চাঁদের মাটি থেকে জ্বালানী
চাঁদের মাটি থেকে জ্বালানী
বর্তমান পৃথিবীতে জ্বালানী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। জ্বালানীর মত সম্পদ থাকার কারণে রাশিয়া উইক্রেনের উপর এতবড় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েও অনায়াসে টিকে আছে। জ্বালানী সম্পদের প্রচুর্যতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের হত দরিদ্র জেলে পল্লীগুলো আজ, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। জ্বালানীর অভাবে বাংলাদেশে মাত্রাতিরিক্ত লোড শেডিং হচ্ছে এবং জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের সকল পণের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। এরকমভাবে পৃৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি জ্বালানীর উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। হতাশার বিষয় হল এই পৃথিবীর সঞ্চিত খনিজ জালানী খুব শীঘ্রই ফুরিয়ে যাবে। গবেষণায় দেখা যায়, খনিজ তেলের মজুদ আগামী ৫০ বছর, প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ৫৩ বছর এবং কয়লার মজুদ ১১৪ বছর পর সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাবে। সেজন্য বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশ গুলো জ্বীবাশ্ন জ্বালানীর বিকল্প খুঁজে বের করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। পৃৃৃথিবীর জ্বালানী সমস্যার মত ভয়াবহ পরিস্থিতির এক অসাধারণ বিকল্প আছে চাঁদের মাটিতে। মহা মূল্যবান সেই পদার্থের নাম হিলিয়াম-৩। চাঁদের হিলিয়াম-৩ দিয়ে এত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে, যা দিয়ে পৃথিবী ১০ হাজার বছর চলতে পারবে। এই হিলিয়াম-৩ র খোঁজেই সাম্প্রতিক সময়ে, বিশ্বের বহু দেশ আবারো চাঁদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
১৯৬৯ সালে এপলো ১১ চাঁদে অবতরণ করার পর থেকে চাঁদে যাওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যায়। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত, ইজরায়েলের মত দেশ নতুন করে চাঁদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এবার চাঁদে যাওয়ার উদ্দেশ্য হল চাঁদের মাটিতে থাকা খনিজ পদার্থ আহরণ করা। চাঁদের মাটিকে বলা হয় রেগোলিথ। এর মধ্যে আছে সিলিকন, টাইটেনিয়াম, এলুমিনিয়াম, পানি, বহু মূল্যবান ধাতু এবং হিলিয়াম-৩। অন্যান্য সকল বিষয়ের চেয়ে এখন হিলিয়াম-৩ সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতীতে যতবার চাঁদে অভিযান পরিচালনা করেছে, ততবারই তারা চাঁদের মাটির নমুনা সংগ্রহ করেছে। প্রতিটি নমুনাতেই হিলিয়াম-৩ পাওয়া গেছে। এই পদার্থ আমাদের সমগ্র পৃথিবীর জ্বীবাশ্ন জ্বালানীর উপর নির্ভরশীলতা অস্বাভাবিক হারে কমিয়ে দিতে পারে। হিলিয়াম-৩ ব্যবহার করে নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। এই উপাদান পারমানবিক চুল্লীর জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। বর্তমান সময়ের পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোতে ইউরেনিয়াম-২৩৫ কে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইউরেনিয়াম তেজষ্ক্রিয় পদার্থ হাবার কারণে, এই প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদনের পাশাপাশি, তেজষ্ক্রিয়তাও ছড়িয়ে পড়ে। সেজন্য পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য মাটির নিচে বিশেষ নিরাপত্তার সাথে সংরক্ষণ করতে হয়। তাই এসব শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র গুলো অনেকটাই বিপদজনক।
দীর্ঘ ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, গবেষকেরা একটি বিশেষ ধরনের পারমানবিক চুল্লীর নকশা করার চেষ্টা করছেন। যাতে করে, পারমানবিক বিক্রিয়ায় কোন ধরনের তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ ছাড়াই, নিরাপদ এবং দীর্ঘস্থায়ী সামাধান বের করা যায়। পারমানবিক চুল্লিতে, ইউরেনিয়ামের পরিবর্তে ডিউটেরিয়াম ব্যবহার করে, এর সাথে হাইড্রোজেনের আইসোটপ ট্রিটিয়ামের মত হালকা গ্যাসের বিক্রিয়া ঘটিয়ে, একধরনের নিরাপদ শক্তি অর্জন করা যায়। এই বিক্রিয়ায় কোন ধরনের তেজষ্ক্রিয়তা এবং পারমানবিক বর্জ্য উৎপন্ন হয় না। কিন্তু এই বিক্রিয়ায় একটি সমস্যা আছে, আর তা হল, বিক্রিয়া শুরু হবার পর প্রথম যে নিউট্রন নির্গত হয়, তাকে ধারণ করা খুব কষ্ট সাধ্য, সেজন্য এই প্রক্রিয়ায় বিপুল শক্তির অপচয় হয়। আর এখানেই হিলিয়াম-৩ এর বিশেষত্ব। হিলিয়াম-৩ ব্যবহার করে এই সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান পাওয়া সম্ভব। হিলিয়াম-৩ এর সাথে ডিটেরিয়াম এর ফিউশন ঘটালে, এই বিক্রিয়ায় কোন মুক্ত নিউট্রন উৎপন্ন হয় না। এক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায় এবং