ইসরায়েলী আগ্রাসনের শেষ কোথায়

maxresdefault (2)
জীবনযাপন

ইসরায়েলী আগ্রাসনের শেষ কোথায়

ভূমিকা

সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় ইসরায়েলী আগ্রাসন মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায় রচনা করেছে। দীর্ঘ পনের মাস একটানা গনহত্যা চালিয়ে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি দিলেও, মাত্র দুই মাসের মাথায় ইসরায়েল আবারো গাজায় ভয়াবহ হামলা শুরু করেছে।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গাজা গণহত্যার ভিডিওগুলো দেখলে যে কোন বিবেকবান মানুষের হৃদয় ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাবে। কিন্তু এত ধ্বংস যজ্ঞের পরও ইসরায়েলের মন ভরছে না। তারা বহু আগেই গাজাকে সম্পূর্ণ মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে, এখন সেখানকার ফিলিস্তিনী বাসিন্দাদের পুরোপুরি হত্যা করার আগে হয়ত ইসরায়েল ক্ষান্ত হবে না।

ই স রা য়ে লী ধ্বংসযজ্ঞের শেষ কোথায় ?

ইসরায়েলী মিথ্যাচার

ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান জাতিগত নিধন শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। পশ্চিমা গণমাধ্যম থেকে শুরু করে, ইসরায়েলপন্থীরা বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে যেন, ফিলিস্তিনের সমস্যা শুরুই হয়েছে ৭ অক্টাবর, তার আগে যেন ইসরায়ের ফিলিস্তিনীদের উপর কোনই অবিচার করেনি।

বাস্তবতা হল, এই সংঘাত শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র জন্মের সূচনালগ্ন থেকে। জাতিসংঘের প্রস্তাবনার মাধ্যমে ইসরায়েল একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করলেও, ইসরায়েলের জন্মের পর প্রথম যে কাজটি করেছে তা হল, জাতিসংঘের প্রস্তাবনার অবমাননা। জাতিসংঘের প্রস্তাবে, ফিলিস্তিনীরা জনসংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও, তাদেরকে নিজেদের মাতৃভূমির মাত্র ৪৩ শতাংশ অঞ্চল দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে উড়ে এসে জুড়ে বসা ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনী ভূখন্ডের ৫৭ শতাংশ অঞ্চল দিয়ে দেওয়া হয়। অথচ সেই সময়ই ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ৭৩ শতাংশ অঞ্চল দখর করে নেয়।

পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে অবৈধ স্যাটেলমেন্ট গড়ে তুলো একটু সমগ্র ফিলিস্তিনী ভূখন্ডকেই গিলে খেয়েছে ইসরায়েল। এমন অন্যায়ভাবে ইসরায়েলীরা যে ফিলিস্তিনের মানচিত্র চিবিয়ে খেয়েছে, জাতিসংঘের তার বিরুদ্ধে বহুবার নানা ধরনের প্রস্তাব পাশ হয়েছে। শুধু ফিলিস্তিনের জমি দখলই নয়, খুন, হত্যা, লুটতরাজ আর নানা ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে, ২০১৩ সালের মধ্যেই জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ৪৫ টি রেজুলিউশন পাশ করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ United Nations Human Rights Council বা UNHRC গঠনের পর থেকে সারা বিশ্বের যতগুলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে, শুধুমাত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধেই তার চেয়ে অনেক বেশি নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে। তারমানে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসরায়েলের মত এককভাবে এত বেশি মানবতাবিরোধী অপরাধ আর কোন সন্ত্রাসী সংগঠনও করেনি।

বিগত দীর্ঘ ৭৮ বছর ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনী জনগণের উপর যে আগ্রাসন চালিয়ে আসছে, তার ইতিহাস পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রচার করা হয় না। তাদের মতে সবকিছুর সূত্রপাত হয়েছে ৭ অক্টোবর। তার আগে যেন ইসরায়েল কিছুই করেনি।

৭ অক্টোবর এর আগে

৭ অক্টোবরের আগেও বহুবার ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাত চরমে উঠেছে। তবে একাধিক আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ছাড়া, ফিলিস্তিনের সাথে ইসরায়েলর সংঘাতগুলো মোটেও যুদ্ধ ছিল না। সেগুলো ছিল ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধ।

৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে হামাসের আকস্মিক আক্রমণের আগে, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সর্বশেষ বড় সংঘর্ষ ঘটে ২০২১ সালের মে মাসে। সেই সংঘর্ষটি ১০ মে থেকে শুরু হয়ে ২১ মে পর্যন্ত স্থায়ী ছিল এবং এটি ‘গার্ডিয়ান অফ দ্য ওয়ালস অপারেশন’ নামে পরিচিত।

