ইহুদিরা আল আকসা মসজিদ ধ্বংস করতে চায় কেন

maxresdefault (33)
কি কেন কিভাবে

ইহুদিরা আল আকসা মসজিদ ধ্বংস করতে চায় কেন

পবিত্র জেরুজালেম শহরের আল আকসা মসজিদ পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং ইসলামের মত পৃথিবীর প্রধান তিন ধর্মের মানুষের কাছেই এই জায়গাটি অত্যন্ত পবিত্র। ইহুদিদের কাছে এই জায়গাটি টেম্পল মাউন্ট নামে পরিচিত। এর কারণ হল, ইহুদিরা মনে করে এখানেই প্রথম এবং দ্বিতীয় জুইশ টেম্পল বা ইহুদি মন্দির ছিল। এবং তাদের থার্ড টেম্পল বা তৃতীয় মন্দিরও  এখানেই নির্মিত হবে। বর্তমানে এখানে থাকা ওয়েস্টার্ন ওয়াল ইহুদিরদের উপাসনার জন্য অন্যতম পবিত্র স্থান। খ্রিষ্টানরা মনে করে যিশু খ্রিষ্ট এখানে থাকা দ্বিতীয় মন্দিরে ধর্ম প্রচার করেছেন। মুসলিমদের কাছে মক্কা ও মদিনার পরেই আল আকসা তৃতীয় পবিত্রতম স্থান হিসেবে পরিচিত। মুসলিমরা বিশ্বাস করে, ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী হয়রত মুহাম্মদ (সা) মিরাজের রাতে এখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। এই টেম্পল মাউন্ট প্রঙ্গনে মসজিদে আকসা ছাড়াও ইসলাম ধর্মের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ডোম অব দা রক বা মসজিদে গম্বুজে সাখারা অবস্থিত।

তিন ধর্মের পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হলেও, উগ্র ইগুদিরা আল আকসা মসজিদ ভেঙে এখানে তাদের তৃতীয় মন্দির নির্মাণ করতে চায়।

ইহুদিরা আল আকসা ভাঙতে চায় কেন ?

