কোয়ান্টাম কম্পিউটার

maxresdefault (2)
জীবনযাপন

কোয়ান্টাম কম্পিউটার

ভূমিকা

পৃথিবীর বুকে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যেগুলো কিছুটা দুষ্প্রাপ্য হলেও, আমাদের আধুনিক জীবনের জন্য এগুলো অপরিহার্য। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ইলেকট্রিক গাড়ি থেকে শুরু করে উইন্ডমিল, স্যাটেলাইট কিংবা মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম পর্যন্ত প্রায় সকল প্রযুক্তিপন্যেই এই উপাদানগুলোর ব্যবহার রয়েছে। এসব উপাদানকেই বলা হয় Rare Earth Elements বা বিরল খনিজ উপাদান। এগুলো টেকনোলজির হীরা হিসেবেও পরিচিত।

এই উপাদানগুলো পৃথিবীর ভূত্বকে এমনভাবে ছড়িয়ে রয়েছে যে, এগুলোকে সহজে আলাদা করা যায় না, সে জন্যই এগুলো ‘বিরল’ হিসেবে পরিচিত। শুধুমাত্র এইসব খনিজ পদার্থের জন্যই যুক্তরাষ্ট্র বানাম চীনের মধ্যকার বানিজ্য যুদ্ধ ভয়াবহ পর্যায়ে পৌছে গেছে।

বিরল খনিজ উপাদান আসলে কী ?

বিরল খনিজ উপাদান

Rare Earth Elements বলতে মোট ১৭টি রাসায়নিক উপাদানকে বোঝানো হয়। এদের মধ্যে ১৫টি হল ল্যান্থানাইড সিরিজের উপাদান (Lanthanum থেকে Lutetium), এবং বাকি ২টি হল Scandium ও Yttrium। এদের বৈশিষ্ট্য হলো এরা দেখতে একরকম, আচরণেও প্রায় একরকম, কিন্তু প্রতিটির আলাদা আলাদা ব্যবহার রয়েছে।

এই উপাদানগুলোর আবিষ্কার শুরু হয়েছিল প্রায় ২৪০ বছর আগে। ১৭৮৭ সালে সুইডেনের এক ছোট্ট গ্রামে, ইটারবি (Ytterby) নামক জায়গা থেকে একধরনের কালো খনিজ পাথর পাওয়া যায়। খনিজটির নাম ছিল Gadolinite। Carl Axel Arrhenius নামের এক সুইডিশ সেনা কর্মকর্তা ও খনিজবিদ খেয়াল করেন যে এই পাথরের মধ্যে সাধারণ উপাদানের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে।

এরপর সুইডেনের রসায়নবিদ Johan Gadolin ১৭৯৪ সালে এই খনিজ পরীক্ষা করে Yttrium নামের এক নতুন উপাদান আবিষ্কার করেন। এটিই ছিল প্রথম আবিষ্কৃত Rare Earth Element। এরপর ১৮০০ থেকে ১৯০৭ সালের মধ্যে বিজ্ঞানীরা ল্যান্থানাম, সেরিয়াম, নিওডিমিয়াম, ইউরোপিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, টারবিয়াম সহ মোট ১৫টি ল্যান্থানাইড উপাদান এবং ২টি সম্পর্কিত উপাদান (Scandium ও Yttrium) আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারগুলো একেবারেই সহজ ছিল না। কারণ Rare Earth Elements গুলো দেখতে একই রকম, এমনকি এদের আচরণও প্রায় একইরকম। এবং এরা একে অপরের সঙ্গে প্রায় মিশে থাকে। ফলে এসব খনিজ পদার্থগুলোকে আলাদা করতে বিজ্ঞানীদের বহু বছর সময় লেগে যায়।

বিরল খনিজ উপাদানের ব্যবহার

১৯৪০-এর দশকে, বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে, Rare Earth Elements-এর চাহিদা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে রাডার, চুম্বক এবং অস্ত্র তৈরির কাজে এগুলোর ব্যাপক ব্যবহার হয়। এরপর ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে যখন কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের যুগ শুরু হয়, তখন থেকে এদের চাহিদা হঠাৎ করেই আকাশচুম্বী হয়ে যায়।

আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোতে এর ব্যবহার দেখলেই এসব উপাদানের গুরুত্ব বোঝা যায়। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, টিভি এবং স্পিকারের মত যেসব যন্ত্রে ছোট চুম্বক থাকে, সেগুলোর অন্যতম উপাদান হলো নিওডিমিয়াম (Neodymium)। যা একটি Rare Earth Element। এছাড়া ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারি ও মোটর, উইন্ড টারবাইন, সোলার প্যানেল সহ সবুজ জ্বালানি প্রযুক্তির ভিত্তি গড়ে উঠেছে এই সব বিরল খনিজ দিয়ে। আধুনিক যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার এবং স্যাটেলাইট তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ডিসপ্রোসিয়াম (Dysprosium) ও টারবিয়াম (Terbium)। চিকিৎসা বিজ্ঞানে, যেমন ক্যান্সার থেরাপিতে ব্যবহৃত হয় গ্যাডোলিনিয়াম (Gadolinium)।

অর্থাৎ, আজকের প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক বিশ্ব যেভাবে স্বয়ংক্রিয় এবং পরিবেশবান্ধব হবার দিকে এগোচ্ছে; তা Rare Earth Elements ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। তাছাড়া আমরা সবাই চাই আমাদের ব্যবহৃত প্রযুক্তি পণ্যগুলো দিন দিন আরো ছোট এবং উন্নত হয়ে আসুক। এসব উপাদান যদি না থাকে, তাহলে আমরা কোন ধরনের উন্নত যন্ত্র বানাতে পারবে না। আর সে কারণেই এসব খনিজকে বলা হয় “টেকনোলজির  হিরা”।

উপাদানগুলো কোথায় পাওয়া যায়?

