কাতার বিশ্বকাপ কেলেঙ্কারি
কাতার বিশ্বকাপ কেলেঙ্কারি
২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে কাতার। বিভিন্ন কারণেই কাতারের বিশ্বকাপ হবে অতীতের সকল আয়োজন থেকে আলাদা। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটিই হতে যাচ্ছে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ আয়োজন করা দেশ গুলোর মধ্যে কাতারই সবচেয়ে ছোট দেশ। এবং কাতারই প্রথম মুসলিম দেশ যারা ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে। এই বৈশিষ্ট্য গুলো যেমন আকর্ষণীয়, ঠিক একই রকমভাবে বিষয়গুলো একটু সন্দেহ জনকও বটে। কারণ মাত্র ১২ হাজার বর্গফুট আয়তনের, মাত্র ২৮ লক্ষ জনসংখ্যার একটি দেশের পক্ষে ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করা স্বাভাবিক বিষয় নয়। কিন্তু এই বিষয়টি সম্ভব হয়েছে কাতারের অর্থের টাকার জোড়ে। মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে কাতার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ, এবং তারা তাদের এই ধন সম্পদ বেহিসেবি খরচ করতে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। সেজন্যই একটি বিশ্বকাপ আয়োজন করতে তারা খরচ করছে ২২০ বিলিয়ন ডলার। যা বাংলাদেশের সাড়ে তিন বছরের জাতীয় বাজেটের সমান। এর বাইরেও কাতার ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হতে, প্রকাশ্যেই ২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। অভিযোগ আছে এর বাইরেও তারা ফিফার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বহু মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছে।
বিশ্বকাপ ফুটবল এবং অলিম্পিক গেমস আয়োজন করা একটি দেশের জন্য মর্যাদার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই সাথে এসব আয়োজন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক নানান সুবিধা প্রতিষ্টা করতে সহায়তা করে। ফুটবল বিশ্বকাপ এখনও পর্যন্ত ২১ বার অনুষ্ঠিত হয়েছে; ১৭ টি দেশ এই আসর গুলো আয়োজন করেছে। কোন দেশ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করবে, বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার কনগ্রেস তা নির্ধারণ করে। ফিফা কনগ্রেসে ভোটাভুটির মাধ্যমে একটি দেশকে নির্বাচন করা হয়। সাধারণত কোন টুর্নামেন্ট শুরু সাত থেকে আট বছর আগে, বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ নির্বাচন করা হয়। কিন্তু কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ নির্বাচন করা হয়েছিল এই বিশ্বকাপ শুরুর ১২ বছর আগে। ২০১০ সালে ফিফা কনগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০১৮ বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচনের সময়ই, ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজক হিসেবে কাতারকে নির্বাচন করা হয়। কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হওয়ার পর, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া সহ অনেকগুলো দেশ এর বিরোধিতা করে এবং ফিফার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের অনুসন্ধানে ফিফার দুর্নীতি এবং কাতারের অর্থনৈতিক প্রভাব খাটানোর সত্যতা পাওয়া যায়। ফিফা সেক্রেটারি জেনারেল জেরোম ভালকে স্বীকার করেছিলেন যে, পশ্চিমা ধাচের গনতান্ত্রিক দেশের চেয়ে, রাজতন্ত্র এবং একনায়ক তান্ত্রিক দেশের সাথে কাজ করা সহজ। কারণ জার্মানী বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গেলে, বিভিন্ন ধাপে অনুমতি নিয়ে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অনেক সময় লাগে। তার বিপরীতে রাশিয়ার মত অলিখিত একনায়কতান্ত্রিক দেশ বা কাতারের মত প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রের দেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোন সময় লাগে না। তাই এদের সাথে ফিফার কাজ করতেও সুবিধা।
বিশ্বকাপ আয়োজনের বিডে অংশ গ্রহণ করার আগে কাতার অন্যান্য আঞ্চলিক গেমসের আসর আয়োজন করে নিজেদেরকে প্রস্তুত করেছে। ২০১১ সালে এএফসি এশিয়ান কাপ ফুটবল এবং আরব গেমস আয়োজনের জন্য কাতার বিডে অংশ গ্রহণ করে জিতেছিল। এরপর ২০১৫ সালে হ্যান্ড বল বিশ্বকাপ এবং ২০১৯ সালে অ্যাথলেটিক্সের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজনের জন্য কাতার প্রতিযোগীতা করে। কম গুরুত্বপূর্ণ এসব আয়োজনের বিডে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল, কাতারকে কার্যকর আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান আয়োজক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এর মধ্যে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির ক্রিড়াবিদদের কিভাবে ম্যানেজ করতে হয়, তার একটি অনুশীলও হয়ে যায় কাতারের।
২০১০ সালে আফ্রিকান ফুটবল কনফেডারেশনে কাতার বিপুল অর্থ সহায়তা দিয়েছিল। এর বিনিময়ে আফ্রিকান দেশ গুলো কাতারের পক্ষে ভোট দেয়। কাতারের মোহাম্মদ বিন হাম্মান ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ছিল। এছাড়া তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫ বছর ফিফার ২৪ সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। ২০১১ সালে ফিফার এথিক্স কমিটি মোহাম্মদ বিন হাম্মান কে দুর্নীতির অভিযোগে আজীবন নিষিদ্ধ করে। ২০১২ সালে তার সদস্য পদ আবারো ফিরিয়ে দেয়া হয়। এরপর আবারো অনিয়মের অভিযোগে তাকে দ্বিতীয়বারের মত ফিফা থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়। তার আগে ২০১০ সালে মোহাম্ম বিন হাম্মান ফিফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটারের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারনাও চালিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সে সেপ ব্লাটারকে সমর্থন দিয়ে তার প্রার্থীতা প্রত্যাহার কওে নেয়। অনেকে মনে করেন, এই কারণেও সেপ ব্লাটার কাতার কে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে সহায়তা করেছে। পরবর্তীতে যদিও, দীর্ঘ ১৭ বছর ফিফার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করা সেপ ব্লাটারকেও ২০১৫ সালে দুর্নীতির দায়ে ফিফা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়।
বিশ্ব ফুটবলের কেন্দ্র ইউরোপের সমর্তন আদায়ের জন্য কাতার অনেক চেষ্টা করেছে। বাসেলোনা ফুটবল ক্লাবকে ৫ বছরের জন্য কাতার ১৫০ মিলিয়ন ইউরো স্পন্সরশিপ দিয়েছিল। এছাড়া তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির প্রিয় ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মেইতে কাতার ৫০০ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া কাতারের এয়ার ফোর্সের জন্য ফ্রান্সে তৈরী ফাইটার জেট কেনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এরফলে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফিফা সদস্যদের কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের পক্ষে ভোট দিতে গোপনে প্রোরোচিত করে। জার্মানীর সর্মথন আদায়ের জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ক্রিশ্চিয়ান উলফ কে কাতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, বিশ্বকাপের জন্য তারা স্টেডিয়াম সহ যত অবকাঠামো নির্মান করবে, সেসব কাজের জন্য জার্মানির কম্পানিগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় ফুটবল প্রতিযোগীতার সম্প্রচার স্বত্ত্ব কিনে নেয় কাতারি মালিকানাধীন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আল জাজিরা। এর বাইরে বিশ্বের দরিদ্র দেশ গুলোর প্রতিভাধর খেলোয়ারদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কাতার বহু টাকা অনুদান দেয়। সেই সাথে বিশ্বকাপ শেষে, কাতারের অনেকগুলো স্টেডিয়াম ভেঙে, সেগুলোকে দরিদ্র দেশে দান করে দেওয়ার ঘোষনা দেয় কাতার। সবকিছু মিলিয়ে কাতার এত টাকা খরচ করে যে, ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজনে আগ্রহী অন্যান্য দেশ প্রচারণার দিক থেকে কাতারের ধারে কাছেও আসতে পারেনি।
ফিফার কার্যনির্বাহী সদস্যদের সাথে লবিং করে যে, সহজেই বিশ্বকাপ আয়োজন করা যায় তা এখন সবাই জানে। তবে কাতারের মত লবিং হয়ত কেউ করতে পারবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপান সহ অনেক দেশই ফিফা কমিটির দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছে। কিন্তু রাশিয়া বা কাতার এসব পরোয়া না করে, তারা বরং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বেশি থেকে বেশি টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে। সেজন্যই ২০১৮ সালে রাশিয়া এবং ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপ আয়োজক হতে পেরেছে। সমালোচকেরা বলেছে, কাতার এবং রাশিয়া ফিফার নিয়মেই ফিফার সাথে খেলেছে। আর ফিফার নিয়মই যে, দুর্নীতি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কাতার বিশ্বকাপ বিড জেতার জন্য কত টাকা খরচ করছে তার সঠিক হিসেব কেউ বলতে পারে না। তবে দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, কাতার বিভিন্ন পাবলিক ফন্ডেই আনুমানিক ২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এর বাইরে ফিফার বিভিন্ন কর্মকর্তাকে তারা গোপনে কত টাকা দিয়েছে তার হিসেব বের করা সম্ভব নয়। কাতারের সাথে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রতিদ্বন্দীতায় অস্ট্রেলিয়া ৪২ মিলিয়ন ডলার, ইংল্যান্ড ২৪ মিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাষ্ট্র ৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। এই পরিমাণ অর্থ খরচ করার জন্যও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে এই কারণে প্রতিবাদ হয়েছিল যে, বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য এসব খরচ বাড়াবাড়ি। যদিও তা কাতারের খরচের তুলনায় তেমন কিছুই না। সবারের ভোটাভটিতে অন্যান্য দেশ কে ব্যালট পেপার থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় এবং শুধুমাত্র কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভোট হয়। কাতার পায় ১৪ ভোট আর যুক্তরাষ্ট্র পায় ৮ ভোট। টাকা দিয়ে ভোট কিনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রকেও যে হার মানানো যায়, কাতার তাই দেখিয়ে দিয়েছে।