বলে রাখা ভাল সকল ইহুদিরাই আল আকসা মসজি ধ্বংস করতে চায় না। ইহুদিদের একটি উগ্রপন্থী সন্ত্রাসবাদী দল আল আকসা ভেঙে ইহুদি মন্দির তৈরীর পক্ষে। তবে সকল ইহুদিই মনে করে এখানে তাদের তৃতীয় মন্দির নির্মিত হবে। তবে সেই মন্দির নির্মিত হবে সরাসরি ইশ্বরের সহায়তায়। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে রোমানরা ইহুদিদের সেকেন্ড টেম্পল ধ্বংস করেছিল। ধ্বংসের আগ পর্যন্ত এই জায়গাটিই ছিল ইহুদি ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র স্থান এবং প্রধান উপাসনা কেন্দ্র। ১৯৬৭ সালে ইহুদিবাদী ইসরায়েল সরকার আল আকসা সহ জেরুজালেম শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরও, একটি নীতিমালা তৈরী হয়েছিল যে, আল আকসায় শুধু মুসলিমরাই প্রার্থনা করতে পারবে এবং এখানে ইহুদিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। জাতি সংঘ এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অনুযায়ীও আল আকসা মসজিদে শুধু মাত্র মুসলিমদেরই প্রার্থনার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জোর পায়তারা চলছে। এই অবৈধ আন্দোলন টেম্পল মাউন্ট মুভমেন্ট হিসেবে পরিচিত। এর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হল, মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান এবং ফিলিস্তিন জাতির প্রতীক মসজিদ আল আকসা ভেঙে ফেলা এবং এখানে ইহুদিদের থার্ড টেম্পল বা তৃতীয় মন্দির নির্মাণ করা। এবং তাদের এই পরিকল্পনার ব্যাপারে তারা অত্যন্ত খোলামেলা। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে টেম্পল ইনস্টিটিউট ইহুদি মন্দির পুনঃনির্মাণ এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনকি মন্দিরটি কিভাবে তৈরী করা হবে এবং দেখতে কেমন হবে, তার নিখুঁত আর্কিটেকচারাল মডেলও নির্মাণ করা হয়েছে। এই মন্দির নির্মাণ করার জন্য তারা ইসরায়েলী সরকার এবং আমেরিকা, কানাডা ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে অনুদানও গ্রহণ করেছে। যে সকল ইহুদি অবৈধভাবে আল আকসা প্রাঙ্গনে প্রবেশ করে ইহুদি রীতি অনুযায়ী পশু জবাই করতে পারবে, তাদেরকে আর্থিক পুরষ্কার প্রদানেরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে টেম্পল মাউন্ট মুভমেন্ট এর পক্ষ থেকে। দীর্ঘদিন যাবৎ এই ধরনের অন্যায় কাজ ইহুদিদের মধ্যেও উদ্ভট, পাগলামি এবং উগ্রবাদি আচরণ হিসেবে বিবেচিত হত। কিন্তু বর্তমানে এই উগ্রবাদীরাই ইরায়েলী সমাজের প্রধান ধারায় পরিণত হয়েছে। মাত্র দশ বছর আগেও টেম্পল মাউন্ট মুভমেন্ট এর কোন ব্যক্তি ইসরায়েলি পার্লামেন্টে নেসেট এর সদস্য ছিল না। আর বর্তমানে টেম্পল মাউন্ট মুভমেন্ট পন্থী ২০ জন পার্লামেন্ট সদস্য রয়েছে। এমনকি ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট সহ বহু মন্ত্রী এবং নেতারা আল আকসায় ইহুদিদের প্রবেশের সমর্থনে কথা বলছে। ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন ইহুদি আল আকসা প্রাঙ্গনে প্রবেশ করত। কিন্তু বর্তমানে এই আন্দোলন মূল ধারায় পরিণত হবার কারণে, প্রতি বছর কয়েক হাজার থেকে প্রায় লাখো ইহুদি আল আকসায় অনুপ্রবেশ করছে।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বিনা কারণে মুসলিমদের অধিকারে থাকা আল আকসা প্রাঙ্গনে মুসলিমদেরকেই প্রবেশে বাঁধা দিচ্ছে। এর বিপরীতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করা ইহুদিদেরকে আল আকসায় প্রবেশে সাহায্য করছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই হয়ত, সম্পূর্ন আল আকসা ইহুদিরা দখল করে নিবে এবং এখানে মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিবে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় কয়েক মাস পর পরই, আল আকসা মসজিদে প্রার্থনারত মুসলিমদের উপর ইসরাইলি পুলিশকে বর্বর হামলা চালাতে দেখা যায়। আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গন মুসলিমদের জন্য বন্ধ করে দেয়া, প্রার্থনারত মুসলিমদের উপর টিয়ার গ্যাস এবং রাবার বুলেট ছোড়া এবং মসজিদ থেকে ফিলিস্তিনি নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করা অনেকটা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সমগ্র জেরুজালেম শহরটিই অবৈধ ইসলায়েলী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনে। সেকারণেই তারা মুসলিমদের উপর হামলা চালিয়ে আল আকসা প্রাঙ্গন খালি করে, সেখানে ইহুদিদের প্রবেশের সুযোগ করে দিতে পারছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, এটি হয়ত শুধুই দুই ধর্মের মানুষের মধ্যকার প্রার্থনার স্থান নিয়ে দ্বন্দ। কিন্তু এর পেছনে জরিয়ে রয়েছে আরো বিস্তৃত ভূরাজনীতি। জেরুজালেমের আল আকসায় যেভাবে হামলা চালানো হচ্ছে, ঠিক একই রকমভাবে ফিলিস্তিনের আরেকটি পবিত্র স্থানে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালানোর মাধ্যমে ইহুদিরা মুলিমদের কাছ থেকে তা সম্পূর্ণ ছিনিয়ে নিয়েছে।

