কর্ণফুলী টানেল
কর্ণফুলী টানেল
বাংলাদেশে যতগুলো মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে, তার মধ্যে কর্ণফুলী টানেল অন্যতম। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত এই সুড়ঙ্গের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এটি বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নদীর তলদেশে স্থাপিত সুড়ঙ্গ। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যাতায়াত আরো নির্বিঘœ করতে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কর্ণফুলী টানেল ব্যাপক অবদান রাখবে।
চীনের সাংহাইয়ের ওয়ান সিটি টু টাউন মডেলের আদলে, বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে, কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে ব্যাপক বানিজ্যিক অঞ্চল তৈরীর পরিকল্পনা করা হয়। একদিকে চট্টগ্রামের মূল শহর এবং অপর দিকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করবে কর্ণফুলী টানেল। বঙ্গবন্ধু টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কিলোমিটার। প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে। সুড়ঙ্গটির মূল দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কিলোমিটার হলেও এর সঙ্গে ৫ কিলোমিটারের বেশি সংযোগ সড়ক এবং ৭২৭ মিটার দীর্ঘ একটি ফ্লাইওভার থাকবে। চট্টগ্রাম শহরপ্রান্তের নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে শুরু হওয়া এই সুড়ঙ্গ নদীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা প্রান্তের চিটাগাং ইউরিয় ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে। কর্ণফুলী নদীর ১৫০ ফুট গভীরে সুড়ঙ্গ নির্মান করা হয়েছে। এই সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হবে। সুড়ঙ্গটি নির্মিত হলে এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ। শুধু তাই নয় এটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে কোন নদীর তলদেশের নির্মিত প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গ। বঙ্গবন্ধু সুড়ঙ্গ চালু হলে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী গাড়িগুলোকে আর মূল চট্টগ্রাম শহরের ভেতর ঢুকতে হবে না। সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। ফলে চট্টগ্রাম নগরে যানবাহনের চাপ অনেক কমে যাবে। এছাড়া ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমবে প্রায় ৫০ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলেমিটার কমে যাবে। ফলে কর্ণফুলী টানেলকে ঘিরে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন এ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এই সুড়ঙ্গ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কর্ণফুলী টানেলের নির্মান কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। নদীর নিচে দুটি সুড়ঙ্গ সহ টানেলের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এখন টানেলে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য জেনারেটর স্থাপন, বাতাস ও অক্সিজেন পরিবহনের প্রযুক্তি স্থাপন, ডেকোরেটিভ ওয়াল, ফায়ার ওয়াল, ওপেন কাট এরিয়া, ছাউনিসহ কেবল লাইন ও লাইটিংয়ের কাজ চলছে। তবে পরীক্ষামূলকভাবে ইতোমধ্যে নদীর তলদেশের এই সুড়ঙ্গ দিয়ে গাড়িও চালানো হয়েছে। সম্পূর্ণ কাজ শেষ করার জন্য কর্তৃপক্ষ আরো ৬ মাস সময়ে চেয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে সুড়ঙ্গের একটি লেন চালুর সম্ভাবনা রয়েছে, এবং সম্পূর্ণ টানেল খুলে দিতে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগবে।
চট্টগ্রাম শহরের দিক থেকে ৫টি সড়ক দিয়ে কর্ণফুলী টানেলে যাওয়া যাবে। সড়কগুলো হল ১.আউটার রিং রোড ২.এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ৩.কাঠগড় সড়ক ৪.এয়ারপোর্ট সড়ক এবং ৫.পতেঙ্গা বিচ সড়ক। এই ৫টি সড়ক থেকেই টানেলে প্রবেশ পথ থাকবে। চট্টগ্রাম শহরের অপরপাশে, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণে আনোয়ারায় রয়েছে কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইপিজেড, চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা, পারকি সমুদ্র সৈকত সহ বহু নির্মানাধীন বেসরকারী শিল্প অঞ্চল। এই সড়ক দিয়ে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের যাতায়াত অনেক সহজ হবে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর, বে টার্মিনাল, চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমান বন্দর এবং মিরসরাই ইকোনমিক জোনের মধ্যে যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। বঙ্গবন্ধু টানেলের কারণে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দেশের সর্ববৃহৎ ইকোনমিক করিডোর গড়ে উঠবে। এছাড়া এই সুড়ঙ্গ হবে এশিয়ান হাইওয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। কর্ণফূলীর দক্ষিণ পাড়ে গার্মেন্টস, জাহাজ নির্মাণ, ভোজ্যতেল, মাছ প্রক্রিয়াকরণ, ইস্পাত, সিমেন্টসহ অন্তত ৮০টি শিল্প কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যাসায়ীরা। বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ যত এগিয়েছে ততই স্থাপিত হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা; আসছে নতুন বিনিয়োগ। আবার পুরনো অনেক কারখানাও সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে কোরিয়ান ইপিজেডে চারটি পোশাক কারখানা চালু হয়েছে। এবং চায়না ইপিজেডে আরো ১৫ টি দেশী বিদেশী পোশাক কারখানায় বিনিয়োগের প্রস্তুতি চলছে। অতীতে এই অঞ্চলের মাত্র ২ শাতংশ জমি শিল্পখাতে ব্যবহার করা হয়েছে। টানেল চালু হলে এখানকার প্রায় ২৭ শতাংশ জমি শিল্প উন্নয়নের ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আনোয়ারা উপজেলায় কারখানা স্থাপনের লক্ষে দেশের শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ সহ শত শত প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার একর জমি কিনে রেখেছে। এছাড়া বর্তমানে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারের সাথে দেশের অন্যান্য অংশের যোগযোগ হয় শাহ আমানত সেতু এবং কালুর ঘাট সেতু দিয়ে। কর্ণফুলী টানেল চালু হলে, পরিবহণ খরচ এবং সময় দুটোই বাঁচবে। এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক মানের গভীর সমুদ্র বন্দর এবং বিমান বন্দর থাকায় কর্ণফুলী টানেল কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাপক গতি পাবে।
