ইসরায়েল কেন ইরানে হামলা করল

maxresdefault (10)
কি কেন কিভাবে

ইসরায়েল কেন ইরানে হামলা করল

ভূমিকা

সাম্প্রতিক সময়ে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ব্যাপক হামলা চালায়, যার কোডনাম ছিল “অপারেশন রাইজিং লায়ন”। এই হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক নেতা এবং বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন।

এর জবাবে ইরান তেল আবিব ও জেরুজালেমসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এই হামলা-পাল্টা হামলা শুধু দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধ এবং পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করেছে।

ই স রা য়ে ল কেন ইরানে হা ম লা করল ?

ইসরায়েল কেন ইরানে হামলা করল?

ইসরায়েল ইরানে হামলা চালানোর পেছনে একাধিক কৌশলগত ও রাজনৈতিক বিষয়কে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। প্রথমত, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ইসরায়েলের জন্য দীর্ঘদিন ধরে অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ২০২৫ সালে জানিয়েছে যে ইরান উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ত্বরান্বিত করেছে, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। ইসরায়েল এই কর্মসূচিকে নির্মূল করার লক্ষ্যেই মূলত ইরানের তেহরান, নাতাঞ্জ, খোন্দাব, এবং খোররামাবাদের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এই হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডার হোসেইন সালামি, এয়ারোস্পেস ফোর্সের প্রধান আমির আলি হাজিজাদেহ, সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাঘেরি, এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানী ফেরেইদুন আব্বাসি ও মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি নিহত হয়েছেন।

২০২৪ সালেও ইসরায়েল সিরিয়ার দামেস্কে বিনা উষ্কানিতে ইরানি কনসুলেটে হামলা করেছিল। তখন তারা এর কারণ হিসেবে বলেছিল ইরান হিজবুল্লাহ, হামাস, এবং ইয়েমেনের হুথিদের মতো প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পরোক্ষ যুদ্ধ চালাচ্ছে। এই গোষ্ঠীগুলোর পেছনে ইরানের আর্থিক ও সামরিক সমর্থন ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তখন দামেস্কে কনস্যুলেটে হামলার প্রতিশোধ নিতে ইরানও ইসরায়েলে পাল্টা হামলা চালিয়েছিল। সেই থেকে দুই দেশের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের সূত্রপাত হয়।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইরানে ইসরায়েলী হামলার অন্যতম কারণ হল, কয়েক দিন আগে ইরান দাবি করেছিল যে তারা ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচির গোপন নথি সংগ্রহ করেছে এবং তা অচিরেই প্রকাশ করবে। ইরানের সেই হুমকির কারণেই ইসরায়েল আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেয়। অথচ এই একই ধরনের কাজ ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে ইরানের বিরুদ্ধে করে যাচ্ছে।

ইসরায়েলের মনোভাব হল, তারা নিজেরাই সবার আগে হামলা চালাবে, এরপর প্রতিপক্ষ পাল্টা হামলা চালালে বলবে, এজন্যই আমরা আগে হামলা চালিয়েছিলাম। এভাবে মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাস দমনের নামে ইসরায়েল নিজেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের কারণ

আন্তর্জাতিক নিয়মের তোয়াক্কা না করে, ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে হামলা চালানোর জন্য চীন ছাড়া বিশ্বের অন্য কোন দেশ প্রকাশ্যে কোন নিন্দা জানায়নি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের হামলার সমালোচনা করার বদলে বরাবরের মতই ইসরায়েলকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ হল, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও উদ্বেগের বিষয়, কারণ এটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য নষ্ট করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হবার পর ভেবেছিল যে, ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তি করে সে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিবে। কিন্তু বরাবরের মতই ব্যার্থ হয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এই আলোচনা থেকে পিছু হটে এবং ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে THAAD ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে, ইরানের পাল্টা হামলা থেকে ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান সামরিক ঘাঁটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

ইরানের পাল্টা হামলা

ইরান ১৩ জুন দিবাগত রাতে ইসরায়েল জুড়ে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা শুরু করে। ইরানের বিপ্লবী গার্ড জানিয়েছে, তারা কয়েক দফায় হামলা চালিয়েছে। কিন্তু হামলা এখনও শেষ হয়নি। ইরান দাবি করেছে যে তারা ইসরায়েলের সামরিক ও কৌশলগত স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করেছে। জেরুজালেমে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে, তবে এটি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নাকি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।

