কোয়ান্টাম কম্পিউটার
কোয়ান্টাম কম্পিউটার
ভূমিকা
একসময় কম্পিউটার বলতে বোঝাতো একটি বড়সড় যন্ত্র, যা ধীরে ধীরে আমাদের টেবিলের ওপর এসেছে, তারপর একেবারে আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু প্রযুক্তি থেমে নেই, এবার বিজ্ঞানীরা এমন এক বিস্ময়কর যন্ত্র তৈরি করছেন, যা সাধারণ কম্পিউটারের কাজের সময়, গতি ও ক্ষমতার সকল ধারণা বদলে দিতে পারে। এর নাম কোয়ান্টাম কম্পিউটার।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার আমাদের পরিচিত ক্লাসিকাল কম্পিউটারের তুলনায় লাখো গুণ বেশি শক্তিশালী হতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভুত নিয়মকে ব্যবহার করে এইসব যন্ত্র একসঙ্গে হাজারো হিসাব করতে পারে, যেসব সমস্যা সাধারণ কম্পিউটারের পক্ষে সমাধান করাটা ছিল প্রায় অসম্ভব। এই প্রযুক্তি কেবল ভবিষ্যতের একটি সম্ভাবনা নয়, বরং ইতোমধ্যেই গবেষণাগারে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ইতিহাস
বিশ শতকের শুরুর দিকে যখন বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক কণা ও তাদের আচরণ নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন, তখন থেকেই মূলত কোয়ান্টাম কম্পিউটারের যাত্রা শুরু হয়। সে সময় পদার্থবিজ্ঞানের এক নতুন শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্স, বিজ্ঞানীদের সামনে বিস্ময়ের দরজা খুলে দেয়। ১৯০০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, আলবার্ট আইনস্টাইন, নিলস বোর, ভেরনার হাইজেনবার্গ এর মতো বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, অণু-পরমাণু স্তরের জগৎটা একেবারে আলাদা নিয়মে চলে। এই নিয়মগুলোই পরবর্তীতে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভিত্তি গড়ে দেয়।
কম্পিউটার বিজ্ঞানে কোয়ান্টাম ভাবনার প্রথম বড় অবদান আসে ১৯৮০ সালের দিকে। ১৯৮১ সালে বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান বলেন:
“Nature isn’t classical… and if you want to make a simulation of nature, you’d better make it quantum mechanical.” অর্থাৎ, প্রকৃতি নিজেই কোয়ান্টাম রীতিতে চলে, তাই প্রকৃতিকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের কোয়ান্টাম যন্ত্র লাগবে। এই চিন্তা থেকেই শুরু হয় কোয়ান্টাম কম্পিউটিং–এর ধারণাগত পথচলা।
১৯৯4 সালে মার্কিন গণিতবিদ পিটার শোর (Peter Shor) একটি আলগোরিদম তৈরি করেন, যেটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে বড় বড় সংখ্যা ভেঙে ফেলার উপায় দেখায়। এই সংখ্যাগুলো ভাঙা যায় না বলেই আজকের সব ইন্টারনেট নিরাপত্তা টিকে আছে। পিটার শোর দেখালেন—যদি কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানো যায়, তবে বর্তমানের সব সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে!
এরপর ১৯৯৬ সালে লাভ গ্রোভার (Lov Grover) এমন একটি কোয়ান্টাম অ্যালগোরিদম তৈরি করেন, যা দিয়ে কোনো ডেটাবেজের ভেতর থেকে দ্রুত তথ্য খুঁজে বের করা যায়। এসব তাত্ত্বিক অগ্রগতি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভবিষ্যত ব্যবহার সম্পর্কে নতুন আশা জাগায়।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে?
বর্তমানে আমরা যেসব কম্পিউটার ব্যবহার করি, সেগুলোকে বলে “ক্লাসিকাল কম্পিউটার”। এগুলো ০ এবং ১ — এই দুইটি ডিজিট নিয়েই সব হিসাব-নিকাশ করে। একে বলা হয় বিট। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার এর থেকে একধাপ এগিয়ে। একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মস্তিষ্ক হলো ‘কিউবিট’। এটি ক্লাসিকাল কম্পিউটারের ‘বিট’-এর মতো, কিন্তু অনেক বেশি শক্তিশালী। কিউবিট একসাথে ০ এবং ১ দুই অবস্থায়ই থাকতে পারে, যার মানে হলো, এটি একসাথে বহু হিসাব করতে পারে।
এছাড়া কিউবিটের মধ্যে “এনট্যাঙ্গলমেন্ট” নামের আরেকটি আশ্চর্য বিষয় কাজ করে। এর মানে হলো, একটি কিউবিটে যা ঘটে, সেটি আরেকটি কিউবিটেও প্রভাব ফেলে, এমনকি তারা আলাদা জায়গায় থাকলেও! এই বিষয়টি কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে আরো দ্রুত ও জটিল কাজ করতে সাহায্য করে।
এই প্রযুক্তির পেছনে রয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামক পদার্থবিজ্ঞানের এক জটিল কিন্তু আশ্চর্য জগত। বস্তুর কোয়ান্টাম অবস্থায় কণাগুলো অদ্ভুতভাবে আচরণ করে। গবেষকরা বুঝতে পারলেন, এই কণাগুলোর আচরণ যদি আমরা কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে সেই শক্তিকে ব্যবহার করে তৈরি করা যাবে এক নতুন ধরনের কম্পিউটার; যেটা হাজার বছরের গণনা কয়েক মিনিটে করে ফেলতে পারবে!