সুড়ঙ্গ নির্মানের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। পরবর্তীতে এই ব্যয় বেড়ে দাড়ায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। চুক্তি অনুযায়ী চীনের এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। ২ শতাংশ হারে সুদ সহ সম্পূর্ণ টাকা ২০ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া প্রকল্পের বাকি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। তবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ব্যয় আরো বাড়ছে। টানেলের নির্মান সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত আরো ৭০০ কোটি টাক দরকার হবে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলছে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়। এছাড়া সুড়ঙ্গের জন্য নতুন করে স্ক্যানার কিনতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা খরচ হবে। সবমিলিয়ে টানেলের মোট ব্যয় ১১ হাজার কোটি টাকার ছাড়িয়ে যাবে। কর্ণফুলী সুড়ঙ্গের টোল নির্ধারণ একটি গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়। পদ্মা সেতুর টোল বেশি হলেও, পদ্মা সেতুর বিকল্প আর কোন পথ নেই; তাই পদ্মা নদী পারাপারে যানবাহন গুলো অধিক টোল দিতে বাধ্য। কিন্তু যেহেতু কর্ণফুলী টানেলের বিকল্প সড়ক রয়েছে, তাই এই পথে টোলের হাড় বেশি হলে, অধিকাংশ মানুষ শাহ আমানত সেতু ব্যবহার করবে। সেক্ষেত্রে এত ব্যয়ে নির্মিত এই সুড়ঙ্গ জনগনের তেমন কাজে আসবে না।
কর্ণফুলী টানেলের সুফল অনেকটাই নষ্ট হতে পারে এর যানবাহন ব্যবস্থায় যথেষ্ট পরিকল্পনা গ্রহন না করার কারণে। যেহেতু ৫টি প্রধান সড়ক এই সেতুর প্রবেশ দ্বারে একত্রিত হবে, সেহেতু যানবাহনের যথেষ্ট চাপ তৈরী হবে। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকার নির্মাণাধীন গোলচত্বরে যান চলাচল ব্যবস্থাপনাসহ ১২টি বাধা চিহ্নিত করা হয়েছে। এই গোলচত্বর হয়েই টানেলের গাড়ি আসা-যাওয়া করবে। টানেলের উত্তর প্রান্তে অর্থাৎ চট্টগ্রাম শহরের দিকে প্রয়োজনীয় সড়ক ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার দ্বায়িত্বে ছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এবং টানেলের দক্ষিণ প্রান্তে অর্থাৎ আনোয়ারার দিকে অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরিকল্পনার জন্য সেতু বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া সুড়ঙ্গ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, নির্মাণকারী সংস্থা চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এবং অভি অরূপ অ্যান্ড পার্টনার্স হংকং লিমিটেড যৌথভাবে টানেল নির্মাণের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা করেছিল। কিন্তু কোন পরিকল্পনা বা সমীক্ষায়ই যান চলাচলের প্রকৃত সম্ভাবনার চিত্র উঠে আসেনি। এই অব্যবস্থাপনার জন্য সেতু কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পরস্পরকে দোষারোপ করছে। সমীক্ষায় ধারণা দেওয়া হয়েছিল, সুড়ঙ্গ চালুর প্রথম বছর টানেল দিয়ে ৬৩ লাখ গাড়ি এবং ২০৩০ সালের পরে কক্সবাজারের গভীর সমুদ্রবন্দর এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো চালু হাবার পর বছরে এককোটি ৩৯ লাখ গাড়ি এই পথে চলাচল করতে পারে। এর অর্ধেকই হবে পণ্যবাহী গাড়ি। প্রথমদিকে টানেল দিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক হলেও, ১০ বছর পর টানেলের যানচলাচল যে অস্বাভাবিকভাবে বিঘিœত হবে, সে বিষয়য়ে সকলেই নিশ্চিত। এছাড়াও টানেলের কাছে একাধিক সড়কের বিভিন্ন মোড় এবং এক সড়ক থেকে আরেক সড়কে যাওয়ার ব্যবস্থায় অনেক জটিলতা আছে। এতবড় মেগা প্রকল্পে এধরনের ত্রুটিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলোকে পরিকল্পিত উন্নয়ন বলা যাবে না, এটা অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে অস্থায়ী সমাধানের মত। ভবিষ্যতে আরো ১০০ বছর যানচলাচলের চাপ সামাল দেওয়ার জন্য, সেতু কর্তৃপক্ষ একটি আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করছে। এতে আরো সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা খরচ হবে। এর চেয়েও আশঙ্কার আরেকটি বিষয় হল, পতেঙ্গা থেকে নেভাল একাডেমি পর্যন্ত প্রায় ১.১ কিলোমিটার এলাকায় কোনো বাঁধ নেই। বড় ধরনের জলোচ্ছাসে মোহনার এই অংশ দিয়ে পানি ঢুকে কর্ণফুলী টানেল প্লাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রকল্প কর্তৃপক্ষে দাবি, টানেলে ফ্লাডগেইট থাকায় সুড়ঙ্গের ভেতরে পানি ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। তবে বিষয়টিকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলেছে, আউটার রিং রোডের বাঁধের আদলে এখানেও দেয়াল নির্মাণ করা হবে। বাংলাদেশের জনগণের টাকায় নির্মিত ব্যয়বহুল এই প্রকল্পে যেন কোন ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে সেটাই সকলের কাম্য। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, কর্ণফুলী টালেন সম্পূর্ণ চালু হলে, এই অঞ্চলের অগ্রগতি সমগ্র দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে।