চকলেটের দাস আফ্রিকার কোকো চাষের করুণ বাস্তবতা

maxresdefault
সত্যের খোঁজে

চকলেটের দাস আফ্রিকার কোকো চাষের করুণ বাস্তবতা

ভূমিকা

বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় একটি খাবার চকলেট। সবার পছন্দের রোমান্টিক এই খাবারের পেছনে লুকিয়ে আছে এক করুণ বাস্তবতা। সুস্বাদু চকলেটের প্রধান উপাদান কোকো; আইভরি কোস্ট, ঘানা, নাইজেরিয়া এবং ক্যামেরুনের মত পশ্চিম আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলো থেকে আসে। এসব আফ্রিকার দেশগুলোই মূলত বিশ্বের প্রায় ৭০% কোকো সরবরাহ করে। কিন্তু এই ফল উৎপাদনের পেছনে রয়েছে কোকো চাষীদের অমানবিক শ্রম, ন্যূনতম পারিশ্রমিক এবং জীবনের ঝুঁকি।  

চকলেটের ইতিহাস

চকলেটের ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরনো। প্রায় ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকা অঞ্চলের ওলমেক সভ্যতায় কোকো বীজের ব্যবহার শুরু করে। তবে এটি মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতায় এসে জনপ্রিয় হয়।

মায়ারা কোকো বীজ থেকে “xocoatl” (শো-কো-আটল) নামের এক ধরনের পানীয় তৈরী করত। xocoatl অর্থ তেতো পানীয়। এই xocoatl থেকেই “চকলেট” শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। এই পানীয় মশলা, মরিচ ও মধু দিয়ে তৈরি হতো এবং ধর্মীয় আচার, বিবাহ ও উৎসবে ব্যবহৃত হতো। কোকো বীজ মায়াদের কাছে এত মূল্যবান ছিল যে এটি মুদ্রা হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। অ্যাজটেকরা কোকোকে “দেবতার খাদ্য” মনে করত এবং এটি শুধু অভিজাত শ্রেণি ও যোদ্ধারাই পান করতে পারত।

ইউরোপে চকলেটের আগমন ঘটে ১৫০২ সালে। সেসময় ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা থেকে কোকো বীজ নিয়ে ইউরোপে ফিরে আসেন, তবে এটি তখন তেমন গুরুত্ব পায়নি। পরে, ১৫১৯ সালে স্প্যানিশ অভিযাত্রী হার্নান কোর্টেস অ্যাজটেকদের কাছ থেকে কোকো সম্পর্কে জানেন এবং স্পেনে এটি প্রচার করেন।

স্পেনে কোকো পানীয় তৈরি করা হতো চিনি ও ভ্যানিলা মিশিয়ে, যা তেতো স্বাদকে মিষ্টি করে তুলত। ১৬শ শতাব্দীতে এটি স্প্যানিশ রাজপরিবার ও অভিজাতদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়। ধীরে ধীরে চকলেট ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

চকলেটের রূপান্তর

১৮২৮ সালে ডাচ রসায়নবিদ কনরাড ভ্যান হাউটেন কোকো প্রেস আবিষ্কার করেন, যা কোকো বীজ থেকে কোকো বাটার আলাদা করতে পারত। এটি কোকো পাউডার তৈরির পথ সুগম করে এবং চকলেট পানীয়কে আরও সহজলভ্য করে। ১৮৪৭ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি ফ্রাই অ্যান্ড সন্স প্রথম ভোজ্য চকলেট বার তৈরি করে। এটি ছিল কঠিন চকলেট, যা কোকো পাউডার, চিনি ও কোকো বাটারের মিশ্রণে তৈরি।

১৮৭৫ সালে সুইস চকলেট প্রস্তুতকারক ড্যানিয়েল পিটার এবং হেনরি নেসলে মিল্ক চকলেট তৈরি করেন, যা দুধের গুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি হতো। এটি চকলেটকে আরও মসৃণ ও জনপ্রিয় করে তোলে। ১৯শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিরা তাদের চকলেটের কাঁচামালের চাহিদা মেটানোর জন্য আফ্রিকায় কোকো চাষ শুরু করে।

