চামড়ার দাম এত কমে গেল কিভাবে

maxresdefault (8)
কি কেন কিভাবে

চামড়ার দাম এত কমে গেল কিভাবে

ভূমিকা

বাংলাদেশে সাধারণত কোন জিনিসের দাম একবার বাড়তে তা আর সহজে কমে না। কিন্তু এর ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটেছে বাংলাদেশের চামড়ার বাজারে। বিগত কয়েক বছর যাবৎ পর্যায়ক্রমে কাঁচা চামড়ার দাম কমেই চলেছে। দশ বছর আগেও যে চামড়ার দাম ছিল দুই থেকে তিন হাজার টাকা। সেই চামড়া এখন বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২০০ থেকে ৫০০ টাকায়।

প্রতি বছর কোরবানী ইদের পরে দেখা যায় যে, বিপুল পরিমাণ চামড়া অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। অতি স্বল্প মূল্যেও অনেকে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে, মাটির নিচে পুঁতে ফেলছেন। বিয়য়টি এমনও নয় যে, মানুষ আর চামড়ার পণ্য ব্যবহার করছে না। এখনও ভালো মানের চামড়াজাত পণ্য কিনতে গেলে আপনাকে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে হবে।

চামড়ার দাম এত কমে গেল কিভাবে ?

বাংলাদেশের চামড়া শিল্প

চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন বলছে, বাংলাদেশে সারা বছর যত চামড়া বাজারে আসে তার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই আসে কোরবানী ঈদের সময়। ইদের সময়ে সংগৃহীত চামড়াকে কেন্দ্র করে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। কোরবানী ইদের পর সারাদেশের বিভিন্ন জায়াগা থেকে আড়তদার এবং মৌসুমী ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে। তাদের কাছ থেকে ট্যানারি মালিকেরা সাধারণত লবণ মাখানো কাঁচা চামড়া কিনে নেয়। ট্যানারি মালিকরা কত দামে আড়তদারদের কাছ থেকে কোরবানীর চামড়া কিনবে, সেই দাম নির্ধারণ করে বানিজ্য মন্ত্রনালয়।

চামড়ার ব্যবসায় মন্দা লাগার পর থেকে প্রতি বছরই বানিজ্য মন্ত্রনালয় চামড়ার দাম ১০/১৫ টাকা করে বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে সেই দাম কার্যকর হচ্ছে না। এবছর লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, গরুর চামড়ার মান ভেদে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা প্রতি বর্গফুট এবং ছাগলের চামড়া ২২ থেকে ২৭ টাকা প্রতি বর্গফুট। দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও কাঁচা চামড়া নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে এবারও।

এ খাতের অভিজ্ঞরা বলছেন, কোরবানির পশুর চামড়া সাধারণত তিনটি ধাপে হাতবদল হয়। গৃহস্থালি পর্যায় থেকে ব্যবসায়ী বা আড়তদার হয়ে শেষধাপে পৌছায় ট্যানারিতে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) এর তথ্য অনুযায়ী, সংরক্ষণ ত্রুটির কারণে প্রতিবছর প্রায় ৩০ শতাংশ পশুর চামড়া নষ্ট হয়। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে লবণ এবং চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার রাসায়নিকের দামও বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে চামড়া ব্যবসায়ীরাও কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

চামড়া শিল্পের পতন

ট্যানারিশিল্পের অন্যতম উপকরণ কাঁচা চামড়ার দাম দিন দিন আশঙ্কাজনকহারে কমছে। ১০ বছর আগেও আকার ভেদে গরুর চামড়ার দাম ছিল ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। এখন সেই চামড়া আকৃতিভেদে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০০ থেকে ৬০০ টাকায়। কোরবানির চামড়ায় ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায়, এই খাত সংশ্লিষ্ট সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, ট্যানারি মালিকেরা হয়ত ইচ্ছে করে, কাঁচা চামড়ার দাম কম দিচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি সেরকম নয়। বরং ট্যানারি মালিক এবং চামড়াপণ্য রপ্তানিকারকরা এখান থেকে মুনাফা করতে পারছে না বলেই, চামড়া শিল্পের এমন ধ্বস নেমেছে।

চামড়াশিল্পের সংকটের মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার ক্ষেত্রে পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখা হচ্ছে না। বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করার ক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। এছাড়া বাংলাদেশের চামড়া ব্যবসায়ীদের লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ বা এলডব্লিউজি এর সনদ নেই। এ কারণেই দেশে চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে।

বিশ্ব বাজারে চামড়া ব্যবসার ক্ষেত্রে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ এর সার্টিফিকেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সাল থেকে এই অলাভজনক সংগঠন বিশ্বের চামড়াশিল্পের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরীক্ষা করে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে পরিবেশ বান্ধব প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে, টেকসই শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এছাড়া বিশ্ব বাজারে চামড়া ব্যবসার জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন বা আইএসও এর সার্টিফিকেট প্রয়োজন।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে চামড়াজাত পণ্য রফতানি করা হয়। তবে ইউরোপের দেশগুলোই মূলত চামড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে লাভজনক বাজার। কিন্তু বাংলাদেশের ট্যানারিশিল্পের সামগ্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়া মোটেও পরিবেশ বান্ধব নয়। ইউরোপের বাজারে চামড়া রপ্তানি করার জন্য, বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানিকারকদের প্রয়োজনীয় দুটি সনদের কোনটিই নেই। কিছু কিছু দেশে বাংলাদেশের পণ্য সামান্য পরিমানে ঢুকলেও, সন্তোষজনক দাম পাওয়া যাচ্ছে না।

চামড়ার দাম কমছে কেন ?