বিশ্বে বেশ কয়েকটি দেশে Rare Earth Elements পাওয়া গেলেও, সবচেয়ে বড় রিজার্ভ ও উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে চীন। ১৯৮৫ সালের পর থেকে চীন এই খনিজ উৎপাদনে জোর দেয় এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও স্বল্পমূল্যের কারণে, চীন খুব দ্রুত সারা বিশ্বের Rare Earth বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বর্তমানে চীন একাই সমগ্র বিশ্বের Rare Earth Elements এর প্রায় ৮০% উৎপাদন করে। এছাড়া, ব্রাজিল, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ভিয়েতনাম এবং যুক্তরাষ্ট্রেও এই উপাদানগুলোর বিপুল মজুদ আছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও নদী অববাহিকার বালু, জেগে ওঠা চর, সৈকত বালু এবং কয়লাখনি থেকে বিরল খনিজের সন্ধান পাওয়া গেছে। [নিউজ]

তবে এসব খনিজ উপাদানকে বিরল বলা হলেও, সত্যিকার অর্থে এগুলো অতটাও বিরল নয়। বরং সারা পৃথিবীতেই এগুলো সমানভাবে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু তারপরও এসব উপাদানকে ‘বিরল’ বলার কারণ, এরা সোনা বা হীরার মতো এক জায়গায় ঘনিভূত হয়ে থাকে না। বরং পৃথিবীর ভূত্বকে নানা খনিজের সঙ্গে মিশে থাকে, যেগুলো থেকে আলাদা করা খুব কঠিন, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল।

তাছাড়া Rare Earth Elements গুলো খনি থেকে তোলার প্রক্রিয়া পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতে পানি ও মাটি দুষিত হয়। এই উপাদান আলাদা করার সময় বিপজ্জনক কেমিক্যাল ব্যবহার করতে হয়, যার বর্জ্য পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। তারমানে এগুলো বাস্তবে অতটাও বিরল না হলেও, প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করে, ব্যবহার উপযোগী করাটা অত্যন্ত কষ্টের কাজ। সেকারণেই এগুলোকে বিরল উপাদান বলা হয়।

বিরল খনিজ ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা

বিরল খনিজ শুধু বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি আজকের পৃথিবীর এক জটিল ভূরাজনৈতিক যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু। চীন যেহেতু এসব উপাদান উৎপাদনে একাধিপত্য বিস্তার করেছে, তাই চীন Rare Earth Elements রপ্তানি বন্ধ করে দিলে, গোটা বিশ্বের প্রযুক্তি শিল্প হুমকিতে পড়তে পারে।

বিশ্বের অনেক দেশেই Rare Earth Elements থাকলেও, তাদের সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করার ক্ষমতা নেই। সেই সুযোগে চীন বহুবার এই শক্তিকে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। ২০১০ সালে চীন ও জাপানের মধ্যে সীমানা বিরোধ নিয়ে উত্তেজনা বাড়লে, চীন জাপানে Rare Earth রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এতে জাপানের প্রযুক্তি শিল্পে বড় ধাক্কা লাগে।

সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের উপর ২৪৫% শুল্ক আরোপ করার পর, চীন Rare Earth Elements যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। পরবর্তীতে ট্রাম্প চীনের উপর থেকে অন্যায্য শুল্ক কেমিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। [নিউজ]

২০২০ সালেও যুক্তরাষ্ট্র চীনের উপর Rare Earth Elements এর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য, ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকা আমেরিকার একমাত্র বাণিজ্যিক Rare Earth খনি পুনরায় চালু করেছিল।

এছাড়া অতীতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ভারতের ‘Quad’ জোটের মাধ্যমে চীনবিরোধী Rare Earth সরবরাহ চেইন গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নও বুঝতে পেরেছে চীনের উপর নির্ভরতা বিপজ্জনক। তারা Rare Earth কে ‘Strategic Raw Materials’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং নতুন খনি অনুসন্ধান ও রিসাইক্লিং প্রোগ্রামে বিনিয়োগ শুরু করেছে। শুধু তাই নয় Rare Earth Elements এর বিকল্প উৎস খোঁজার জন্য, বিভিন্ন গ্রহাণুতে খনিজ অনুসন্ধান বা Asteroid Mining এরও প্রস্তুতি চলছে।

Rare Earth Elements বর্তমান প্রযুক্তির মূল চালিকাশক্তি। আমরা যতই ডিজিটাল ও বৈদ্যুতিক দুনিয়ার দিকে অগাচ্ছি, এই উপাদানগুলোর গুরুত্ব ততই বাড়ছে। কিন্তু এর উৎপাদন, রিসাইক্লিং, পরিবেশগত প্রভাব এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট; সবকিছু মিলিয়ে এগুলো আরো জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।