এরদোয়ান রুটি বিক্রেতা থেকে প্রেসিডেন্ট
এরদোয়ান রুটি বিক্রেতা থেকে প্রেসিডেন্ট
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী মুসলিম নেতাদের একজন রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান। এরদোগান নামটি শুধু এখন তুরস্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং গোটা বিশ্বের এক পরিচিত নামে পরিণত হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদে টানা তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। তুরষ্কের একটি সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা এই রাজনীতিবিদের বিশ্ব নেতা হয়ে ওঠার পথটা খুব বেশি মসৃণ ছিল না। কিশোর বয়সে বাড়িতি কিছু টাকা উপার্জনের জন্য তিনি রাস্তায় রুটি আর লেবুর শরবত বিক্রি করেছেন। একটা সময় তিনি হতে চেয়েছেন ফুটবলার। কিন্তু সবশেষে হয়েছেন একজন সফল প্রেসিডেন্ট। তুরষ্কের সাম্প্রতিক নির্বাচনে জয় লাভের মধ্য দিয়ে, টানা তৃতীয় বারের মত তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এর আগে এরদোয়ান একটানা ১১ বছর তুরষ্কের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
শৈশব ও কৈশর
১৯৫৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ইস্তাম্বুলের কাছিমপাশাতে রেজেপ তায়্যিপ এরদোয়ান জন্মগ্রহণ করেন। তার যখন জন্ম হয়, তখন হিজরি ‘রজব’ মাস চলছিল। তাই তার নাম রাখা হয় রেজেপ; তুর্কি ভাষায় ‘রজব’ কে ‘রেজেপ’ বলা হয়। তার দাদার নাম তায়্যিপ এফেনদির থেকে নেয়া হয় ‘তায়্যিপ’ আর বংশীয় উপাধি ‘এরদোগান’ যোগ হয়ে পুরো নাম হয় ‘রেজেপ তায়্যিপ এরদোয়ান’।
এরদোয়ানের পিতা আহমেদ এরদোয়ান ছিলেন একজন কোষ্ট গার্ড। তিনি সন্তানদের ভালো লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন নিয়ে ইস্তাম্বুলে চলে আসেন। এরদোয়ানের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিল না। তার উপর পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। এরদোয়ান তার বাবার কাছ থেকে সামান্য কিছু টাকা হাত খরচ পেতেন। সেই টাকা দিয়ে তিনি পোস্টকার্ড কিনে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করতেন। এছাড়া তিনি রাস্তায় জ্যামে আটকে থাকা ড্রাইভারেদের কাছে পানির বোতলও বিক্রি করতেন। একটা সময় পরিবারে বাড়তি কিছু অর্থের জোগান দিতে, তুরষ্কের বিখ্যাত সিমিট রুটি আর লেবুর শরবত বিক্রি করতে শুরু করেন। সেই সিমিট বিক্রির টাকা দিয়ে পরিবারকে সাহায্য করার পাশাপাশি নিজের স্কুলের বেতনও পরিশোধ করতেন তিনি। ছোট বেলা তেকেই বই পড়ার শখ ছিল তার। নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে, কলেজ জীবনে পা রাখার আগেই তৈরি করে ফেলেন মোটামুটি বড়সড় একটি ব্যক্তিগত পাঠাগার।
খেলোয়ার জীবন
স্কুল জীবন থেকেই এরদোয়ান খুব ভালো ফুটবল খেলতেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে কামিয়াল্টি ফুটবল ক্লাবের সদস্য হিসেবে নামকরা ফুটবলারে পরিণত হন তিনি। সেখান থেকে ইস্তাম্বুলের অন্যতম জনপ্রিয় দল আইইটিটি ফুটবল টিমে পেশাদার ফুটবল খেলা শুরু করেন তিনি। এটাকে এরদোয়ানের জীবনের প্রথম চাকরিও বলা যায়। দীর্ঘদিন তিনি এখানে খেলেছেন এবং বেশ কয়েকটি ম্যাচে ক্যাপ্টেন হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
পরবর্তী সময়ে ফুটবল মাঠে তার ক্রীড়া শৈলীতে মুগ্ধ হয়ে ইস্তানবুল ফুটবল ক্লাব তাকে আমন্ত্রণ জানায়। এক পর্যায়ে তিনি জাতীয় যুব ফুটবল ক্লাবের খেলোয়াড় হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ পান। এই ক্লাবের সদস্য হবার জন অভিভাবকের অনুমতির দরকার হয়। কিন্তু এরদোয়ানের বাবা আহমেদ এরদোয়ান স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে- তিনি তাকে লেখাপড়া করে বড় করতে চান, খেলোয়াড় হিসেবে নয়। এরপর তিনি তুরস্কের অন্যতম প্রসিদ্ধ ফুটবল ক্লাব এসকেশিহির ও ফেনারবাচে ফুটবল ক্লাব থেকে আমন্ত্রণ পেলেও বাবার অস্বীকৃতির কারণে আর খেলতে পারেননি।