অতীতে বাংলাদেশের চামড়া শিল্প ছিল ঢাকার হাজারিবাগ কেন্দ্রিক। বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের অন্যতম কারণও ছিল হাজারিবাগের এই চামড়া শিল্প। পরিস্থিতির উন্নতির জন্যই ২০১৭ সালে পুরান ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সরিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরীতে স্থানান্তর করা হয়। হাজারিবাগে ২০৫টি কারখানা থাকলেও, সাভারে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় মাত্র ১৫০টি। তারমানে চামড়া শিল্প স্থানান্তরের সময়ই ৫৫ টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে চামড়া রপ্তানি কমে যাওয়া, বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়া, অবৈধভাবে চামড়া পাচার সহ নানা ধরনের অসুবিধা তৈরী হয়। ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে সাভারে যে চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্যই ছিল পরিবেশগতমান উন্নয়ন করা।  কিন্তু সাভারেও টেকসই চামড়া শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।

লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ এর সার্টিফিকেট পেতে ১৩৬৫ নম্বরের মান যাচাই প্রক্রিয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশ কুটির শিল্প কর্পোরেশন বা বিসিক পেয়েছে মাত্র ২০০ নম্বর। তারমানে সনদ পেতে ১১৬৫ নম্বরের ঘাটতি রয়েছে। সেকারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রক্রিয়াজাত প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম যেখানে ৫ থেকে ৬ ডলার, সেখানে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা পাচ্ছে মাত্র দেড় থেকে ২ ডলার।

পরিবেশগত সার্টিফিকেট না থাকার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়া কেউ নায্য দামে কিনতে চায় না। সেজন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় ২০-৫০ শতাংশ কম মূল্য পাচ্ছে বাংলাদেশ। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশী চামড়াজাত পন্য কেউ কিনতেই চায় না।

বর্তমানে বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু আমরা সেই মুনাফা অর্জন করতে পারছি না। বাংলাদেশ যতদিন পর্যন্ত চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে পরিবেশ বান্ধব আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে না পারবে, ততদিন চামড়াশিল্পে স্থিতিশীলতা আসবে না। সেই সাথে দেশেও চামড়ার প্রকৃত মূল্য নিশ্চিত করা যাবে না।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কারা ?

ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী, কোরবানির চামড়া বিক্রির টাকা কোরবানিদাতা ভোগ করতে পারেন না। চামড়া বিক্রির পুরো টাকাই নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণীর মানুষের মধ্যে দান করে দিতে হয়। সাধারণত অতি দরিদ্র এবং এতিম মিসকিনদের এই টাকা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে কোরবানির চামড়া বিক্রির টাকা, সবচেয়ে বেশি দান করা হয় ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। বিশেষ করে যেসব কওমি ও হাফেজি মাদরাসায়, লিল্লাহ বোর্ডিং আছে। অর্থাৎ যেসব মাদরাসায় অতি দরিদ্র এবং এতিম ছাত্ররা বিনামূল্যে আবাসিকে থেকে পড়ালেখা করে।

যুগ যুগ ধরে এসব মাদরাসা ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের দানেই চলে আসছে। এ জাতীয় মাদরাসা সাধারণত সরকারের তেমন সহযোগিতা পায় না। তাই জাকাতের অর্থ এবং কোরবানির পশুর চামড়ার টাকাই এসব মাদরাসার বার্ষিক আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু কোরবানির চামড়ার দাম কমে যাওয়ার কারণে, এসব প্রতিষ্ঠানের আয় উল্লেখ্যযোগভাবে কমে গেছে। সেজন্য কোরবানীর চামড়ার দাম কমে যাওয়ার কারণে, দেশের কওমি মাদরাসাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্যানারি মালিকরা ভালো মুনাফা করতে পারছে না, ফলে মাদ্রাসাগুলোও ভালো দামে চামড়া বিক্রি করতে পারছে না।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, প্রতি বছরই একটু একটু করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি কমেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবি’র তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে চামড়া রফতানি ৮.২৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১০৭.৬১ মিলিয়ন ডলারে, যা গত অর্থবছরে ছিল ১১৭.২৭ মিলিয়ন ডলার।

কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়ে না ওঠায় লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ পাচ্ছে না বাংলাদেশ। যার ফলে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ও পণ্য উৎপাদনে আন্তর্জাতিক পরিসরে ভালো করতে পারছে না বাংলাদেশের সিংহভাগ কোম্পানি।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।