগানের সকল শ্রমিকই দৈনিক ১২০ টাকা মজুরী পায় না। একটি বাগানে শ্রমিকদের বেশ কয়েকটি ভাগ থাকে। এদের মধ্যে প্রধান ভাগ হল স্থায়ী শ্রমিক এবং অস্থায়ী শ্রমিক। প্রতিটি বাগানে স্থায়ী শ্রমিকের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক অস্থায়ী শ্রমিক থাকেন। স্থায়ী শ্রমিকদেরকে আবার ‘এ’ ‘বি’ এবং ‘সি’ হিসেবে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। শুধুমাত্র ‘এ’ ক্যাটাগরির শ্রমিকরা ১২০ টাকা মজুরি পান। ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটেগরির শ্রমিকদের বেতন ১২০ টাকার কম। অন্যদিকে অস্থায়ী শ্রমিকদের বেতন আরো অনেক কম। স্থায়ী শ্রমিকদের ৪৭ দিনের মজুরির সমান বোনাস দেয়া হয়। যার টাকার পরিমাণ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। মাত্র এই সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা বোনাসও আবার দুইভাগে দেওয়া হয়। বোনাসের ৬০ ভাগ দেয়া হয় দুর্গাপূজায় এবং ৪০ ভাগ দেয়া হয় ফাগুয়া উৎসবে। তবে দুঃখের বিষয় হল অস্থায়ী শ্রমিকেরা এই বোনাসও পায় না। সেই সাথে সপ্তাহে দুই টাকা কেজি দরে সাড়ে তিন কেজি আটা থেকেও তারা বঞ্চিত হয়। আরো হতাশার বিষয় হল, শ্রমিকেরা যে যত সামান্য টাকাই বেতন পান না কেন, নিজেদের ভবিষ্যৎ তহবিলে জন্য তাদের বেতনের সাড়ে সাত ভাগ টাকা জমা রাখতে হয়। এছাড়া প্রতি মাসে ১৫ টাকা চা শ্রমিক ইউনিয়নে চাঁদা এবং তাদের বসত বাড়ির বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয়।


চা শ্রমিকদের দুর্দশা
চা শ্রমিকদের খাদ্য তালিকায় পুষ্টিমান সম্পন্ন খাবার নেই বললেই চলে। তারা সকাল বেলা খায় রুটি আর, চা পাতা বা আলু ভাজি। দুপুরে রুটি বা ভাতের সাথে চা পাতা ভর্তা এবং রাতে ভাতের সাথে চানার ডাল। এদের অনেকেই বছরে একবারও মাংস খেতে পারেনা। এমনকি ডিম কিনে খাওয়াও তাদের পক্ষে অসম্ভব। অথচ তাদের পরিশ্রম করতে হয় উদয়াস্ত। শুধু হাড় ভাঙা খাটুনিই নয়, চা পাতা তোলার সময় তাদের মাথায় বা কাধে ঝোলে বড় ঝোলা, যার ভেতরে তারা চাপাতা রাখে। এত কম পারিশ্রমিক পাওয়ার পরও চা শ্রমিকেরা অনান্য যে কোন শিল্পখাতে শ্রমিকদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করে। একজন কৃষি শ্রমিক দিনে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা পরিশ্রম করেন। কিন্তু চা শ্রমিকদেও ভের ৬ টা থেকে সন্ধা ৬ টা পর্যন্ত প্রায় ১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। কথায় আছে, পেটে খেলে, পিঠে সয়। কিন্তু এই মানুষগুলো তো পেটেও ঠিকমত খায় না, তাহলে তাদের পিঠে এত বোঝা, এত অন্যায় কিভাবে সয়? সবকিছু মুখ বুজে সয়ে যাওয়া এই শ্রমিকেরা, বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নেমেছে। এই আন্দোলনের কারণে তাদের বর্তমানে খাওয়ারও তেমন কিছু নেই। তবুও তারা জীবন বাজি রেখে তাদের ন্যায্য পাওয়া আদায়ের সংগ্রামে নেমেছে। শ্রমিকরা শুধু চায় তাদের মজুরী ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হোক। একজন শ্রমিকের বেতন দৈনিক ৩০০ টাকা হলেও, তারা মাসে উপার্জন করতে পারবে মাত্র ৯ হাজার টাকা। একজন শ্রমিকের এই মজুরি দিয়ে কমপক্ষে ৫ সদস্যের একটি সংসার চালাতে হয়। বর্তমান দুর্মুল্যের বাজারে ৯ হাজার টাকায়ও কি ভালোমতো সংসার চলে? দেশের একজন সাধারণ অদক্ষ দিন মজুর দৈনিক ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি পায়। দক্ষ শ্রমিক হলে কাজ ভেদে তাদের মজুরি হয় কমপক্ষে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। অথচ চা শ্রমিকদের অধিকাংশই দক্ষ শ্রমিক হয়েও মজুরি পাচ্ছেন মাত্র ১২০ টাকা। এই টাকা দিয়ে একটি পরিবারের প্রয়োজনীয় খাদ্য কেনাই প্রায় অসম্ভব। সেখানে তারা তাদের জামা কাপর, তেল সাবান সহ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিভাবে কিনবে?


