কোহিনূর এক অভিশপ্ত হীরা

maxresdefault (26)
জীবনযাপন

কোহিনূর এক অভিশপ্ত হীরা

পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল আলোচিত হীরা কোহিনূর। এই হীরক খন্ডটির আছে দীর্ঘ এবং বর্ণাঢ্য ইতিহাস। সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন সম্রাটের হাত ঘুরে কোহিনূর অবশেষে কুখ্যাত লুটতরাজ ব্রিটিশ রাজ বংশের হাতে এসে পড়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে কোহিনূর মুঘলদের অধিকারে ছিল ২০০ বছর, আফগানদের অধিকারে ছিল ৬৬ বছর এবং বর্তমানে প্রায় ১৭৩ বছর ধরে ব্রিটিশ দের অধিকারে আছে। এর বাইরেও আরো বহু সা¤্রাজ্যের শাসকেরা অল্প সময়ের জন্য কোহিনূরের মালিকানা পেয়েছিল। শুনতে অবাক লাগলেও এই হীরাটি অভিশপ্ত হবার বিভিন্ন নমুনা পাওয়া যায়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যারাই এই হীরার অধিকারী হয়েছেন তারাই হয় ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন কিংবা মৃত্যুবরণ করেছেন।

কোহিনূর এক অভিশপ্ত হীরা !

