কোটা আন্দোলন কেন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিল
কোটা আন্দোলন কেন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিল
সূচনা
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রসমাজ আন্দোলনে নেমেছিল। নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ে, ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী সরকারী চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা একটি যৌক্তিক পর্যায়ে এসে থেমেছে। কিন্তু তারপরও এই আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবার বদলে, আরো বেড়েই চলেছে।
শেখ হাসিনা: সব তো মেনেই নিলাম, তারপরও আন্দোলন কিসের?
চলমান আন্দোলনের প্রকৃত কারণ আসলে কী?
আন্দোলনের গতিপথ
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবির প্রেক্ষিতে, সরকার সকল কোটা বাতিল করে দিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের জুন মাসে আদালত কোটা পুনর্বহাল করে। ফলে শিক্ষার্থীরা আবারো কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামে।
সরকার শুরু থেকেই ছাত্রদের দাবি মনোযোগ দিয়ে শোনেনি। ছাত্ররা ২০১৮ সালেই কোটা সংস্কার চেয়েছিল, কোটা বাতিল নয়। তখন সরকার কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বাতিল করেই আরেকটি অসন্তোষের বীজ বপন করেছিল। ২০২৪ সালের আন্দোলন তারই ফসল।
সরকার বলেছে তারা শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে একমত। আন্দোলনের শুরু থেকেই উভয় পক্ষ একমত হওয়া সত্ত্বেও, কেন সহিংসতায় এত লোককে প্রাণ দিতে হল? এর উত্তর হল, সংলাপের অভাব। সরকার বারবার বলেছে, এটা আদালতের বিষয়, এখানে সরকারের করার কিছু নেই। অন্যদিকে আদালত বলেছে সরকার চাইলে এটি সংস্কার করতে পারে। শিক্ষার্থীদের কথা ছিল, আদালতে শুধু শীর্ষ সরকারী চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে মামলা চলছে, কিন্তু তারা চায় সকল শ্রেণীর সরকারী চাকরিতে, সকল কোটার সংস্কার। ছাত্র সমাজের এই সাধারণ দাবির বিষয়টি কেউ মনোযোগ দিয়ে শোনার প্রয়োজনীয়তাই বোধ করেনি।
দেশের গণমাধ্যমগুলোও এই অতি সাধারণ বিষয়টি পরিষ্কার করে তুলে ধরতে ব্যার্থ হয়েছে। বরং একটি সাধারণ আন্দোলন এত বড় পর্যায়ে আসার পেছনেও কিছু অপেশাদার সাংবাদিকের দায় রয়েছে। অযোগ্য এসব সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর সামনে এমনভাবে এক অবাঞ্ছিত প্রশ্ন রাখেন, প্রধানমন্ত্রী যার উত্তর দেওয়ার পর, সেখান থেকে আন্দোলন সম্পূর্ণ এক নতুন মাত্রা পায়।
প্রধানমন্ত্রী: মুক্তি যোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না তো কি রাজাকারের …
এই বক্তব্যের পর ছাত্র সমাজ ফুঁসে ওঠে। সেই হতাশা থেকেই তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি অবস্থানে, বহু ছাত্র শহীদ হয়। বাংলাদেশের পুলিশ আন্দোলন দমনের জন্য, বাংলাদেশেরই নিরস্ত্র ছাত্রদের বুকে গুলি চালায়।
সরকারী হিসেবে নিহতের সংখ্যা দেড়শর কাছাকাছি। বেসরকারী হিসেবে নিহত আড়াইশর বেশি। এবং প্রতি নিয়ত আহত নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এত কঠোরভাবে আন্দোলন দমনের জন্য সরকার পক্ষের যুক্তি হল, জামাত শিবির এবং বিএনপি এই আন্দোলনে ঢুকে পড়েছে। কোন ধরনের তদন্ত ছাড়াই সরকার বলে দেয়, মেট্রোরেল, বিটিভি ভবন, সেতু ভবন সহ সরকারী গুরুত্বপূর্ন স্থাপনা ধ্বংস করেছে জামাত শিবির বিএনপি। যার জের ধরে সরকার অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাহী আদেশে জামাত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে।
জনগণের টাকায় তৈরী করা দেশের সম্পদ যারা লুট করেছে, দেশবাসী তাদের কঠোর শাস্তি চায়। কিন্তু তাদের দমনের নামে কেন সাধারণ ছাত্রদের উপর নির্বিচারে গুলি চলানো হল? নাশকতাকারীদের গ্রেফতারের বদলে কেন, হাজার হাজার নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, আইন মন্ত্রী সহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, সাধারণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। অথচ স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী সহ এইচএসসি পরীক্ষার্থীদেরকেও বিনা অপরাধে নাশকতার মামলা দিয়ে, কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে।
ছাত্ররা এসব অন্যায়ের বিচার চায়। সেকারনেই তারা ৯ দফা দাবি উত্থাপন করেছে। কিন্তু সরকার এখনও বরাবরের মতই ছাত্রদের দাবির কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে না। সেকারণেই সরকার বলছে, কোটা সংস্কারের দাবি আদায়ের পরও কেন আন্দোলন চলছে?