বিক্রিয়ার পর একটি প্রোটন মুক্ত অবস্থায় থাকলেও, তাকে নিয়ন্ত্রন করা তুলনামূলক অনেক সহজ। হিলিয়াম-৩ কে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করলে তেমন কোন বর্জ্য উৎপন্ন হয় না এবং পারমানবিক বিক্রিয়ায় ফলে কোন ধরনের তেজষ্ক্রিয়তাও ছড়ায় না। নিউক্লিয়ার ফিশন রিএক্টরে হিলিয়াম-৩ ব্যবহার করলে, পারমানবিক শক্তির সর্বোচ্চ নিরাপদ ব্যবহার সম্ভব। এই ধরনের রিএক্টর বা পারমানবিক চুল্লী নির্মানের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আশা করা যাচ্ছে ২০৩৫ সালের মধ্যে এই ধরনের সর্বপ্রথম রিএক্টর কাজ শুরু করতে পারবে। এই সময়ের মধ্যেই পর্যাপ্ত হিলিয়াম-৩ সংগ্রহ করা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।
হিলিয়াম-৩ সংগ্রহের জন্য কেন চাঁদেই যেতে হবে? এর কারণ হল, হিলিয়াম-৩ পৃথিবীতে খুবই দুর্লভ। সাধারণত প্রাকৃতিক গ্যাসের খনিতে হিলিয়াম-৩ পাওয়া গেলেও, তার পরিমাণ অতি নগন্য। যেমন, প্রায় ১০০ কোটি ঘনফুট ঘ্যাসের মধ্যে মাত্র ১৫ কেজি হিলিয়াম-৩ পাওয়া যেতে পারে। সেজন্য পৃথিবী থেকে হিলিয়াম-৩ সংগ্রহ করা বানিজ্যিকভাবে মোটেও লাভজনক নয়। এছাড়া কৃত্রিমভাবে হাইড্রোজেন বোমার মত মারাত্নক পারমানবিক অস্ত্রের বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে হিলিয়াম-৩ উৎপন্ন করা যায়। কিন্তু এধরনের উৎস থেকে পর্যাপ্ত হিলিয়াম-৩ পাওয়া সম্ভব নয় এবং তা পৃথিবীর জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর। প্রাকৃতিক হিলিয়াম-৩ র প্রধান উৎস হল সূর্য। সৌরবায়ুর মাধ্যমে সেসব হিলিয়াম-৩ মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর বায়ু মন্ডল হিলিয়াম-৩ কে পৃথিবীতে প্রবেশ করতে বাঁধা দেয়। কিন্তু চাঁদের কোন বায়ুমন্ডল না থাকার কারণে, লক্ষ কোটি বছর ধরে চাঁদের মাটিতে বিপুল পরিমাণ হিলিয়াম-৩ জমা হয়েছে। ধারণা করা হয়, চাঁদের মাটিতে প্রায় ১২ লক্ষ মেট্রিকটন হিলিয়াম-৩ রয়েছে। যা পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১০ কোটি গুণ বেশি।
হিলিয়াম-৩ যেমন একটি বিশেষ কাজে ব্যবহার করে, মানব সভ্যতাকে বদলে দেয়া যাবে। তেমনিভাবে পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত ১১৮টি মৌলিক পদার্থ প্রতিনিয়ত আমাদের নানা প্রয়োজনে কাজে লাগছে। সুউচ্চ পর্বত থেকে শুরু করে সুবিশাল সমুদ্র, আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসে গ্রহণ করা বাতাস থেকে শুরু করে যেসব খাবার আমরা গ্রহণ করি, সব কিছুই মাত্র ১১৮ টি মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরী। তাই পৃথিবীকে জানতে হলে এবং বিজ্ঞানকে বুঝতে হলে আপনার অবশ্যই এই মৌলিক পদার্থগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।
বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন, চাঁদের হিলিয়াম-৩ ব্যবহার করে, এত পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা যাবে, যা দিয়ে পৃথিবী ১০ হাজার বছর চলতে পারবে। সাধারণ একটি মহাকাশ যানে প্রায় ২৫ টন হিলিয়াম-৩ পরিবহণ করা যাবে। এই পরিমাণ হিলিয়াম-৩ দিয়ে বাংলাদেশের ৫৫ বছরের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব। একটন হিলিয়াম-৩ র দাম হতে পারে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকার সমান। এত মূল্যবান বস্তু হবার কারণে, চাঁদের মাটি থেকে হিলিয়াম-৩ খনন করা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে। সেজন্যই পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলো নতুন করে চাঁদে যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা ২০২৪ সালের মধ্যে চাঁদে আবারো মানুষ পাঠাবে। অন্যদিকে রাশিয়ান মহাকাশ সংস্থা রসকসমোস প্রথমবারের মত চাঁদে মানুষ পাঠাবে ২০৩০ সালে। তারা এমন এক মহাকাশ যান তৈরী করছে যাতে করে চাঁদ থেকে ১১৩ টন মালামাল পরিবহণ করা সম্ভব হয়। চীনের মহাকাশ সংস্থা সিএনএসএ আগামী ১০ বছরের মধ্যে, চাঁদে শুধু মানুষই পাঠাবে না, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে চীনারা তাদের স্থায়ী ঘাঁটিও তৈরী করবে। তাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যই হল চাঁদের মাটি থেকে হিলিয়াম-৩ আহরণ করা। ভারতের চন্দ্রযান-২ অভিযানেরও একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল হিলিয়াম-৩ নিয়ে গবেষণা করা। এছাড়া ইসরায়েলও চাঁদের খনিজ সম্পদ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করছে। আশা করা যাচ্ছে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই চাঁদের খনিজ সম্পদ অহরণ করার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হবে। এর মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে।