ইসরায়েল লেবানন আক্রমণ করল কেন

maxresdefault (34)
কি কেন কিভাবে

ইসরায়েল লেবানন আক্রমণ করল কেন

 ইসরাইল লেবাননে হামলা শুরু করার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগে একযোগে নজিরবিহীন পেজার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এবং লেবাননের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিমান হামলা চালিয়ে ভয়াবহ এক যুদ্ধ শুরু করেছে ইহুদি সন্ত্রাসীরা। সেই আগ্রাসনের ধারাবাহিকতায় ইসরাইল লেবাননের সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ কে হত্যা করেছে। ইসরাইলি সেনারা দেশের উত্তরাঞ্চলে জড়ো হতে শুরু করেছে; যে কোনো মুহূর্তে তারা লেবাননে স্থল অভিযানও শুরু করতে পারে। সবকিছু মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্য আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধ দেখতে যাচ্ছে।

ইসরায়েল কেন লেবাননে হামলা করল ?

দ্বন্দের সূত্রপাত

লেবানন ইসরায়েলের প্রতিবেশী দেশ। ইসরায়েলে উত্তরাঞ্চল এবং লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে দুই দেশের সীমানা রয়েছে। ১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যের ভূমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরায়েল – লেবানন দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। ইসরায়েল আত্নপ্রকাশ করার সাথে সাথে; শুরু হয় প্রথম আরব – ইসরাইল যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আরবদের পক্ষে ইসরাইলকে দমন করার জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল লেবানন। সেই যুদ্ধে ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এরমধ্যে প্রায় ১ লাখ ফিলিস্তিনি লেবাননে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে। এত বিপুল পরিমাণ শরণার্থীর কারণে লেবাননের আগে থেকে তৈরি হওয়া সাম্প্রদিায়িক পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যেতে থাকে। লেবাননে লেবানিজ খ্রিস্টান এবং শিয়া মুসলিমদের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব ছিল; সেই দ্বন্দে নতুন আরেকটি পক্ষ হয়ে দাঁড়ায় ফিলিস্তিনি সুন্নি মুসলিমরা। এর সাথে আন্তর্জাতিক শক্তি হিসেবে ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং ইতালি যুক্ত হয়ে লেবাননে এক চতুমাত্রিক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই গৃহযুদ্ধ ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫ বছর স্থায়ী হয়েছিল। গৃহযুদ্ধের সময় লেবানন একটি জ্বলন্ত নরকে পরিণত হয়েছিল।

লেবাননের সেই গৃহযুদ্ধে দেশটির ক্ষমতা দখল করা নিয়ে দ্বন্দ্ব তো ছিলই; সেই সাথে তাদের মধ্যে আরেকটি বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল যে; প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও কে লেবানন থেকে ইসরাইলের উপর হামলা পরিচালনা করতে দেওয়া উচিত কিনা। পিএলও ইতোমধ্যে লেবানন থেকে ইসরাইলের আগ্রাসনের জবাব দিচ্ছিল। ১৯৭৮ সালে পিএলওর কয়েকজন কর্মী লেবানন থেকে ইসরাইলে গিয়ে একটি বাসে হামলা চালিয়ে ৩৮ জন ইসরাইলী নাগরিককে হত্যা করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে ইসরাইল অপারেশন লিটানি নামে এক অভিযান পরিচালনা করে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকা দখল করে। এই ঘটনা লেবাননে প্রথম ইসরাইলি আগ্রাসন হিসেবে পরিচিত। এরপর ১৯৮২ সালে ইসরাইল লেবাননে তাদের দ্বিতীয় আগ্রাসন পরিচালনা করে। সেই দফায় ইসরাইল লেবাননের রাজধানী বৈরুত সহ সম্পূর্ণ দক্ষিণ লেবানন দখল করে ফেলে। এবং পিএলও যোদ্ধাদের বৈরুত থেকে বের করে দিতে সক্ষম হয়।

হিজবুল্লার জন্ম

ইসরায়েল যখন লেবানন দখল করে নজির বিহীন সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছিল, সেই অস্থির সময়ে লেবাননের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সমন্বয়ে হিজবুল্লাহ গড়ে ওঠে। হিজবুল্লাহ অর্থ আল্লাহর দল। ১৯৮৫ সালে হিজবুল্লাহ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। হিজবুল্লা প্রতিষ্ঠার একটি মৌলিক কারণ ছিল, তারা অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্রের অবসান চায়। আত্নপ্রকাশের থেকে ইরানের সহায়তায় হিজবুল্লাহ ক্রমাগত রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। এক পর্যায়ে ইসরাইলিদের হটিয়ে হিজবুল্লাহ লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল নিজেদের দখলে নিতে সক্ষম হয়। ইসরাইল তাদের জাত শত্রু হিজবুল্লাহকে দমন করার জন্য, ১৯৯২ সালে হিজবুল্লার তৎকালীন প্রধান আব্বাস আল মুসাওবি কে হত্যা করে। তখন থেকে দীর্ঘ ৩২ বছর যাবৎ হিজবুল্লাহকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন হাসান নাসরুল্লাহ। সাম্প্রতিক সময়ে লেবাননের বৈরুতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে, নাসরুল্লাহকেও হত্যা করেছে ইহুদী সন্ত্রাসীরা।

হাসান নাসরুল্লাহ কোন সাধারণ নেতা ছিলেন না। তার দীর্ঘ তিন দশকের যোগ্য নেতৃত্বের বলেই; একটি ছোট্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী থেকে হিজবুল্লাহ, লেবাননের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে ইসরাইল লেবাননের যে দক্ষিণাঞ্চল দখল করার পর, দীর্ঘ ২২ বছর এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিল। কিন্তু হাসান নাসরুল্লার বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণেই ২০০০ সালে ইসরাইলি বাহিনী লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এরপর ২০০৬ সালে আবারো হিজবুল্লার বিরুদ্ধে ইসরাইল যুদ্ধ ঘোষণা করে। সে যুদ্ধে কোন দলই পূর্ণাঙ্গ বিজয় অর্জন করতে না পারলেও; হাসান নাসরুল্লাহ একজন অভিজ্ঞ সামরিক কৌশলী নেতা হিসেবে তার যোগ্যতার প্রমাণ দেন। পরবর্তীতে নাসরুল্লাহ বাশার আল আসাদের পক্ষে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার এই সিদ্ধান্তের কারণে তিনি ব্যাপক সমালোচিত হন। সেই সাথে আরব বিশ্বে হিজবুল্লাহ মর্যাদা অনেকটাই কমে যায়। তবে এর মাধ্যমে হিজবুল্লাহ আরেকটি দিক থেকে লাভবান হয়; আর তা হলো তারা আরো একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে, অতীতের চেয়ে আরো বেশি শক্তিশালী যোদ্ধা বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠে। ইসরাইল একাধিকবার হিজবুল্লাহর সাথে যুদ্ধে জড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিল যে, হিজবুল্লাহকে পরাজিত করা কোন সহজ বিষয় নয়। তাই তারা বিভিন্ন সময় অতর্কিত হামলা করে, হিজবুল্লাহকে দুর্বল করে রাখার চেষ্টা করতে থাকে; যাতে করে হিযবুল্লাহ কখনোই ইজরায়েলের জন্য অনেক বড় হুমকি হয়ে উঠতে না পারে।

পেজার বিষ্ফোরণ

২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে, হিজবুল্লাহও ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে নিয়মিত রকেট হামলা চালাতে থাকে। এসব হামলার কারণে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের ৭০ হাজার বাসিন্দাকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। এখনও পর্যন্ত তারা তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারেনি। হিযবুল্লাহ বলেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত ইজরাইল গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, ততক্ষণ হিযবুল্লাহও ইসরায়েলে হামলা বন্ধ করবে না। বাস্তবে যদিও হিযবুল্লাহর এসব হামলায় ইসরায়েলের তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল না। তবে ইসরায়েলের উত্তরসীমান্তে ক্রমাগত হিযবুল্লাহর আক্রমণে বিরক্ত হয়ে, ইসরায়েল হিযবুল্লাহর বহু শীর্ষ নেতাকে হত্যা করতে শুরু করে।  

চলতি বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ইসরায়েলের হিযবুল্লাহ দমনের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ দেখা যায়। ইসরায়েল হিযবুল্লাহর যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য নজিরবিহীন এক পেজার হামলা চালায়। পেজার হল এক ধরনের যোগাযোগের যন্ত্র। এই যন্ত্রে মোবাইলের এসএমএসের মত শুধু মেসেজ রিসিভ করা যায়, কিন্তু কোন মেসেজ পাঠানো যায় না। অতীতে হিযবুল্লাহর একজন শীর্ষ কমান্ডার ফুয়াদ শুকুরের স্মার্টফোন ট্রাক করে, তাকে হত্যা করার পর থেকে; হিযবুল্লাহ সদস্যরা ইসরায়েলের নজরদারি থেকে বাঁচতে স্মার্টফোনের মত আধুনিক ডিভাইস ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে। সেকারণে তারা কমান্ডাদের কাছে তথ্য পৌছানোর জন্য পেজার ব্যবহার করতে শুরু করে। কিন্তু হিযবুল্লাহ যে কম্পানির কাছ থেকে পেজারগুলো কিনেছিল, সেই কম্পানির মালিকও একজন ইসরায়েলী গোয়েন্দা। ইসরায়েলী গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ এসব পেজারের দুটি ব্যাটারির একটিতে বিষ্ফোরক দ্রব্য ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়। মোসাদ অপেক্ষা করছিল যে হিযবুল্লাহর কেনা ৫ হাজার পেজার, কোন এক ক্রান্তিলগ্নে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে তারা হিযবুল্লাহর যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দু একটি পেজার নষ্ট হওয়ার পর, সেগুলো ঠিক করতে গিয়ে, হিযবুল্লাহ সদস্যরা পেজারের ভেতর সন্দেহজনক কিছু টের পায়। তখন মোসাদ ঠিক করে যে, এখনই পেজারগুলোতে বিষ্ফোরণ না ঘটালে ভবিষ্যতে এটি আর কোন কাজে আসবে না। এরফলে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২ হাজার ৮০০ পেজার এবং বেশ কিছু ওয়াকিটকিতে একযোগে বিষ্ফোরণ ঘটানো হয়; যার ফলে ৪২ জন নিহত এবং ৩ হাজার ৫০০ লোক আহত হয়েছে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল লেবানন জুড়ে ভয়াবহ নতুন আরেক যুদ্ধের সূচনা করে।

বর্তমান সঙ্কট

লেবাননে যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে, ইসরায়েল ইতোমধ্যে প্রায় এক হাজার পাঁচশর বেশি হামলা চালিয়ে, লেবাননের এক হাজারের মত নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। এর বিপরীতে হিযবুল্লাহও ইসরায়েলে রকেট হামলা চালিয়েছে, কিন্তু তাতে ইসরায়েলের কোন ক্ষতি হয়নি। ইজরায়েল লেবাননের সাধারণ নাগরিকদের ঘরবাড়িতে হামলা চালানোর জন্য, আবারো সেই পুরনো ছল চাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে। ইসরাইল বলছে হিজবুল্লাহ সাধারণ আবাসিক ভবনের ভেতরে রকেট ও গোলাবারুদ সংরক্ষণ করে। সে কারণে ইসরায়েল লেবাননের বেসামরিক নাগরিকদের উপরও হামলা চালাচ্ছে। ঠিক একই ধরনের অজুহাত গাজায় আগ্রাসন চালানোর সময়ও ইসরাইল ব্যবহার করেছিল। তাদের দাবি হামাস গাজার সাধারণ নাগরিকদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। সে কারণেই তারা হামাস ধ্বংসের নামে, বিগত এক বছর যাবৎ নির্বিচারে ফিলিস্তিনের ৪১ হাজারেরও বেশি  নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। গাজায় প্রথমে ব্যাপক বিমান হামলা চালানোর পর যেমন, সেনা অভিযান চালানো হয়েছিল; এখন লেবাননেও ঠিক সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি চলছে। একদিকে লেবাননে লাগাতার বিমান হামলা চালানো হচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েলী সেনাদেরকে উত্তরাঞ্চলে লোবনন সীমান্তের কাছে জড়ো করা হচ্ছে। যেকোন সময় লেবাননের ভেতর স্থল অভিযানও শুরু হয়ে যেতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ের হামলা বাদেই, এখনও পর্যন্ত ইসরায়েল এবং লেবাননের মধ্যে যতগুলো আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, তার ৮২ শতাংশই করেছে ইসরায়েল। তারমানে ইসরায়েল নিজেই সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী। অথচ তারাই আবার নিজেদের নিরাপত্তার অযুহাতে; সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে; মধ্যপ্রাচ্যে লাখো নিরাপরাধ নারী ও শিশু কে নির্বিচারে হত্যা করে যাচ্ছে। ইসরাইল হামাস এবং হিজবুল্লাহর কার্যক্রমকে সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দিলেও; সত্যিকার অর্থে সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে ইজরায়েলের চেয়ে বড় কোন সন্ত্রাসী সংগঠনের আবির্ভাব ঘটেনি। মধ্যপ্রাচ্যে আরবদের ভূমি জবর দখল করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে, এই অঞ্চলে যে ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরী হয়েছে তা সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে বিরল।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।