ইন্টারনেট বন্ধ
মূলত দুটি ঘটনার পর ছাত্র সমাজের এই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে। একটি হল প্রধানমন্ত্রীর রাজাকারের নাতিপুতি সম্পর্কিত উক্তি এবং রংপুরে পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাইদের মৃত্যু। আবু সাইদের মৃত্যুর পর এই আন্দোলন সারা দেশে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খালি করে, ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষনা করা হয়। এরপর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। ঢাকা সহ সারা দেশে পুলিশের গুলিতে বহু শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার খবর আসতে থাকে।
এক পর্যায়ে আন্দোলন দমন করতে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় এবং দেশজুড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা সহ কার্ফিউ জারি করা হয়। ইন্টারনেট বন্ধের মাধ্যমে শুধু ডিজিটাল বাংলাদেশের কর্মচাঞ্চল্যই স্থবির হয়ে পড়ে না, বরং দেশের মানুষ যেন বাকস্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেনি, দুর্বৃত্তদের হামলায় দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। তবে দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামো সংশ্লিষ্টরা একাধিক গণমাধ্যমে জানিয়েছে যে, দু একটি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে, বড় জোড় দেশের ইন্টারনেট স্পিড কমে যেতে পারে, কিন্তু সমগ্র দেশের ইন্টারনেট একযোগে বন্ধ হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
ব্যাংক থেকে শুরু করে গার্মেন্টস শিল্প পর্যন্ত দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনমুখী বহু সেবা খাত ইন্টারনেটের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। ফ্রিলান্সিং, ই -কমার্স, এফ -কমার্স খাতের বহু উদ্যোক্তা ইন্টারনেট সেবা বঞ্চিত হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়ে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য এবং গুজব ছড়ানো হচ্ছিল দাবি করে, সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেছিল। কিন্তু ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধের পর বিক্ষোভ কিংবা সহিংসতা তো কমেইনি বরং তা আগের চেয়ে আরো বেড়েছে।
ছাত্রলীগের ভূমিকা
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনের জন্য, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন এদের মোকাবেলার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। এরপর থেকেই আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার চিত্র গণমাধ্যমে উঠে আসতে থাকে। এমনকি নারী শিক্ষার্থীদেরকে মেরে রক্তাক্ত করে দেওয়ার গুরুতর অভিযোগও পাওয়া যায়।
একটি পেশাজীবী সংগঠনের কাজই হল পেশা সংশ্লিষ্টদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করা। কিন্তু দেশের সরকারী লেজুরবৃত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলো এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা। সরকার যেহেতু ছাত্রদের দাবিগুলোকে যৌক্তিক বলে স্বীকার করছিল। সেক্ষেত্রে ছাত্রলীগের উচিত ছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেওয়া। তাহলে শিক্ষার্থীরা সহিংসতার ঘটনা ছাড়াই আরো সহজে তাদের দাবি আদায় করতে পারত।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখা একটি দল। শুধুমাত্র এই অতীত গৌরব দিয়ে, ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকান্ডের বৈধতা দেওয়া যায় না। তবে এবারই বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়ত প্রথমবার, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী একত্রিত হয়ে, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের অন্যায় আচরণের প্রেক্ষিতে, তাদের কে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার নজির সৃষ্টি হয়েছে।