জেরুজালেম শহরের ২০ মাইল দক্ষিনে ইসরায়েলের দখলকৃত আরেকটি শহর হেবরন। ধারণা করা হয়, হেবরনের এই ভবনের নিচে ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং ইসলাম তিন ধর্মের পিতৃপুরুষ ও নবী হযরত ইব্রাহিম (আ) এর সমাধি রয়েছে। সেকারণে ইহুদিরা এই জায়গাটিকে বলে কেভ অব দ্যা প্যাটরিয়ার্ক বা পিতৃপুরুষের গুহা এবং মুসলিমরা বলে ইব্রাহিমি মসজিদ। ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইহুদিরা ফিলিস্তিনের যে সমস্ত অঞ্চল দখল করেছিল, হেবরন ছিল সেগুলোর মধ্যে সবার প্রথমে। তারপর থেকে অত্যন্ত উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে মুসলিম এবং ইহুদিরা এক সাথে এখানে প্রার্থনা করত। ১৯৯৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আমেরিকায় জন্ম নেওয়া এক ইহুদি এই মসজিদে প্রবেশ করে, নামাজরত মুসলিমদের উপর এলোপাথারি গুলি করতে শুরু করে। যার ফলে ২৯ জন নিহত হয় এবং ১২০ জন মারাত্নক আহত হয়। এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানানোর কারণে ইসরায়েলি পুলিশ একই দিনে আরো ২০ জন মুসলিমকে গুলি করে হত্যা করে। এর পরবর্তী দুই সপ্তাহের জন্য মুসলিমদের উপর কার্ফিউ জারি করা হয়। এই বর্বর হত্যাযজ্ঞ হেবরনে মুসলিমদের অবস্থান চিরদিনের মত বদলে দেয়। হেবরনের যে এলাকা ফিলিস্তিনিদের প্রধান বাজার এবং বানিজ্যিক অঞ্চল ছিল, সেখানে ফিলিস্তিনীদের দোকান তালা দিয়ে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। হেবরনের পুরান শহরে এত বেশি ইসরায়েলি চেক পোষ্ট বসানো হয় যে, ফিলিস্তিনিরা ইব্রাহিমি মসজিদের প্রবেশ করতে পদে পদে বাঁধা গ্রস্ত হয়। এছাড়াও ইব্রাহিমি মসজিদকে জোড় পূর্বক দুটি অংশে ভাগ করা হয়, এর ৬০ শতাংশ ইহুদিদের জন্য এবং ৪০ শতাংশ মুসলিমদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। তবে সমগ্র মসজিদের নিয়ন্ত্রনের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে। আর এভাবেই ইহুদিরা নিজেরা সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড ঘটানোর মাধ্যমে, উল্টো নিজেদের নিরাপত্তার অযুহাতে মুসলিমদের একটি পবিত্র স্থান দখল করে নেয়। 

১৯৯৪ সালে হেবরনে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছিল, ঠিক একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আল আকসা মসজিদ এবং সমগ্র জেরুজালেমে ঘটার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সেই হত্যাযজ্ঞের পুনরাবৃত্তিই শুধু প্রধান শঙ্কা নয়, হেবরনের ঘটনায় জন্য যারা দায়ী ছিল, তারা ইসলায়েলের আগের চেয়ে আরো অনেক বেশি ক্ষমতাধর অবস্থায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, জেরুজালেম কে ইরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এই সঙ্কটকে আরো অনেক বেশি ঘনীভূত করেছে। ইসরায়েল এবং আমেরিকা মুখে মুখে ফিলিস্তিনিদের সাথে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যেমে সমস্যা সমাধানের কথা বললেও, বাস্তবে তারা এর ঠিক উল্টো পথে হাটছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।