এরিয়া 51

maxresdefault (6)
জীবনযাপন

এরিয়া 51

ভূমিকা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা রাজ্যের উঁচু-নিচু পাহাড়ে ঘেরা এক রহস্যময়  নির্জন মরুভূমি অঞ্চল এরিয়া 51। এটি এমন এক এলাকা, যেখানে জন-সাধারণ প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি এই এলাকার আকাশপথও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। এর চারপাশে সতর্কীকরণ চিহ্ন, নজরদারি ক্যামেরা এবং সার্বক্ষণিক সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনী টহল দিয়ে নিশ্চিত করা হয়, যেন কোনো অনুপ্রবেশকারী ভুল করেও এরিয়া 51 এর কাছাকাছি যেতে না পারে।

এরিয়া 51 এলাকাটি দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে গোপন স্থাপনাগুলোর একটি হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ জায়গাটি নিয়ে মানুষের কৌতূহল থামেনি; বরং বছরের পর বছর ধরে এর চারপাশে জড়ো হয়েছে অসংখ্য গল্প, রহস্য আর গুজব।

অনেকে মনে করেন এখানে শুধু উন্নতমানের যুদ্ধবিমান, স্টেলথ প্রযুক্তি এবং গুপ্তচরবৃত্তির সরঞ্জাম পরীক্ষা করা হয়। অন্যদিকে কিছু মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস, ভিনগ্রহের প্রাণী এবং এলিয়েন প্রযুক্তি এখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

মার্কিন সরকারের কঠোর গোপনীয়তা, স্থানীয়দের মাঝে UFO দেখার নানা দাবি, এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে এলিয়েন নিয়ে প্রচলিত গল্প মিলিয়ে এরিয়া 51 হয়ে উঠেছে আধুনিক যুগের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও কৌতূহল জাগানো জায়গা।

Area 51 এ কি এলিয়েন আছে ?

এরিয়া 51 আসলে কী?

এরিয়া 51 মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর অধীনে পরিচালিত একটি অতি-গোপন পরীক্ষা ও উন্নয়ন কেন্দ্র, যা নেভাডা অঙ্গরাজ্যের গরুম লেকের কাছাকাছি মরুভূমি এলাকায় অবস্থিত। ১৯৫৫ সালে মূলত উচ্চ-উড্ডয়ন সক্ষম স্পাই প্লেন U-2-এর পরীক্ষা চালানোর জন্য এলাকাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটি ছিল স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনাপূর্ণ সময়কাল, যখন মার্কিন সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নজরদারি চালাতে উন্নত প্রযুক্তির গোপন গোয়েন্দা বিমান তৈরিতে ব্যস্ত ছিল।

পরবর্তীতে এখানে একের পর এক বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ও দ্রুতগামী বিমান তৈরি ও পরীক্ষা করা হয়। A-12, SR-71 ব্ল্যাকবার্ড এবং সামরিক ইতিহাসে প্রথম স্টেলথ প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধবিমান F-117 নাইটহক এর মত বিমানগুলো এরিয়া 51 এই নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব প্রকল্প এতটাই গোপনীয়তার সাথে পরিচালিত হতো যে, মার্কিন সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তাও জানতো না এখানে ঠিক কী হচ্ছে। এই গোপনীয়তা শুধু উন্নত প্রযুক্তি রক্ষা করার জন্যই নয়, বরং সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের কাছ থেকে যেকোনো তথ্য ফাঁস ঠেকানোর জন্যও ছিল অপরিহার্য।

ফলে, এরিয়া 51 শুরু থেকেই ছিল এক রহস্যময় স্থান, যেখানে আধুনিক যুদ্ধ প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ তৈরি হচ্ছিল, আর বাইরে থেকে কেউ তার সামান্যতম ধারণাও করতে পারছিল না।

এরিয়া 51 নামের উৎপত্তি

এরিয়া 51 নামটির উৎপত্তি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা টেস্ট সাইট (Nevada Test Site) নামের একটি বিশাল সামরিক পরীক্ষামূলক অঞ্চলের মানচিত্র থেকে। ১৯৫০ এর দশকে নেভাডার এই অঞ্চলকে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা ও অন্যান্য সামরিক কার্যক্রমের জন্য কয়েক ডজন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রতিটি ভাগকে “এরিয়া” (Area) নামে এবং একটি সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, যেমন Area 1, Area 2, Area 3 ইত্যাদি।

যে অংশে বর্তমানে গোপন বিমান পরীক্ষা কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছিল, মানচিত্রে সেটি “Area 51” নামে চিহ্নিত ছিল। এই নামটি আসলে কোনো রহস্যময় বা কাব্যিক অর্থ বহন করে না; বরং এটি ছিল একেবারেই প্রশাসনিক ও মানচিত্রভিত্তিক একটি সাংকেতিক নাম। পরবর্তীতে যখন এখানে গোপনীয় সামরিক প্রযুক্তি ও বিমান উন্নয়ন শুরু হয়, তখনও সেই পুরনো নাম “এরিয়া 51” অপরিবর্তিত থাকে।

