কাঁটাতারের বেড়া কেন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কাঁটা হয়ে উঠল
কাঁটাতারের বেড়া কেন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কাঁটা হয়ে উঠল
ভূমিকা
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোকে কেন্দ্র করে, দুই দেশের মধ্যে একের পর এক উত্তেজনা তৈরী হচ্ছে। সীমান্তে দুই দেশের মানুষ দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে মারামারিও করেছে। সেই সাথে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে।
ভারত যে চুক্তির বলে সীমান্তের দেড়শ গজের ভেতরে কাঁটাতারের বেড়া বসাতে চাচ্ছে; বাংলাদেশের পক্ষে সেই দেশ বিরোধী চুক্তি সাক্ষর করেছিল হাসিনা সরকার।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর ইতিহাস কয়েক দশকের পুরনো। সীমান্ত নিরাপত্তার কথা বলে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি কেবল একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নয়, এটি দুই দেশের সম্পর্ক, রাজনীতি, এবং সীমান্তবাসীর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
সীমান্ত সমঝোতা চুক্তি
১৯৭৫ সালে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, সীমান্তরেখা বা জিরো লাইন থেকে দেড়শো গজের মধ্যে কোনো পক্ষই এমন স্থাপনা তৈরি করতে পারবে না যা ‘প্রতিরক্ষা সামর্থ্য’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এমনকি উন্নয়নমূলক কোনো স্থাপনা তৈরি করতে হলেও অপর পক্ষের সম্মতি নিতে হবে।
১৯৮৫ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সরকার ঘোষণা দেয়, তারা বাংলাদেশ সীমান্তের চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি এলাকা জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে সময়, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
ততদিনে ভারত তাদের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান বর্ডারে কাঁটাতার বসানোর কাজ শুরু করে দিয়েছিল। তাদের মতে, এই ব্যবস্থা অবৈধ পারাপার, চোরাচালান ও জঙ্গি কার্যকলাপ প্রতিরোধে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তাই একই কৌশল পূর্ব সীমান্তে বাংলাদেশের সাথেও প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় ভারত।
কাঁটাতারের বেড়া
ভারত ১৯৮৯ সালে প্রথম বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর কাজ শুরু করে। তখন ৮৫৪ কিলোমিটারের মতো সীমান্তে কাঁটাতার বসানো হয়, যা মোট সীমান্তের প্রায় ২০ শতাংশ। ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিতে শুরু করার পর দেখা যায়, সীমান্তের অনেক জায়গাতেই দেড়শো গজের ভেতরে বেড়া দেওয়ার ‘শর্ত’ মানা সম্ভব হচ্ছে না। পরবর্তীতে ২০০০ সালে ভারত কাঁটাতারের বেড়া বসানোর দ্বিতীয় ধাপ অনুমোদন করে। এই পর্যায়ে আরও ২৪৩০ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া বসানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রায় চার দশক পরেও ভারত এই কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি।
২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সেই সমস্যা অনেকটাই সমাধান হয়ে যায়। কারণ দুই দেশের স্বরাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে, ভারতকে সীমান্তের দেড়শ গজের ভেতরেও কাঁটাতারের বেড়া বসানোর অনুমতি দেয় দিল্লীদাসী হাসিনা সরকার। ২০১০ সালের মার্চে দিল্লিতে বিএসএফ ও বিজিবি মহাপরিচালকদের এক বৈঠকে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এর প্রধান এই বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানায়। বাংলাদেশ ভারতকে এই অনুমতি দেওয়ার পর, ২০১০ সাল থেকে ভারত সীমান্তের অনেক জায়গায় জিরো লাইনের ভেতরেও বেড়া বসাতে শুরু করে।
তার কিছুদিন পরেই, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানি খাতুন কে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। নরপশু বিএসএফ এখানেই ক্ষান্ত হয় নি। এরপর তারা ফেলানির লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে দেয়। যে ছবি দেখে শোকে কাতর সমগ্র বাংলাদেশ ভারতের বিরুদ্ধে, ক্ষোভ এবং প্রতিবাদে েফটে পড়েছিল। ভারতের ভেতরেও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানো নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়। সীমান্তবাসী মানুষেরও পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি থাকলেও, তারা সরাসরি এর বিরোধিতা করেনি।
বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ সুদীর্ঘ সীমান্তের মোটামুটি আশি শতাংশ জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া বসানো হয়েছে। বাকি জায়গাগুলোতে এখনও নানা কারণে কাজ থেমে রয়েছে। সেই সাথে বেড়া বসানো নিয়ে দুই দেশের সীমান্ত অঞ্চলে বিবাদ এবং সংঘাতের ঘটনাও একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের অবস্থান
প্রথমবার যখন ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর কাজ শুরু করে, তখন বাংলাদেশের কাছ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক অনুমতি চাওয়া হয়নি। ভারত তখন যুক্তি দিয়েছিল যে তারা নিজেদের সীমান্তে, নিজেদের ভূখণ্ডে বেড়া বসাচ্ছে, তাই অন্য পক্ষকে জানানো বা সম্মতি চাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যদিও ভারতের এই ‘একতরফা পদক্ষেপ’ বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য ছিল না, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশও এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেনি। আন্তর্জাতিক ফোরামেও এই বিষয়ে বাংলাদেশ কখনো অভিযোগ জানায়নি। জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়া এ বিষয়ে কথা বলে ভারতকে ক্ষেপিয়ে তুলে তাদের গদি নড়বড়ে করতে চায়নি। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকেই ছিল ভারতকে তোষামোদী করে, তাই এ বিষয়ে কথা বলা তো দূরের কথা, হাসিনা উল্টো দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতকে সুবিধা দিয়ে গেছে।
বেড়া বসানোর ফলে কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুবিধা হয়েছে। ভারত থেকে গরুর চালান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ধীরে ধীরে গরু উৎপাদনে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। তবে কাঁটাতারে বেড়ার কারণে সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হয়েছে, দুই দেশের সীমান্ত এলাকার কৃষকদের, যাদের কৃষিজমি কাঁটাতারের অন্য পাশে পড়েছে। বিএসএফের দেওয়া বিশেষ পারমিট নিয়ে তারা দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য চাষাবাদের সুযোগ পান। কিন্তু মাঝেমধ্যে নানা কারণে সীমান্তের গেট খোলা হয় না। এমন পরিস্থিতিতে অনেক সময়ই কৃষকদের জমির ধান চুরি হয়ে যায়, যা তাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।
ভারত এখন কেন বেড়া দিচ্ছে?
২০২১ সালের আগস্ট মাসে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় যে, তারা বাংলাদেশ সীমান্তে ৪০৯৭ কিলোমিটারের মধ্যে ৩১৪১ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া বসাতে সক্ষম হয়েছে। তারপর থেকে এখনও কাজ খুব সামান্যই এগিয়েছে। যে অংশে এখনও বেড়া বসানো যায়নি তার অন্যতম কারণ নদীনালা এবং জলাভূমি। এইসব এলাকায় ড্রোন, স্মার্ট ফেন্সিং বা সেন্সরের মত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে ভারত।
তবে এমন কিছু অংশ রয়েছে যেখানে ভূপ্রকৃতি অনুকূল, কিন্তু নানা কারণে এখনও সেখানে বেড়া বসানো সম্ভব হয়নি। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাধা, ভারতীয়দের জমি অধিগ্রহণের সমস্যা এবং কোভিড মহামারি। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ২২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত থাকার কারণে, এখানেই সবচেয়ে বেশি সমস্যা রয়েছে।
গত ১২ জানুয়ারি ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনারকে তলব করে বাংলাদেশ সরকার জানিয়ে দেয় যে, সীমান্তের দেড়শো গজের মধ্যে এবং বাংলাদেশকে না জানিয়ে কোনো স্থাপনা তৈরি করলে তা মেনে নেওয়া হবে না। এর ঠিক পরদিনই দিল্লিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে ডেকে ভারত জানায় যে, তারা সব প্রোটোকল এবং চুক্তি মেনেই সীমান্তে কাজ করছে। ভারত যে চুক্তির কথা বলে জিরো লাইনে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর কাজ করছে, ভারতকে সেই অবৈধ কাজের লিখিত লাইসেন্স দিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। সেকারণেই মূলত ভারত একের পর বিতর্কিত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবং বাংলাদেশও এর বিরুদ্ধে আইনত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
কাঁটাতারের বেড়া বসানোর কাজ ভারতের জন্য কখনোই সহজ ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায়, কাঁটাতারের বেড়া কে কেন্দ্র করে, ভবিষ্যতেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের আরো অবনতি হবে।