কোহিনূর হীরাটি দেখতে সাদা রঙের। এর অকার অনেকটা ডিম্বাকৃতির। প্রাথমিক ভাবে এর ওজন ছিলো ৭৫৬ ক্যারেট বা ১৫১ গ্রাম। বহুবার কর্তনের শিকার হবার পর বর্তমানে এর ওজন দাড়িয়েছে ১০৫ ক্যারেট বা ২১ গ্রাম। এই হীরায় ৩৩ টি পার্শ্ব রয়েছে। বহুবার হীরাটির মালিকানা বদল হলেও, কোহিনূর কখনো ক্রয়-বিক্রয় হয়নি। তবে ধারণা করা হয় হীরাটির বর্তমান মূল্য প্রায় ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড। বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার সমান। কোহিনূর কে ভারতের সবচেয়ে দামী হীরা বলা হলেও বাস্তবে এর চেয়ে মূল্যবান দু’টি হীরা তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষে ছিলো। সেগুলোর একটি হচ্ছে দরিয়া-ই-নূর, যেটি কোহিনূর এর সাথেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। দরিয়া-ই-নূরের ওজন ১৮২ ক্যারেট বা সাড়ে ৩৬ গ্রাম। বর্তমানে এটি ইরানের তেহরানে রয়েছে। অপরটি হচ্ছে গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড। এর ওজন ২৪০ ক্যারেট বা ৪৮ গ্রাম। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরার তালিকায় কোহিনূরের অবস্থান ৯০ তম। প্রায় অর্ধেক ওজন হারিয়ে ফেলা কোহিনূর কে সবচেয়ে নিখুঁত হীরা বলা হলেও, প্রাথমিক পর্যায়ে এটি নিখুঁত ছিল না। অনেকবার কাটার পর এটিকে নিখুঁত রূপ দেয়া হয়েছে। এটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজ্য অধিপতি ও রাজ্য জয়কারী রাজা মহারাজাদের কাছে হাত বদল হয়েছে। হিন্দু, তুর্কি, মুঘল, পার্সি, আফগান, শিখ ও পরবর্তীতে ব্রিটিশ রাজের মালিকানায় এসেছে কোহিনূর। ঐতিহাসিকদের মতে কোহিনূর মুঘলদের অধিকারে ছিল ২০০ বছর, আফগানদের অধিকারে ছিলো ৬৬ বছর এবং প্রায় ১৩৫ বছর ধরে ব্রিটিশ দের অধিকারে আছে।
কোহিনূর হীরাটি যে ভারত থেকে উত্তোলন করা হয়েছিল, সে বিষয়য়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে ভারতের কোণ অঞ্চল থেকে হীরাটি এসেছে, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। ভারতীয় হিন্দুদের একটি অংশ মনে করে, প্রাচীন কালে অর্জুনের বাহুতে এ হীরাটি শোভা পেতো। অপর একটি অংশ মনে করে কোহিনূর হীরা দেবতা কৃষ্ণের কাছে ছিলো। এগুলো অনেকটাই কল্পনাপ্রসূত। এসব দাবির পক্ষে শক্ত কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। ফলে এসব গল্প সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ঐতিহাসিকদের প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত এবং দক্ষিণ ভারতীয় লোককথা অনুযায়ী ধারণা করা হয়, ১৩০৪ সালে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ থেকে এই হীরা উত্তোলন করার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি। এই অঞ্চলকে পৃথিবীর প্রথম হীরা উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। সেসময় দক্ষিণ ভারতের প্রতিষ্ঠিত কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন মালবের রাজা মহালাক দেও। তার শাসনামলেই এই অঞ্চলের গোলকোন্দা রাজ্যের কল্লর খনি থেকে দু’টি অতিকায় হীরা উত্তোলন করা হয়েছিল। যার একটি ছিলো কোহিনূর। সইে মহালাক দেও কে কোহিনূর হীরার প্রথম মালিক ধরা হয়। পরবর্তীতে মালবের রাজপরিবারের কাছে হীরাটি কয়েক প্রজন্ম ধরে সংরক্ষিত ছলি। কথিত আছে হীরাটি কাকাতিয়া রাজবংশের অধিষ্ঠিত দেবীমন্দিরে দেবীর চোখ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ২য় আলেকজান্ডার হিসেব পরিচিত বিখ্যাত তুর্কি শাসক আলাউদ্দিন খিলজী, ১৪ শতকে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অভযিান পরচিালনা করছলিনে। আলাউদ্দীন খিলজীর সেনাপতি মালিক কফুর, কাকাতিয়া রাজ্য সহ অন্যান্য দক্ষিণ ভারতীয় রাজপ্রাসাদ ও মন্দির থেকে বিপুল পরিমাণে মণি-মাণিক্য লুট করে। সগেুলোর মধ্যে কোহিনূরও ছিলো। তখন থকেে তুর্কি রাজবংশের কাছে কিছুকাল থাকার পর, উত্তরাধিকার সূত্রে ঘুরতে ঘুরতে হীরাটি দিল্লীর সুলতানদের অধিকারে আসে। ১৫২৬ সালে পনপিথরে প্রথম যুদ্ধে দল্লিীর সুলতান ইব্রাহমি লােদ,ি মুঘল সাম্রাজ্যরে প্রতষ্ঠিাতা সম্রাট বাবুররে কাছে হরেে যায়। সইে সাথে কোহনিূর হীরাটওি দল্লিী সালতানাতরে হাত ছাড়া হয়ে যায়। সম্রাট বাবর তার বিখ্যাত জীবনী “বাবরনামায়” কোহিনূর কে “বাবরের হীরা” নামে উল্লেখ করেছেন। তিনি এই হীরার দাম নির্ধারণ করে বলেন যে, এই হীরার দাম দিয়ে পুরো পৃথিবীর মানুষকে দুই দিন খাওয়ানো যাবে। পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসনে বিখ্যাত এই হীরাটি স্থাপন করেন। এরপর প্রায় ২০০ বছর হীরাটি মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।
