গাজায় অনাহার গণহত্যা

maxresdefault (30)
জীবনযাপন

গাজায় অনাহার গণহত্যা

মৃত্যুপুরী গাজা

গত প্রায় দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ড এক ভয়াবহ মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে। একদিকে আকাশ থেকে বোমা ফেলে ধ্বংস করা হচ্ছে ঘরবাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল। আর অন্যদিকে মাটিতে জমেছে ক্ষুধার্ত মানুষের নিথর দেহ। যুদ্ধের ভয়াল রূপ শুধু গোলাবারুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; তার চেয়েও নীরব, নিষ্ঠুর এক অস্ত্র হয়ে উঠেছে ক্ষুধা।

শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়ানো নিরস্ত্র মানুষজন, যারা শুধু একমুঠো খাবারের আকুতি জানাচ্ছে, তাদেরকেই লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালানো হচ্ছে। এইসব মানুষের অপরাধ একটাই, তারা গাজায় জন্মেছেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন।

দীর্ঘ সময় ক্ষুধাজনিত অপুষ্টির কারণে শিশুদের শরীর দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, চামড়া হাড়ে আটকে যাচ্ছে, মুখের ভাষা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে দুর্বলতায়। যেসব শিশু এখনো বেঁচে আছে, তারা যেন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকেই হাঁটছে। জীবিত থাকলেও তাদের চোখে মুখে এক ধরণের নীরব মৃত্যুবোধ জমে আছে।

বিশ্ব মানবতা এই সবকিছুর সাক্ষী হলেও, বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং সংস্থা ‘গভীর উদ্বেগ’ আর ‘কঠোর নিন্দা’ জানানো ছাড়া, এই মৃত্যু থামাতে বাস্তব কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। একদিকে চলছে দ্বিরাষ্ট্র ব্যবস্থার অালাপ, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি আর গাজায় যুদ্ধ বিরতির আলোচনা আর অন্যদিকে প্রতিনিয়ত গাজায় প্রাণ যাচ্ছে শিশুদের, নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন পরিবার।

গণহত্যার সংজ্ঞা কেবল বন্দুকের গুলি বা বোমার শব্দেই সীমাবদ্ধ নয়। ইসরায়েল যেভাবে গাজার খাদ্য সহায়তা বন্ধ করে, ত্রাণ পৌঁছাতে বাঁধা দিয়ে, মানুষকে না খাইয়ে মারছে; এটি গণহত্যার একটি সম্পূর্ণ নতুন রূপ সৃষ্টি করেছে। একে বলা হচ্ছে ‘famine by design’—অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্যের অভাব সৃষ্টি করে ধীরে ধীরে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কৌশল।

ইসরায়েল কিভাবে ক্ষুধা দিয়ে মানুষ মারছে ?

ইসরায়েলের মারণকল

গাজায় যখন প্রতিদিন মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছে, তখন সেখানে ‘মানবিক সহায়তা’ পৌঁছানোর নামে চালু হয়েছে একটি নতুন সংগঠন Gaza Humanitarian Foundation, সংক্ষেপে GHF। নামটি শুনলে মনে হতে পারে, এটি বুঝি কোনো নিরপেক্ষ, সহানুভূতিশীল সংস্থা যারা ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। Gaza Humanitarian Foundation ছাড়া জাতিসংঘ বা অন্যকোন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ইসরায়েল ত্রাণ বিতরণ করার সুযোগ দেয় না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই GHF মূলত ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে গড়ে ওঠা একটি প্রতারণামূলক উদ্যোগ। GHF তৈরীই করা হয়েছে ত্রাণ প্রদানের নাটক করার জন্য, গাজাবাসীকে বাঁচানোর জন্য নয়। এর কার্যক্রম চালানো হয় এমনভাবে, যেন আন্তর্জাতিক মহলের চোখে মনে হয় ইসরায়েল ত্রাণ দিয়ে সহায়তা করছে, মানবিক সহনশীলতা দেখাচ্ছে। অথচ বাস্তবে, এই ‘ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র’গুলোই আজ অনেকের জন্য মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই কেন্দ্রগুলোর অবস্থান নিয়েও উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। প্রায় সব কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে সামরিক এলাকার কাছাকাছি, যেখানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নজরদারি থাকে সবসময়। ফলে খাবার নিতে আসা মানুষগুলোও একরকম অরক্ষিত অবস্থায় থাকে। কোথা থেকে কখন গুলি আসবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বহু মানুষ এসব ত্রাণ কেন্দ্রের আশেপাশেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে।