তবে এখন পর্যন্ত ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। ইসরায়েলের আয়রন ডোমের মত উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন মাটিতে পড়ার আগেই ধ্বংস করে দিয়েছে। ইরান জানিয়েছে যে তারা আরও হামলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে এবং এই হামলা অব্যাহত থাকতে পারে। এখনও পর্যন্ত হামলা বন্ধের কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।

পারমাণবিক অস্ত্র বাস্তবতা

ইরান বরাবরই দাবি করে আসছে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বিদ্যুৎ উৎপাদনের মত শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার হয়। বাস্তবেও ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র থাকার বিষয়ে কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই। তবে, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা এবং পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে অগ্রসর হয়েছে, যা অস্ত্র তৈরির জন্য ব্যবহার করা সম্ভব।

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ভূগর্ভে অবস্থিত, যা হামলার মাধ্যমে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা কঠিন। বিশ্লেষকদের মতে, ইরান এখনও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেনি, তবে তারা প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এই বিষয়টি নিয়ে ইরান কে চাপে রেখে উল্টো ইসরায়েল আর যুক্তরাষ্ট্র মিলে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ সংঘাত ডেকে আনছে।

অথচ, ইসরায়েল নিজের কাছেই পারমাণবিক অস্ত্র আছে, কিন্তু তারা এটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না। যাদের কাছে পারমানবিক অস্ত্র থাকাটা পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ তারা হল ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এদের মনোভাব হল, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল পারমানবিক সক্ষমতা অর্জন করে তা হবে বিশ্ব শান্তির জন্য। কিন্তু ইরান পারমানবিক সক্ষমতা অর্জন করলে তা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ ছড়াবে।

পশ্চিমাদের এ ধরনের দ্বিমুখী নীতির কারণে বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ যুদ্ধ আর সংঘাত তৈরী হয়েছে।

ভবিষ্যৎ পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটি একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, যার মধ্যে পারমাণবিক সংঘাতের সম্ভাবনা উপেক্ষা করা যায় না। ইরান ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার জবাবে আরও তীব্র পদক্ষেপ নিতে পারে। তারা ইসরায়েলের পারমাণবিক স্থাপনা বা অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে লক্ষ্য করতে পারে, যা ইসরায়েলকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে উৎসাহিত করতে পারে। ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহ, হুথি, এবং ইরাকি মিলিশিয়ারা সংঘাতে জড়াতে পারে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, এবং জর্ডান ইসরায়েলের পক্ষে রয়েছে। রাশিয়া ও চীনের অবস্থানও এই সংঘাতকে বিশ্বব্যাপী ভিন্ন মাত্রা দিতে পারে।

ইরান যদি সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় বা ইসরায়েলের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করে, তবে সংঘাত পারমাণবিক পর্যায়ে যেতে পারে। কিছুদিন আগে ইরান বলেছিল “আমরা প্রস্তুত” – তাদের এই বার্তা পারমানবিক যুদ্ধের আশঙ্কা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইরান দাবি করেছে যে তারা ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচির হাজার হাজার গোপন নথি সংগ্রহ করেছে, যাকে তারা “ইতিহাসের বৃহত্তম গোয়েন্দা অভিযান” বলে অভিহিত করেছে। এই নথি প্রকাশের হুমকি ইসরায়েলের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং যা এই সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে।

হামলা-পাল্টা হামলার ক্ষয়ক্ষতি

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত একটি দীর্ঘমেয়াদী চলমান প্রক্রিয়া। তাই এই উত্তেজনার ভবিষ্যৎ কি হতে পারে, বিশ্লেষকেরা তা আগে থেকে কোনভাবেই আঁচ করতে পারছেন না।

তবে ইরান মুখে অনেক কথা বললেও বাস্তবে তারা ইসরায়েলের ততটা ক্ষতি করতে পারছে না। ইসরায়েল যতবার ইরানকে আক্রমণ করেছে, ততবারই ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামিরক ব্যক্তিদের হত্যা করা সহ, কৌশলগত অবকাঠামোতে আঘাত করেছে। কিন্তু ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতিই হয়নি।

এমনকি ২০২৪ সালের এপ্রিলে ইরান ইসরায়েলে পাল্টা হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে ইসরায়েলকে পরোক্ষভাবে জানিয়েছিল। সেসময় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরাব্দোল্লাহিয়ান জানিয়েছিলেন, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আগেই বলেছিল যে ইরান সীমিত ও আত্মরক্ষামূলক হামলা করবে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।