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বাস্তব পরীক্ষার
২০০০ সালের পর থেকে আইবিএম, গুগল, মাইক্রোসফটের মতো প্রযুক্তি জায়ান্টরা কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। ২০১১ সালে কানাডাভিত্তিক D-Wave প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ‘কোয়ান্টাম-সদৃশ’ কম্পিউটার তৈরি করে, যদিও সেটি তখনো পুরোপুরি কোয়ান্টাম কম্পিউটার ছিল না।
২০১৯ সালে গুগল ঘোষণা করে, তারা “Quantum Supremacy” অর্জন করেছে। তারা দাবি করে, তাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটার “Sycamore” এমন একটি সমস্যা সমাধান করেছে, যা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সুপারকম্পিউটারও করতে পারত না।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত। চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ এই প্রযুক্তির দৌড়ে এগিয়ে থাকতে ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছে। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার এখনো মূলত গবেষণাগারে পরীক্ষামূলক পর্যায়েই রয়েছে। তবুও বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে, আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ব্যবহার
এখনও পর্যন্ত কোয়ান্টাম কম্পিউটার গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ থাকলেও, নিকট ভবিষ্যতেই এটি আমাদের জীবন পাল্টে দিবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার বাস্তবে রূপ নিলে, নতুন নতুন ঔষধের উপাদান আবিষ্কারে এটি কয়েক মাসের কাজ কয়েক ঘণ্টায় করে ফেলতে পারবে। কারণ বর্তমানে কোনো একটি প্রোটিন বা রাসায়নিক অণুর আচরণ বোঝার জন্য লাখ লাখ ডলার খরচ করেও বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেই অণু-পরমাণুর আচরণ simulate করে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় সম্ভাব্য ঔষধ তৈরি করতে পারবে। ফলে ক্যান্সার, আলঝেইমার বা কোভিডের মত নতুন রোগের চিকিৎসা আবিষ্কারে কোয়ান্টাম কম্পিউটার হতে পারে যুগান্তকারী সমাধান।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত ও বহু আগে থেকেই বিপদ শনাক্ত করার মত আবহাওয়ার পূর্বাভাস তৈরী করা যাবে। সাইক্লোন, ভূমিকম্প কিংবা জলোচ্ছ্বাস—এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগেভাগে সঠিকভাবে বুঝতে হলে কোটি কোটি ভেরিয়েবল বিশ্লেষণ করতে হয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটার এই বিশ্লেষণকে বাস্তবের চেয়েও দ্রুত করতে পারে।
জটিল গণিত সমস্যার সমাধান; বিশেষ করে ব্যাংকিং ও সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বড় বড় প্রাইম নাম্বার বের করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার মহাকাশে ব্ল্যাকহোল, ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি ইত্যাদির আচরণ বুঝতে সাহায্য করবে। এমনকি নতুন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজার সম্ভাবনাও অনেক বাড়িয়ে দেবে।
তাছাড়া কোয়ান্টাম কম্পিউটারের শক্তি এআই ও মেশিন লার্নিং এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কাজে দিবে। বর্তমানে আমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) অনেক কাজ করতে পারলেও, তাদের ক্ষমতার সীমা আছে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে AI কে এমন জটিল চিন্তা করানো যাবে, যা আগে কল্পনাও করা যেত না। উদাহরণস্বরূপ, AI ব্যবহার করে ভবিষ্যতের অর্থনীতির ধাক্কা আগে থেকেই বোঝা যাবে।
গুগলের কোয়ান্টাম কম্পিউটার “Sycamore” মাত্র ২০০ সেকেন্ডে এমন একটি সমস্যা সমাধান করেছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সুপারকম্পিউটার ১০ হাজার বছরেও করতে পারত না! কোয়ান্টাম প্রযুক্তির Quantum Key Distribution (QKD) প্রযুক্তি এমনভাবে এনক্রিপশন তৈরি করতে পারে, যা কেউ চুরি করার চেষ্টা করলেই ধরা পড়ে যাবে—কারণ কোয়ান্টাম তথ্য “পর্যবেক্ষণ” করলেই তা পরিবর্তিত হয়ে যায়।