কোহিনূর হীরাটি সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন সম্রাটের হাত ঘুরে অবশেষে মুঘল সম্রাট মোহম্মদ শাহ এর হাতে আসে। তার শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের ভীত দুর্বল হয়ে পড়ে। সেসময় পারস্যের শক্তিশালী রাজা নাদির শাহ দিল্লী শাসনের দুর্বলতা টের পেয়ে, ১৭৩৯ সালে মুঘল সাম্রাজ্যে আক্রমণ করেন। তখন নাদির শাহ বাবরের হীরা সমৃদ্ধ ময়ূর সিংহাসনটি লুট করে ইরানে নিয়ে যায়। নাদির শাহ ই মূলত এই হীরার নাম দেন “কোহিনূর”। ফারসি শব্দ কোহিনূর অর্থ “আলোর পর্বত”। ১৭৪৭ সালে এক বিদ্রোহে নাদির শাহ খুন হবার পর, তার নাতি শাহ রুখ মির্জার কোহিনূরের মালিক হয়। পরবর্তীতে শাহ রুখ মির্জা তার বিশ্বস্ত উপদেষ্টা আফগানিস্তানের সুলতান আহমেদ শাহ আবদালীকে কোহিনূর হীরা টি উপহার দেন। ১৮১৩ সালে আহমেদ শাহ আবদালীর কাছ থেকে, পাঞ্জাবের সিংহ হিসেবে পরিচিত মহারাজা রঞ্জিত সিং কোহিনূর দখল করে নেন। এর পর তার দুর্বল উত্তরাধিকারী দুলীপ সিং হীরাটির মালিকান পান। দুলীপ সিং ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হবার পর, পাঞ্জাব অঞ্চল ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভূক্ত হয়। তখন কোহিনূর হীরাটি দখল করে, তৎকালীন লর্ড ডালহৌসি ব্রিটেনে চালান করে দেয়। সেখান থেকেই ব্রিটিশ স¤্রাজ্ঞী মহারানী ভিক্টোরিয়া কোহিনূরের মালিক হন। রানী ভিক্টোরিয়া একজন স্বনামধ্য জহুরি কে ডেকে কোহিনূর হীরাটি আরো সুন্দর করে কাটার নির্দেশ দেন। কাটার পর হীরার ৪৩ শতাংশ অংশ বিলুপ্ত হয় এবং এর মাধ্যমেই কোহিনূর তার বর্তমানের ডিম্বাকৃতি ধারণ করে। এরপর রানী ভিক্টোরিয়া পাঁচ বছর তার মুকুটে হীরাটি পরিধান করেন। এরপর তিনজন ব্রিটিশ রাজার স্ত্রীর মুকুটে কোহিনূর শোভা পায়। সম্প্রতি ক্ষমতায় আসা ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের নানী সর্বশেষ ১৯৩৭ সালে কোহিনূর হীরার তৈরী মুকুটের অধিকারী হন। ২০০২ সালে তিনি মারা যাবার পর থেকে, ব্রিটেনের জাতীয় ঐতিহ্যর নিদর্শন হিসেবে টাওয়ার অব লন্ডনের জুয়েলে হাউজে কোহিনূর জনসাধারণের জন্য প্রদর্শিত হচ্ছে। বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলা পার্কার খুব শীঘ্রই এই কোহিনূর হীরা সম্বলিত মুকুটের অধিকারী হবেন।
কোহিনূও হীরার ইতিহাস নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত একটি দিক হল “কোহিনূর এর অভিশাপ”। শুনতে অবাক লাগলেও, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই হীরার অভিশপ্ত হবার বিভিন্ন নমুনা পাওয়া যায়। ১৩০৬ সালের একটি পুঁথি থেকে কোহিনূর সম্পর্কে একটি আজব তথ্য পাওয়া যায়। পুঁথিতে লেখা ছিলো যে, এই মূল্যবান হীরাটি শুধুমাত্র একজন নারী পরিধান করতে পারেবেন। সেখানে কোনো পুরুষকে এই হীরার মালিকানা নিতে নিষেধ করা হয়। কারণ হিসেবে সেখানে লেখা ছিলো, কোনো পুরুষ যদি এর মালিক হন তবে তাকে জীবদ্দশায় বিভিন্ন ধরণের বিপদ, সহিংসতা, হত্যা, নির্যাতন ও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হতে হবে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যারাই এই হীরার অধিকারী হয়েছেন তারাই হয় ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন কিংবা অল্প কিছু কালের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রথম মালিক মহালাক দেও থেকে শুরু করে মুঘল সাম্রাজ্যের সবাই এই হীরার সাথে সাথে তাদের সাম্রাজ্য হারিয়েছেন। সম্রাট বাবর বার বার সিংহাসন থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। সম্রাট শাহজাহান তার ছেলে আওরঙ্গজেবের কাছে সিংহাসন হারিয়েছেন। পরবর্তীতে এর মালিকদের পরিণতি হয় আরো করুণ। সিংহাসন নিয়ে রাজ পরিবারের মধ্যেই রক্তারক্তি আর খুনাখুনি শুরু হয়ে যায়। পারস্যের রাজা নাদির শাহ ঘুমন্ত অবস্থায় তার পরিবারের লোকদের হাতে নিহত হন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে আসার পর যে রাজাই এটা পরেছেন, তারা ক্ষমতা হারিয়েছেন। তখনই মূলত পুরুষ শাসকদের প্রতি কোহিনূর হীরার অভিশাপের ব্যাপারটি খেয়াল করা হয়। এরপর থেকে শুধু রানীরা তাদের মুকুটে কোহিনূর হীরা ব্যবহার করে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে হীরাটির মালিকানা বদল হলেও, ব্রিটিশ দের প্রতি অভিযোগ রয়েছে যে তারা ভারত থেকে হীরাটি চুরি করেছে। তাই কোহিনূর ফিরিয়ে আনতে ‘মাউন্টেন অব লাইন’ নামক একটি দল লন্ডন হাই কোর্টে মামলা দায়ের করে। বিভিন্ন সময়ে ভারতের মামলার জবাবে ব্রিটিশ রা জানিয়েছে যে হীরাটি রানী এলিজাবেথ কে উপহার দেয়া হয়েছে, সেটি কোনো ভাবেই ভারতের ফেরত চাওয়ার অধিকার নেই। ভারত ছাড়াও আফগানিস্তান, ইরান এমনকি পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোও ব্রিটিশ সরকারের কাছে হীরার মালিকানা দাবী করেছিলো। কিন্তু সবাই ব্যর্থ হয়েছে। কারো দাবীই ব্রিটিশরা পাত্তা দেয়নি।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।