এই সুযোগ নিয়ে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল এবং বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির ছাত্রলীগের নিন্দা জানিয়ে, সাধারণ ছাত্রদের সাথে একাত্মতা পোষণ করে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে অতীতে ক্ষমতায় থাকার সময় ছাত্রদল এবং শিবিরেরও ঠিক একই ধরনের বা এর চেয়েও জঘন্য কুর্কীর্তি আছে। তাই ছাত্র সমাজ মনে করে, আন্দোলনে এদের সম্পৃক্ততা তাদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের পথে বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারে। এবং শেষমেষ তাই হয়েছে। সরকার এই গণ আন্দোলনকে জামাত শিবিরের প্রেতাত্মা আখ্যা দিয়ে, একবাক্যে দমন করতে চাইছে।
ছাত্রদল আর ছাত্রশিবিরের একাত্মতা পোষণের পর থেকে, দেশের সমগ্র প্রান্তের সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন উল্টো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সরকার যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বর্তমান ছাত্র আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করছে, এরা আসলে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনে অসুবিধা ছাড়া ভালো কিছু যোগ করেনি।
সরকার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে দায় দিচ্ছে, তারা বিএনপি জামাতের অপরাজনীতির শিকার হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছাত্ররা মোটেও বিএনপির এজন্ডা বাস্তবায়নের জন্য রাস্তায় নামে নি। কারণ অতীতের বিএনপি সরকারেরও দূর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া, প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা আর অগণতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে, বাংলাদেশের মানুষ বিএনপির ওপরও কোনভাবেই আস্থা রাখতে পারে না। তারেক জিয়ার নজিরবিহীন দূর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার এদেশের মানুষ ভুলে যায়নি। তাই সরকার যে দাবি করছে, বিএনপি জামাত ছাত্রদের ব্যবহার করে সরকার পতনের পায়তারা করছে, তা সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিবর্জিত। কারণ এদেশের ছাত্র-জনতা ভালোভাবেই জানে বিএনপি আওয়ামীলীগের বিকল্প নয়; বরং চরিত্রগত দিক থেকে উভয় দল আসলে একই।
গণঅভ্যুত্থান
একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাজই যেখানে আলোচনার মধ্যমে সরকার পরিচালনা করা, সেখানে দীর্ঘদিন যাবৎ কার্যকর বিরোধী দলের উপস্থিতি না থাকার কারণে, আওয়ামীলীগ সরকার কার্যত যে কোন বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ এবং আলোচনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
কারো সাথে মতের অমিল হলে, তাকে জামাত শিবির রাজাকার ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। দেশের শিক্ষক, অভিভাবক থেকে শুরু করে গণমাধ্যমকর্মী, শিল্পী সমাজ সহ নানা স্তরের মানুষ আজ পথে নেমেছে। এদের সবাই কী জামাত শিবির রাজাকার?
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনার পথিকৃত প্রখ্যাত লেখক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, ১৯৫২ থেকে যত গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে তারমধ্যে এটিই সবচেয়ে ব্যাপক।
বর্তমানে দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের প্রধান দাবি হল, অধিকার আদায়ের জন্য নামা সকল শহীদের হত্যার বিচার। মেট্রোরেল সহ যেসকল জাতীয় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে, তা আবারো নির্মাণ করা যাবে; কিন্তু নিহত একটি প্রাণও আর ফিরে আসবে না। ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের আন্দোলনে, নিজ ঘরে থাকা শিশু সহ এত গুলো প্রান ঝড়ল কেন? সেই বিচারের দাবিতেই আজ সারা দেশে এক গণঅভ্যুত্থান তৈরী হয়েছে।