শিক্ষা ও রাজনৈতিক জীবন
রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান ছেলেবেলায় ইসলামিক স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭৩ সালের ইস্তাম্বুলের মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৮১ সালে তিনি ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী অর্জন করেন। ছাত্র জীবন থেকেই এরদোয়ান নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। তবে তার সফল রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়, ১৯৮৯ সালে তুরস্কের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বেইয়্যুলু পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এরপর ১৯৯১ সালে তুরস্কের সাধারণ নির্বাচনে একটি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল রেফা পার্টি থেকে এরদোয়ান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ সালে এরদোয়ান রেফা পার্টি থেকে ইস্তানবুলের মেয়র পদে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। সেসময় এরদোয়ান একজন সেরা বক্তা হিসেবে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৯৭ সালের অভ্যুত্থানের পর এরদোয়ান তার জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে দলের নেতা কর্মীদের উজ্জীবিত করে তোলেন। ১৯৯৯ সালে জনসমক্ষে জাতীয়তাবাদী একটি কবিতা পড়ার জন্য তাঁর চার মাসের জেল হয়েছিল। কবিতার কয়েকটি লাইন ছিল এরকম: “মসজিদগুলো আমাদের ব্যারাক, গম্বুজগুলো আমাদের হেলমেট, মিনারগুলো আমাদের বেয়নেট এবং বিশ্বাস হলো আমাদের সৈন্য।”
একে পার্টি গঠন
২০০১ সালে তুরষ্কে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নামে নতুন এক রাজনৈতিক দল আত্নপ্রকাশ করে। যা একে পার্টি নামে অধিক পরিচিত। নবগঠিত এই রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান হন এরদোয়ান। তারপর থেকে একে পার্টির ধারাবাহিক সাফল্যে এরদোয়ান তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। একে পার্টি গঠনের মাত্র ১৪-১৫ মাসের মাথায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তারা ক্ষমতায় আসে। তখন এরদোয়ানের উপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচন করতে পারেননি। পরবর্তীতে এরদোয়ানের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে, ২০০৩ সালে রেজেপ তায়্যিপ এরদোয়ার তুরস্কের ২৫ তম প্রধানমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন । সেই থেকে এখনও পর্যন্ত এরদোয়ান তুরষ্কের শীর্ষ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রয়েছেন। তখন থেকে তিনি ১১ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তুরস্কে একসময় প্রেসিডেন্টের পদটি আলঙ্কারিক হিসেবে থাকলেও, বর্তমানে প্রেসিডেন্টই তুরষ্কের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ২০১৪ সালে তুরস্কে প্রথমবারের মতো সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এরদোয়ান। তারপর ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক গণভোটে জয়ী হন তিনি। ২০১৮ সালের জুন মাসে প্রথম রাউন্ড নির্বাচনে ব্যাপক ভোটে বিজয়ী হয়ে মি. এরদোয়ান দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সবশেষ ২০২৩ সালের নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অনেক সমর্থক তাকে “সুলতান” নামে ভূষিত করেছেন যা অটোমান সাম্রাজ্যের সময়ে ব্যবহার করা হতো।
গুলেন মুভমেন্ট ও অভ্যুত্থান