চা বাগান মালিক বনাম চা শ্রমিক
দুই বছর আগে তাদের যে মজুরি বৃদ্ধি করার কথা ছিল তা এখনও করা হয়নি। চা বাগান মালিকদের সংগঠন বলছে, সমঝোতা চুক্তির মধ্যে শ্রমিকদের কর্মবিরতি ও আন্দোলনে যাওয়া সম্পূর্ণ অনৈতিক। অথচ তারা তাদের অন্যায় মজুরি ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া অনৈতিক মনে করছে না। দুই বছর পর পর মজুরি বাড়ানোর কথা থাকলেও, মালিকপক্ষ সেই চুক্তি ভঙ্গ করেছে। ২০ মাস আগে মজুরি বাড়লে শ্রমিক পরিবারগুলো কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার পরিচালনা করতে পারতো। মালিকদের দাবি, গত ১০ বছর ধরে চা পাতার মূল্য বাড়েনি। কিন্তু ১০ বছরে চা শ্রমিকদের বেতন কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। সত্যি কথা বলতে, দশ বছর আগে শ্রমিকদের বেতন ছিল মাত্র ৫০ টাকারও কম। কয়েক দফা বাড়ানোর পরেই ১২০ টাকা। চায়ের দাম নিয়েও বাগান মালিকদের মিথ্যাচার। বিশ্ব বাজারের সাথে বাংলাদেশে চায়ের বাজারের দামের পার্থক্য মাত্র ১০০ টাকারও কম। তারা কত টাকা মুনাফা করলে, এই ব্যবসা তাদের জন্য লাভজনক হবে, তা হয়ত নিরীহ শ্রমিকেরা জানে না। যদি চা শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা হয়, তাহলেও কি এই মজুরীটা খুব বেশি? খুব বেশি তো দূরের কথা, ৩০০ টাকাও যথার্থ মজুরী নয়। মজুরী বাড়লেও তো সকল শ্রেণীর শ্রমিক দৈনিক ৩০০ টাকা পাবে না। বিভিন্ন দফায় আলোচনার পরও, শ্রমিকদের মজুরি না বাড়ানোর জন্য মালিকরা তাদের লোকসানের দোহায় দিয়ে যাচ্ছে। অথচ অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশের অতি ধনাঢ্য ব্যবসায়িক গোষ্ঠী গুলোই এসব চা বাগানের মালিক। চা বাগান মালিক কর্তৃপক্ষের দাবি, দেশের জিডিপিতে চা শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। শ্রমিকদের কর্মবিরতিতে দৈনিক ২০ কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের চা পাতা নষ্ট হচ্ছে। শ্রমিকদের মত বাগানগুলোকেও অবস্থাভেদে ‘এ’ ‘বি’ এবং ‘সি’ ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। বগান মালিকদের মতে চা শ্রমিকদের বেতন বজানো হলে, ‘এ’ ‘বি’ ক্যাটাগরির বাগানগুলো হয়ত টিকতে পারলেও, ‘সি’ ক্যাটাগরির বাগানগুলো মুনাফার অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। সবকিছু মিলিয়ে শ্রমিকরা যত কষ্টেই থাকুক না কেন, চা বাগান মালিকদের কাছে তাদের ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জনই মূখ্য।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।