কাবা ঘরই কী পৃথিবীর কেন্দ্র
কাবা ঘরই কী পৃথিবীর কেন্দ্র
ভূমিকা
ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র স্থান মসজিদুল হারামের কেন্দ্রে রয়েছে পবিত্র কাবা শরীফ। বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা প্রতিদিন ৫ বার এই ঘরের দিকে ফিরে প্রার্থনা করে।
কাবা শরীফ শুধু একটি ইবাদতের স্থান নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর সৃষ্টি, ভৌগোলিক বিন্যাস, মহাবিশ্বের নিয়ম এবং আধুনিক বিজ্ঞানের একাধিক বিস্ময়কর সত্য। ইসলামিক বর্ণনায় এসেছে, বর্তমানে পবিত্র কাবা শরীফ যেখান অবস্থিত, এখানেই পৃথিবীর প্রথম ভূমি সৃষ্টি হয়েছিল।
বর্তমানে বিজ্ঞানের নানা গবেষণায়ও পবিত্র কাবা শরীফের এমনসব ভৌগলিক বিশেষত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।
পৃথিবীর প্রথম ভূমি
আমাদের বাসগৃৃহ পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৪৫ কোটি বছর। তবে পৃথিবীর সৃষ্টি লগ্ন থেকেই এখনকার মত পরিবেশ ছিল না। পৃথিবীর জন্ম এবং প্রথম ভূমির সৃষ্টি সম্পর্কে ইসলামিক বর্ণনা এবং বিজ্ঞানের বিশ্লেষণের মধ্যে অদ্ভূত মিল রয়েছে।
বিজ্ঞানের মতে, পৃথিবীতে প্রথম সাগর ও মহাসাগর তৈরি হয়, এবং তার মধ্য থেকেই প্রথম স্থলভাগ জেগে ওঠে। হাদিসে বলা হয়েছে, আল্লাহ যখন পৃথিবী সৃষ্টি করেন, তখন তা ছিল জলে নিমজ্জিত। ইসলামিক বর্ণনা অনুযায়ী, প্রথম ভূমি সৃষ্টি হয়েছে কাবা শরীফের নিচ থেকে, যা একসময় সাদা ফেনার মতো ছিল এবং ধীরে ধীরে কঠিন মাটিতে রূপ নেয়। এরপর কাবা শরীফের ঠিক নিচের অংশ থেকে প্রথম ভূমি সৃষ্টি হয়, যা ক্রমে প্রসারিত হয়ে পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। হাদিসের বর্ণনার সথে বৈজ্ঞানিক গবষণার হুবহু মিল পাওয়া যায়। উভয় ক্ষেত্রেই পৃথিবীর প্রথম অংশ পানির নিচ থেকে ধীরে ধীরে ভূমিতে পরিণত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে বিষ্ময়কর ব্যাপার হল, বিজ্ঞান এই সত্য আবিষ্কার করারও বহু আগেই তা হাদিসের বর্ণনায় এসেছে।
কাবা শরীফ: পৃথিবীর ভৌগোলিক কেন্দ্রবিন্দু?
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কাবা শরীফ প্রকৃত অর্থেই পৃথিবীর ভৌগোলিক কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ১৯৭৫ সালে ড. হুসেইন কামালুদ্দিন তাঁর “ইসকাতুল কুররাতিল আরদিয়্যা বিন নিসবাতি লিমক্কাতিল মুকাররামা” গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, কাবা শরীফকে পৃথিবীর মেরুদণ্ড ও কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
গবেষণায় তিনি একটি নতুন মানচিত্র প্রক্ষেপণ (Map Projection) পদ্ধতি প্রস্তাব করেন। প্রচলিত মানচিত্রে পৃথিবীকে বিভিন্নভাবে সমতল বা দ্বিমাত্রিকভাবে উপস্থাপন করার কারণে, এগুলোতে মক্কার অবস্থানের যথাযথ গুরুত্ব বোঝা যায় না। তাই, তিনি একটি নতুন পদ্ধতি তৈরি করেন, যেখানে মক্কাকে মানচিত্রের কেন্দ্রস্থল ধরে পৃথিবীর সকল স্থানের কিবলার দিক সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।
গবেষণায় তিনি দেখান যে, এই বিশেষ মানচিত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে কিবলার দিকে মুখ করার সময় একটি ভৌগোলিক ভারসাম্য বজায় থাকে, যা প্রচলিত গ্লোব বা মানচিত্রের মাধ্যমে বোঝা কঠিন। এটি উত্তর-মেরু কেন্দ্রিক মানচিত্র বা মার্সিডাল প্রক্ষেপণ থেকে আলাদা।
সেই গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এখানে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ভূগোলের বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে যে, মক্কা কেবল ধর্মীয় কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং পৃথিবীর ভূমির মোট ক্ষেত্রফলের সঙ্গে মক্কার অবস্থানের এক ধরনের জ্যামিতিক সামঞ্জস্য রয়েছে।