এদোয়ান তার ক্ষমতার মেয়াদকালে একটি অভ্যুত্থানের শিকার হয়েছিলেন। এই অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল গুলেন মুভমেন্টের মধ্য দিয়ে। ২০১১-১২ সালের দিকে সরকারের ভেতরে থাকা আমলা, বিচারক, আইনজীবি, ব্যবসায়ী এবং মিডিয়াকর্মীরা এরদোয়ান সরাকারকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। ফতুল্লা গুলেন নামের একজন ধর্ম প্রচারক এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে এটি গুলেন মুভমেন্ট হিসেবে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে এদের হাত ধরেই ২০১৬ সালের ১৫ই জুলাই তুরষ্কে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। মোবাইল ফোনের একটি অ্যাপসের মাধ্যমে সেদিন এরদোয়ান জনগণের প্রতি এক ঐতিহাসিক আহবান জানান। এরদোয়ানের সেই ডাকে তুরষ্কের আপামর জনতা সেই অভ্যুত্থান রুখে দিয়েছিল।
দেশ বিদেশে এরদোয়ানের প্রভাব
অতীতে তুরষ্কের সেক্যুলার সরকারগুলোর শাসন আমলে, তুরষ্ক মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগেুলোকে এড়িয়ে, পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। ২০০২ সালের পর থেকে এরদোয়ান বিভিন্ন মুসলিম দেশে সফর করেন। এ সময় ইরাক, ইরান, উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন।১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে তুরষ্কের সেক্যুলার সরকার ইরানের সাথে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখে। কারণ তারা ভয়ে ছিল, তুরষ্কের ইসলামপন্থীরা তুরষ্কে আবার ইসলামি বিপ্লাব করে ফেলে কিনা।এরদোয়ান সরকার গঠনের পর ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগ দেয়। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে তুরস্ক যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ভালো সম্পর্কে বজায় রেখেছে। পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া কিংবা মালয়েশিয়ার মত দেশগুলো এখন তুরস্কের অন্যতম বিশ্বস্ত বন্ধু। তবে মুসলিম দেশগুলোর ভেতর সিরিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো নয়। সিরিয়ার ভূখন্ডে আগ্রাসন চালানোর কারণে এরদোয়ান বেশ সমালোচিত হয়েছেন। বিশেষ করে কুর্দি ইস্যুতে এরদোয়ান অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।
একদিকে এরদোয়ানের যেমন জনপ্রিয়তা রয়েছে অন্যদিকে তাকে নিয়ে বেশ কিছু সমালোচনাও রয়েছে। তাঁর বিরোধীরা তাকে কঠোর ভিন্নমত দমনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে। তাদের দাবী এরদোয়ান দেশের সংবাদমাধ্যম ও বিচারবিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচকেরা আরেকটি অভিযোগ আরোপ করে, তা হল এরদোয়ান ইসলামি মূল্যোবোধ আরোপের চেষ্টা করে। তুরষ্কে রাষ্ট্রীয় অফিসগুলোতে নারীদের হিজাব পরার ওপর কয়েক দশক ধরে নিষেধাজ্ঞা ছিল, ২০১৩ সালে এরদোয়ান সরকার তা প্রত্যাহার করে নেয়। এছাড়া এরদোয়ান ব্যভিচারকে ফৌজদারি অপরাধ এবং “অ্যালকোহলমুক্ত এলাকা” গড়ে তোলার চেষ্টা করে ব্যার্থ হন। সমালোচকরা বলেন, এসবই এরদোয়ানের ইসলামপন্থী আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ। তবে এরদোয়ান বলেন, ধর্মনিরেপক্ষতার বিষয়ে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তুর্কীরা যাতে আরো ভালোভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারেন, সেই অধিকারকে তিনি সমর্থন করেন।
কুর্দি ইস্যুতে এরদোয়ান বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচিত। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সিরিয়া ভূখণ্ডে কুর্দি বিরোধী অভিযান এরদোয়ানের অনধিকার চর্চা। সব মিলিয়ে এরদোয়ান যেমনি আলোচিত তেমনি সমালোচিত। কিন্তু একথা অস্বীকার করা যায় না যে, মুসলিম বিশ্বের জন্য এরদোয়ান যা করেছেন অন্য কোন রাজনৈতিক নেতার ক্ষেত্রে তা বিরল।