তবে জনসাধারণের কাছে এই নামটি ধীরে ধীরে শুধু ভৌগোলিক চিহ্ন নয়, বরং রহস্য, গোপনীয়তা এবং ভিনগ্রহবাসী সংক্রান্ত নানা গুজবের প্রতীকে পরিণত হয়। আজকের দিনে “এরিয়া 51” বললেই মানুষের মনে প্রথমে ভেসে ওঠে গুপ্ত সামরিক প্রকল্প আর এলিয়েন তত্ত্বের কথা, যদিও এর প্রকৃত নামকরণের পেছনে ছিল কেবল মানচিত্রের একটি সাধারণ সংখ্যা।

এরিয়া 51 প্রথম কবে আলোচনায় আসে?

“এরিয়া 51” নামটি সাধারণ মানুষের আলোচনায় আসে ১৯৮৯ সালে, যখন রবার্ট লাজার নামের এক ব্যক্তি লাস ভেগাসের একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে দাবি করেন যে তিনি নেভাডার একটি অতি-গোপন স্থাপনায় ভিনগ্রহের মহাকাশযান ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন। তার কথায়, সেখানকার গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল এলিয়েন প্রযুক্তি উন্মোচন ও পুনর্নির্মাণ করা। এই বক্তব্য দ্রুতই গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়। যদিও পরবর্তীতে তার পেশাগত ও শিক্ষাগত পটভূমি নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে এবং অনেকেই তার দাবি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন, তবুও এই ঘটনাই প্রথমবারের মতো এরিয়া 51-কে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত করে তোলে।

এর আগে সরকারি নথিপত্রে এই এলাকা কেবল একটি পরীক্ষামূলক সামরিক অঞ্চলের সাংকেতিক নম্বর হিসেবে উল্লেখ থাকত এবং এ বিষয়ে জনসাধারণের তেমন কোনো ধারণা ছিল না। বহু বছর নীরব থাকার পর ২০১৩ সালে মার্কিন সরকার Freedom of Information Act-এর আওতায় কিছু ঐতিহাসিক নথি প্রকাশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে এরিয়া 51-এর অস্তিত্ব স্বীকার করে। তবে মার্কিণ সরকার এখনো পর্যন্ত এলিয়েন বা ভিনগ্রহের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার দাবিকে স্বীকার করেনি, যা রহস্যকে আরও গভীর করে তুলেছে।

কেন এরিয়া 51 এত আলোচিত?

এরিয়া 51 আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার মূল কারণ হলো এর চরম গোপনীয়তা এবং ভেতরে আসলে কী ঘটছে তা নিয়ে জনসাধারণের অজ্ঞতা। নেভাডার মরুভূমির এই নির্জন এলাকায় সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ, এমনকি আকাশপথেও কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকে। ফলে বাইরের লোকজন শুধুমাত্র দূর থেকে অদ্ভুত আলো বা অচেনা উড়ন্ত বস্তুর ঝলক দেখতে পেতেন। বিশেষ করে ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে, যখন এখানে U-2 স্পাই প্লেন এবং SR-71 ব্ল্যাকবার্ডের মতো উচ্চ-উড্ডয়ন ও উচ্চগতির বিমান পরীক্ষামূলকভাবে উড়ানো হচ্ছিল, তখন সেই অস্বাভাবিক গতিবিধি ও উচ্চতায় উড়ন্ত বস্তুগুলোকে অনেকেই UFO বা “অজানা উড়ন্ত বস্তু” বলে ধারণা করতেন।

সাধারণত UFO বলতে এলিয়েন বা ভিনগ্রহের প্রাণীদের যানবাহন বোঝানো হয়। তবে এই এলাকায় যেহেতু নতুন ধরনের বিমান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হত, তাই সাধারণ জনগণ সেগুলোকেও UFO বলে মনে করাটা অস্বাভাবিক নয়।

১৯৮৯ সালে রবার্ট লাজার এরিয়া 51 এ এলিয়েন মহাকাশযান নিয়ে কাজ করার বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর থেকে, এখানকার রহস্যময় কার্যকলাপ ঘিরে জনমনে সন্দেহ আরও বাড়তে থাকে।

হলিউড সিনেমা Independence Day, টিভি সিরিজ The X-Files, এবং অসংখ্য সায়েন্স ফিকশন বই ও ভিডিও গেম এরিয়া 51-কে এলিয়েন প্রযুক্তি সংরক্ষণের জায়গা হিসেবে দেখিয়েছে। এসব কাহিনি বাস্তব ও কল্পনার সীমা মুছে দিয়েছে, ফলে UFO ও ভিনগ্রহের সম্ভাবনা নিয়ে মানুষের বিশ্বাস আরও গভীর হয়েছে।

আসলেই কি এরিয়া 51 এ এলিয়েনে আছে?