২০শ শতাব্দীতে মার্স, হার্শে, নেসলে ও ক্যাডবেরির মতো কোম্পানি, বিভিন্ন ধরনের চকলেট বার, ক্যান্ডি ও ডেজার্ট তৈরি করে বিশ্বব্যাপী চকলেট শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করেছে। বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের মানুষ সবচেয়ে বেশি চকলেট খায়। একজন সুইস নাগরিক বছরে গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১১ কেজি চকলেট খেয়ে থাকে। তবে জার্মানি হল বিশ্বের সর্ববৃহৎ চকলেট উৎপাদনকারী দেশ। জার্মানি প্রতিবছর প্রায় ৫.৬১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চকলেট রপ্তানি করে। এছাড়া সবচেয়ে সেরা চকলেট উৎপাদনের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে বেলজিয়াম। ইউরোপের দেশগুলো সুস্বাদু চকলেটের বিষয়ে এতটাই আগ্রহী যে, বেশ কিছু দেশে রীতিমত চকলেট ইঞ্জিনিয়ারিং এর মত বিশেষ সাবজেক্টও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়।

চকলেটের দাস

পশ্চিমাদের চকলেট বিলাসের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে, চকলেটের কাঁচামাল উৎপাদক পশ্চিম আফ্রিকার গবির দেশগুলোকে। আইভরি কোস্টে বিশ্বের প্রায় ৪০% কোকো উৎপন্ন হয়। এখানকার প্রায় ৬০ লাখ মানুষ কোকো শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তারা বছরে প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন কোকো উৎপাদন করে।

আইভরি কোস্টের চাষীরা দৈনিক গড়ে ০.৫০ থেকে ১ ডলারের মতো আয় করেন। যা বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত দারিদ্র্যসীমার তুলনায় অনেক কম। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন কোকো চাষীকে ৩ টন কোকো বীজ সংগ্রহ করতে হয় মাত্র ১ ডলার পারিশ্রমিকের জন্য, যা প্রায় ১২ ঘণ্টার কঠোর পরিশ্রমের সমতুল্য। তাছাড়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কোকো উৎপাদক দেশ ঘানার অর্থনীতির বড় একটি অংশই কোকো রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। ঘানা সরকার ন্যায্য দামে কোকো কেনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় বোর্ড পরিচালনা করলেও, প্রান্তিক চাষীেদর ভাগ্যের কোন উন্নতি হয়নি।

নেসলে, হার্শে এবং মার্স এর মত বড় বড় কম্পানিগুলো কোকোর দাম কমিয়ে রাখে, যাতে তারা বেশি লাভ করতে পারে। শীর্ষস্থানীয় চকলেট কোম্পানিগুলোর মধ্যে Mars একাই ২০২৩ সালে ২২ বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব অর্জন করেছে। এরপর রয়েছে Mondelez International ১৪.৪ বিলিয়ন ডলার, Ferrero Group ১৩.৮ বিলিয়ন ডলার, Hershey Co ১০.৩ বিলিয়ন ডলার এবং Nestlé ৮.৪৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেওয়ার বেলায় তারা কার্পণ্য করে।

শুধু কম পারিশ্রমিকের কষ্টই নয়, কোকো চাষ একটি বিপজ্জনক কাজ, যেখানে চাষীদের প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়। কোকো গাছ সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জন্মায়, যেখানে চাষীরা প্রচণ্ড গরম, উচ্চ আর্দ্রতা এবং বিষাক্ত পোকামাকড়ের মুখোমুখি হন। এছাড়া, তারা প্রায়শই ধারালো মাচেটের মতো সরঞ্জাম ব্যবহার করে, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়। চাষীরা ব্যাপক কীটনাশকের সংস্পর্শে আসেন, যা তাদের শ্বাসকষ্ট, ত্বকের রোগ এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়।