পুষ্টিবিদদের মতে, এসব ত্রাণে শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো সুষম খাদ্য নেই। ‘রেডি-টু-ইট’ ধরনের খাবার নেই, নেই অপুষ্ট শিশুদের জন্য উপযোগী বিশেষ ফুড সাপ্লিমেন্ট। ময়দা, চাল, তেল আর কিছু ডালের মত খাবার এত সীমিত পরিমাণে দেওয়া হয়, যাতে সবাই না পায়। তাছাড়া এসব খাবার রান্না করার মত উপকরণ বা জ্বালানীও নেই গাজাবাসীর কাছে।

এই কেন্দ্রগুলোতে নেই কোনো চিকিৎসাসেবা, নেই প্রশিক্ষিত কর্মী, নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা। ফলে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, বা শিশুদের জন্য এই ‘ত্রাণ লাইন’ যেন মৃত্যুর লাইনে দাঁড়ানোর মতোই ভয়ংকর।

GHF-এর মতো এই তথাকথিত ‘মানবিক’ উদ্যোগগুলোকে এখন অনেকেই বলছেন “মারণকল”। আমরা যেমন সামান্য খাবার দিয়ে ঘরের ইঁদুর মারি, ঠিক একইভাবে ইসরায়েলী বাহিনী Gaza Humanitarian Foundation এর ত্রাণের লোভ দেখিয়ে ফিলিস্তিনীদের উপর চালাচ্ছে দীর্ঘ পরিকল্পিত নিধনযজ্ঞ।

অনাহারের গণহত্যা

গাজায় যা ঘটছে, তা শুধু যুদ্ধ নয়, শুধু গোলাবারুদের তাণ্ডব নয়—এটি এক নীরব, পরিকল্পিত গণহত্যা। বিশ্বখ্যাত দুর্ভিক্ষ বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স ডি ওয়াল একে বলেন “famine by design”—অর্থাৎ পূর্বপরিকল্পিত অনাহার। তার ভাষায়, “এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্যপ্রবাহ বন্ধ করে একটি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করা হয়।” আর এই ধ্বংস যজ্ঞে ইন্ধন যোগায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আর পাশ্চাত্য রাজনৈতিক সুবিধাবাদীরা।

এই ‘নিরব যুদ্ধের’ সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে গাজার শিশুরা। শুধু গত কয়েক মাসেই শত শত শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে মারা গেছে। অনেকেই ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে বা খাবার আনতে গিয়ে গুলিতে মারা গেছে।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষ না খেয়ে ৬০ থেকে ৮০ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে সময়টা অনেক কম। তাদের শরীর এতটাই নরম ও দুর্বল যে তারা অপুষ্টি, ডায়রিয়া, সংক্রমণ বা সামান্য জ্বরেই মারা যাচ্ছে। যে বয়সে তারা দুধ, শাকসবজি বা পুষ্টিকর খাবার খেয়ে বেড়ে উঠবে, সে বয়সেই তারা জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে স্রেফ একমুঠো খাবার না পেয়ে।

এই প্রক্রিয়া কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি পরিকল্পিত। ইসরায়েলী বাহিনী Gaza Humanitarian Foundation এর মাধ্যমে যতটুকু খাদ্য গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেয়। ইসলায়েলী উগ্রপন্থী ইহুদিরা সেই খাবারও গাজায় ঢুকতে দেয় না। এসব ইসরায়েলী সন্ত্রাসীরা অনাহারে থাকা শিশুদের ত্রাণ হয় নষ্ট করে ফেলছে অথবা ত্রাণের ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।

গাজা গণহত্যা

গাজায় ইসরায়েল যে ভয়াবহ ও পরিকল্পিত গণহত্যা চালাচ্ছে, তা নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। অথচ পাশ্চাত্যের বড় বড় রাষ্ট্র, যারা নিজেদের ‘সভ্যতা’র ধারক বলে পরিচয় দেয়, তারা এই নির্মম সত্যটিকে স্বীকার করতে চায় না। বরং তারা গণহত্যার সংজ্ঞাকে নতুন করে ব্যাখ্যা করে ইসরায়েলের অপকর্ম আড়াল করতে ব্যস্ত।

সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস এর একটি প্রবন্ধে দাবি করা হয়, “না, গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা চালায়নি।” এখানে বলা হয়, ইসরায়েল যদি সত্যিই পূর্ণ কৌশল নিয়ে পুরো গাজা জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করতে চাইত, তাহলে নিহতের সংখ্যা লক্ষ ছাড়িয়ে যেত। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধ যত ভয়াবহই হোক না কেন, এটিকে গণহত্যা বলা যায় না।

কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। আনুষ্ঠানিক হিসেবে বলা হচ্ছে ইতোমধ্যে গাজায় ৬০ হাজারের মতো মানুষ মারা গেছে, যার মধ্যে ১৭ হাজারেরও বেশি শিশু। কিন্তু মেডিকেল জার্নাল “The Lancet”-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, গাজায় মৃত মানুষের সংখ্যা এক লাখ ৮৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ, ইসরায়েলের সরাসরি বোমা হামলায় ও পরোক্ষভাবে ক্ষুধা, চিকিৎসার অভাব, পানিশূন্যতা এবং অনাহারে মৃত্যু মিলিয়ে মোট মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা সরকারিভাবে ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে। সেই সাথে প্রতিদিন নতুন নতুন মৃত্যুর খবর আসছে, এমনকি অনেক লাশ শনাক্তও করা যাচ্ছে না। হাসপাতাল ভেঙে পড়েছে, খাদ্য ও চিকিৎসাসেবার অভাবে মানুষ দলে দলে মারা যাচ্ছে।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, এবার প্রতিবাদ শুধু বাইরের নয়, বরং ইসরায়েলভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থার ভেতর থেকেও এসেছে। ‘বতেসেলেম’ ও ‘ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস’ নামের ইসরায়েলি দুই প্রভাবশালী সংগঠন একযোগে বলেছে, গাজায় যা ঘটছে, তা নিছক যুদ্ধ নয়—এটি একটি সম্পূর্ণ জাতিকে ধ্বংস করার ধারাবাহিক পরিকল্পনা।

তাদের ভাষায়, গাজাবাসীদের শুধু শারীরিকভাবে নয়, বরং তাদের অস্তিত্ব, অধিকার ও ভবিষ্যৎকেও ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এসব হামলা চালানো হচ্ছে। ইসরায়েলী মানবাধিকার সংস্থা আরও বলেছে, এই পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞে ইসরায়েল একা নয়, তার পাশ্চাত্য মিত্ররাও এর সাথে জড়িত। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যারা সামরিক সহায়তা, অস্ত্র এবং রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে ইসরায়েলের গণহত্যাকে কার্যত অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে।

এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে—বিশ্ববিবেক কি কেবল সংবাদপত্রে নিন্দা আর বিবৃতি দিয়েই চুপ থাকবে? না কি এবার সত্যিকার অর্থে মানবতা রক্ষার নামে কিছু একটা করবে?

দ্বিরাষ্ট্র সমাধান

জাতিসংঘ আবারো আলোচনায় ফিরেছে বহু পুরোনো এক রাজনৈতিক প্রস্তাব—’দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান’। অর্থাৎ, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল—দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। ফ্রান্স এবং ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই স্বীকৃতিগুলো আসলে কতটা বাস্তবসম্মত, আর কতটা প্রতীকী নাটক?

গাজার রাস্তায় প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকেই শিশু, অনেকেই বৃদ্ধ, যাদের কোনো যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই। খাদ্য নেই, চিকিৎসা নেই, বিদ্যুৎ নেই, স্কুল নেই। মানুষ কেবল বেঁচে থাকার লড়াই করছে। এবং এই ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে এমন একটি উদ্দেশ্য নিয়ে, যার ফলে ফিলিস্তিন যেন আর কোন দিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে না পারে।

এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সম্মেলনগুলো যতই উচ্চমার্গের কূটনৈতিক ভাষায় পূর্ণ হোক না কেন, সেগুলো কখনও বাস্তবতার মুখ দেখবে না।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।