এরিয়া 51 এলিয়েন বা ভিনগ্রহবাসীর অস্তিত্বের দাবি সমর্থন করার মতো কোনো প্রমাণ কখনো প্রকাশিত হয়নি। UFO-সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর অনেক ব্যাখ্যাই দেওয়া হয়েছে পরীক্ষাধীন বিমান বা গোপন ফ্লাইট কার্যক্রমের মাধ্যমে। তবুও এলিয়েন তত্ত্বগুলো জনমনে টিকে আছে, কারণ গোপনীয়তার আবরণ মানুষের কল্পনাকে সবসময়ই উসকে দেয়।

১৯৪৭ সালে নিউ মেক্সিকোর রসওয়েল শহরের কাছে একটি অচেনা বস্তু পতনের ঘটনা ঘটে। শুরুতে মার্কিন সেনাবাহিনী এটিকে “ফ্লাইং ডিস্ক” বলে উল্লেখ করলেও পরে দাবি করে এটি একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ বেলুন ছিল। অনেক UFO গবেষকের মতে, রসওয়েলে পাওয়া ধ্বংসাবশেষ এরিয়া 51-এ নিয়ে গিয়ে গোপনে পরীক্ষা করা হয়েছিল। যদিও মার্কিন সরকার এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ স্বীকার করেনি, তবুও এই গল্প জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে।

এরিয়া 51 প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানে উচ্চ-উড্ডয়ন সক্ষম U-2 এবং পরে SR-71 ব্ল্যাকবার্ড পরীক্ষামূলকভাবে উড়ানো হয়। এই বিমানগুলো তখনকার সময়ে বেসামরিক আকাশযানের চেয়ে অনেক উঁচুতে ও দ্রুত উড়ত। দূর থেকে সাধারণ মানুষ বা পাইলটরা এই অস্বাভাবিক উড্ডয়নকে “অজানা উড়ন্ত বস্তু” (UFO) বলে রিপোর্ট করতেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী অনেক সময় এসব ঘটনার ব্যাখ্যা না দিয়ে গোপন রাখত, যা জনমনে UFO গুজবকে আরও জোরদার করেছিল।

বর্তমানে এরিয়া 51 কি অবস্থায় আছে?

বর্তমানে এরিয়া 51 যুক্তরাষ্ট্রের এডওয়ার্ডস এয়ার ফোর্স বেসের অধীনে পরিচালিত হয় এবং এখনো সক্রিয় রয়েছে। এখানে কী ধরণের প্রকল্প চলছে তা প্রকাশ করা হয় না, তবে ধারণা করা হয় আধুনিক স্টেলথ প্রযুক্তি, ড্রোন এবং হাইপারসনিক বিমান সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা বর্তমান সময়েও চলমান রয়েছে।

অনেক অনেক প্রাক্তন কর্মী, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এবং UFO গবেষক দাবি করেন, এখানে বিশাল ভূগর্ভস্থ স্থাপনা থাকতে পারে। যেখানে গোপন হ্যাঙ্গারে বড় আকারের বিমান বা পরীক্ষাধীন যান লুকিয়ে রাখা হয়। এছাড়া মাটির নিচে থাকা এসব গবেষণাগার ও ওয়ার্কশপেই হয়ত  উন্নত প্রযুক্তি বা সম্ভাব্য ভিনগ্রহীয় বস্তু নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, গরুম লেকের (Groom Lake) শুষ্ক হ্রদটির চারপাশে রানওয়ে ছাড়াও কিছু জায়গায় অস্বাভাবিক বড় ঢিবি ও মাটির উঁচু অংশ রয়েছে, যা সম্ভবত ভূগর্ভস্থ স্থাপনার ছাদ বা বায়ু চলাচলের পথ হতে পারে। এছাড়া প্রাক্তন কিছু ঠিকাদার দাবি করেছেন, এলাকা জুড়ে মাটির নিচে বহু তলা বিশিষ্ট গবেষণা কমপ্লেক্স রয়েছে, যা আংশিকভাবে পার্বত্য এলাকায় খনন করা হয়েছে।

যেহেতু সাধারণ মানুষের এখানে প্রবেশের অনুমতি নেই এবং এর চারপাশের এলাকা কঠোরভাবে পাহারা দেওয়া হয়, তাই এরিয়া 51 এর ভেতর আসলেই এলিয়েন প্রযুক্তি আছে কিনা তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। ফলে এরিয়া 51 আজও রহস্যময়তার এক অনন্য প্রতীক হয়ে আছে।

এরিয়া 51 এর মতই রহস্যময় এক স্থান মারিয়ানা ট্রেঞ্চ। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম সমুদ্র খাত। এখানকার গভীরতার মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতার চেয়েও অনেক বেশি। এখানে পানির চাপ এত বেশি যে, একটি বাস নিয়ে গেলে, তারা পানির চাপে সঙ্কুচিত হয়ে এত ছোট হয়ে যাবে যে, বাসটি মানুষের হাতের তালুতে রাখা যাবে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।