কোকো চাষের আরেকটি গুরুতর সমস্যা হলো শিশুশ্রম। আইভরি কোস্ট এবং ঘানায় প্রায় ২০ লক্ষেরও বেশি শিশু কোকো চাষে কাজ করে, যাদের মধ্যে অনেকে ৫ বছরের কম বয়সী। এই শিশুরা বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করে, ভারী বোঝা বহন করে এবং স্কুলে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। কিছু ক্ষেত্রে, বুরকিনা ফাসোর মতো প্রতিবেশী দেশ থেকে শিশুদের পাচার করে কোকো খামারে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করানো হয়। এছাড়া, পূর্ব কঙ্গোর মতো অঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠী কোকো খামার দখল করে চাষীদের হুমকির মুখে কাজ করতে বাধ্য করে। এই কোকো পরে অবৈধভাবে উগান্ডায় পাচার হয় এবং আন্তর্জাতিক চকলেট কোম্পানির কাছে বিক্রি হয়।

পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ

কোকো চাষের আরেকটি বড় সমস্যা হলো পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ। পশ্চিম আফ্রিকায় চরম আবহাওয়া, যেমন খরা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, কোকো উৎপাদনকে ব্যাহত করেছে। ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে কোকোর ঘাটতি ৫ লাখ টনে পৌঁছেছিল, যা চকলেটের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এই দাম বৃদ্ধির সুবিধা চাষীদের কাছে পৌঁছায় না, কারণ মধ্যস্থতাকারী এবং কোম্পানিগুলোই বেশিরভাগ লাভ গ্রহণ করে।

উপরন্তু, নতুন বন ধ্বংস প্রতিরোধ আইন কোকো বাগান সম্প্রসারণে বাধা সৃষ্টি করছে, যা সরবরাহ আরও সীমিত করছে। এই পরিস্থিতি চাষীদের জন্য আরও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে, কারণ তারা উৎপাদন বাড়াতে পারছে না।

বড় চকলেট কোম্পানিগুলো তাদের সাপ্লাই চেইন স্বচ্ছ করতে কিছু পদক্ষেপ নিলেও; এখনও অধিকাংশ কোকো বিজ সংগ্রহ করা হয় অমানবিক প্রক্রিয়ায়। চকলেটের বিশাল আন্তর্জাতিক বাজারে কোটি কোটি ডলার লেনদেন হলেও, এর আসল কারিগরদের ভাগ্যে জোটে অবহেলা আর দারিদ্র্য।

ইউরোপ আমেরিকা সহ বিশ্ববাসীর মুখে বিলাসিতার এই খাবার তুলে দিতে গিয়ে, আফ্রিকার চাষিরা কার্যত চকলেটের দাস” হয়ে পড়েছে। জীবন বিপন্ন করা কঠিন শ্রম দিয়েও, তারা নিজেদের মৌলিক চাহিদা টুকুও মেটাতে পারে না। অথচ প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চকলেট বিক্রি হয়। এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে, আফ্রিকার কোকো চাষিরা আরও গভীর দাসত্বের জালে জড়িয়ে পড়বে।

চকলেটের মতই হাজার বছরের পুরোনো আরেকটি সুস্বাদু খাবার হল ক্যাভিয়ার। বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার সম্পর্কে আলোচনা করলেই সবার আগে উঠে আসবে ক্যাভিয়ারের নাম। কারণ মাত্র এক কেজি ক্যাভিয়ারের দাম প্রায় ২৫ লাখ টাকারও বেশি হতে পারে। ক্যাভিয়ার কিভাবে উৎপন্ন করা হয় এবং ক্যাভিয়ারের দাম এত বেশি কেন, সে সম্পর্কে জানতে চাইলে কিকেনকিভাবে র এই ভিডিওটি দেখতে পারেন।

কিকেনকিভাবে র পরবর্তী ভিডিও আপলোড হওয়ার সাথে সাথে দেখতে চাইলে, কিকেনকিভাবে সাবস্ক্রাইব করে বেল আইকনটিতে ক্লিক করুন।

আফ্রিকার কোকো চাষীরা কিভাবে চকলেটের দাস হয়ে পড়েছে ?

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।