সৌদি আরবের উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. খালিদের গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে, কাবা শরীফ পৃথিবীর গোল্ডেন রেশিও (১.৬১৮) বিন্দুতে অবস্থিত, যা গণিত ও প্রকৃতির এক বিস্ময়কর অনুপাত। সৃষ্টিগজতের আসংখ্য বিষয় গোল্ডেন রেশিও আনুযায়ী সৃষ্টি করা হয়েছে। পবিত্র কাবা ঘরের সাথে উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর অবস্থানও গোল্ডেন রেশিও অনুযায়ী একদম সমান। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সমস্ত মহােদশ থেকে কাবা শরীফের দূরত্বের গড়ও প্রায় সমান।
জিরো গ্র্যাভিটি ও টাইম জোনের কেন্দ্র
২০০৮ সালে কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে মুসলিম পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীরা মত প্রকাশ করেন যে, পৃথিবীর মূল মধ্যরেখা প্রকৃতপক্ষে পবিত্র মক্কার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে মক্কা পৃথিবীর টাইম জোনের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত।
বর্তমানে আমাদের পৃথিবীর সময় গ্রিনিচ মান সময়ের উপর ভিত্তি করে গণনা করা হয়। ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতাবলে গ্রিনিচ কে সময়ের কেন্দ্র হিসেবে আরোপ করা হয়। যার কোন ভৌগলিক বিশেষত্ব নেই।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মক্কা পৃথিবীর ভূগোলগতভাবে এমন এক স্থানে অবস্থিত, যা প্রকৃত দৈর্ঘ্যরেখার (Longitude) প্রকৃত শূন্য বিন্দু হতে পারে। গ্রিনিচের পরিবর্তে মক্কাকে পৃথিবীর সময়ের কেন্দ্র হিসেবে নিলে পৃথিবীর সময় অঞ্চলগুলো অধিক স্বাভাবিক ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে।
শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, কাবা শরীফ এমন এক স্থানে অবস্থিত, যেখানে পৃথিবীর ভূ-চুম্বকীয় ক্ষেত্র সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ। এটি পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী জিওম্যাগনেটিক এনার্জি ফিল্ড, যা বিভিন্ন প্রাণীর ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এমনকি, কিছু গবেষণা বলছে যে, কাবা শরীফের ঠিক উপরে একটি জিরো গ্র্যাভিটি জোন রয়েছে, যেখানে পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম। এ কারণেই অনেকেই বলেন, কাবা ঘর তাওয়াফের সময় শরীরে একধরনের প্রশান্তি অনুভূত হয়। তাছাড়া কাবাঘর তাওয়াফও করা হয় পৃথিবীর ঘূর্ণনের দিকের সাথে মিল রেখে। অবিশ্বাস্য বিষয় হল, পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্যের মত গ্রহ নক্ষত্র যেমন কখনও থেমে থাকে না; ঠিক একইভাবে কাবাকে প্রদক্ষিন করাও কখনই থেমে থাকে না। এমনকি অতীতে বন্যার সময়ও মানুষ সাঁতার কেটে কাবাকে প্রদক্ষিণ করেছে। করোনা মহমারির সময় মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদ মুসল্লীদের জন্য বন্ধ করা হলেও; সেসময় সৌভাগ্যবান কিছু মুসলিম তাওয়াফ করার সুযোগ পায়। শুধু তাই নয় কাবা শরীফে মানুষের পদচারণা কমে যাওয়ার পর, হঠাৎ করেই দেখা যায় আশ্চর্য এক ঘটনা। এক ঝাঁক পাখি কাবা ঘরের চারদিকে তাওয়াফ করতে থাকে। যা সসময় ইন্টারনেটে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
ইসলামের এমন বেশ কিছু বিষয় রয়েছে, যা আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণেরও বহু আগে থেকে মহান আল্লাহর আদেশে মুসলিমরা পালন করে আসছে। তেমনি একটি বিষয় হল পবিত্র রমজান মাসে রোজা পালন করা। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় দেখা গেছে যে, রোজা শরীরের বিপাকীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মানসিক চাপ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।