ইসরায়েলের দাবি সেসময় হামাসের সাথে যে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল, ৭ অক্টোবরের হামলার মাধ্যমে হামাস সেই শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করেছে। অথচ এটি একটি নির্জলা মিথ্যা কথা। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার মাত্র ১২ দিন আগে ইসরায়েল গাজায় একটানা ৩ দিন বিমানহামলা চালায়। এবং ৪ অক্টোবর গাজার িবপুল সংখ্যক মানুষের পায়ের গোড়ালিতে গুলি করে আহত করা হয়। এই কাজটি ইসরায়েল নিয়মিত করে থাকে। শুধু গাজা নয়, এমনকি পশ্চিমতীরেও ২০২৩ সালে ইসরায়েল এত পরিমাণ ফিলিস্তনীকে হত্যা করেছিল যে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো ২০২৩ সালকে সবচেয়ে ভয়াবহ বছর হিসেবে বর্ণনা করেছিল। আর এর সবকিছুই ঘটেছিল ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার আগে।

তারমানে ৭ অক্টোবর হামলার মাধ্যমে হামাস পূর্ববর্তী যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেনি। বরং ইসরায়েল ৭ অক্টোবরেরও ২ সপ্তাহ আগে থেকে বিমান হামলা চালিয়ে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবতা বিরোধ অপরাধের সূচনা করেছিল।

গাজাবাসীর অপরাধ কী?

ইসরায়েল তার স্বভাবসুলভ মিথ্যাচার দিয়ে অন্যায় গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়ার সকল চেষ্টা করেছে। শুধুমাত্র হামাস নিধনের নামে ২০ লক্ষাধিক গাজাবাসীর জীবনকে প্রকৃত নড়কে পরিণত করেছে। হাসপাতালের নিচে হামাসের সামরিক ঘাটি আছে দাবি করে, গাজার প্রায় সকল হাসপাতাল গুড়িয়ে দিয়েছে।

কিন্তু বিশ্বমানবতার ঝান্ডাবাহী পশ্চিমা প্রতারকেরা একটিবারও প্রশ্ন তোলেনি, হামাস নিধনের নাম কেন লক্ষাধিক গাজাবাসীকে হত্যা করা হল? কেন হামাস নির্মূল করতে গিয়ে, সমগ্র গাজা মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হল?

ইসরায়েলের কাছে যদিও এরও উত্তর আছে। ইসরায়েলের যুক্তি হল, গাজাবাসী যেহেতু হামাসকে ভোট দিয়ে গাজার ক্ষমতায় বসিয়েছে, তাই এর কর্মফল সবাইকে ভোগ করতে হবে। কিন্তু এই বিষয়টিও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ ফিলিস্তিনের সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০০৬ সালে। বর্তমানে গাজার অধিকাংশ বাসিন্দাই শিশু; অর্থাৎ ২০০৬ সালে তাদের জন্মই হয়নি। এবং ২০০৬ সালে যারা নির্বাচন দেখেছে, তাদেরও সেসময় ভোট দেওয়ার বয়সই হয়নি। তাই অধিকাংশ গাজাবাসী হামাসকে ভোট দেওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। শুধু তাই নয়, প্রায় দুই দশক আগের সেই নির্বাচনেও হামাস গাজার সংখ্যারিষ্ঠ ভোট পায়নি।

তারমানে ইসরায়েল এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা একের পর এক মিথ্যাচার ছড়িয়ে, গাজায় সর্বকালের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবতা বিরোধী অপরাধ করে যাচ্ছে।

ধ্বংসযজ্ঞের শেষ কোথায়?

ইসরায়েলী শিশুদের েছাটবেলা থেকে ফিলিস্তিনীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেওয়া হয়। তাদেরকে শেখানো হয় ফিলিস্তিনীরা আসলে মানুষ নয়, তারা মানুষের চেয়ে একধাপ নিচের প্রানী। বেশিরভাগ পাঠ্যবই ও শিক্ষামাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের চিত্র তুলে ধরা হয় নেতিবাচকভাবে; তাদের কখনও “সন্ত্রাসী”, কখনও “হুমকি”, আবার কখনও “অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

ইসরায়েলী ভাষাতাত্ত্বিক জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরিত পেলেদ তার গবেষণায় বলেছেন, ইসরায়েলি পাঠ্যবইগুলোতে ফিলিস্তিনিদের চিত্রায়ন প্রায় সর্বদাই বিকৃত। সেখানে ফিলিস্তিনিদের জীবন, কষ্ট, সংস্কৃতি কিংবা ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই শেখানো হয় না। বরং তাদের চেহারা, পোশাক বা কথাবার্তার মাধ্যমেও এমন বার্তা দেওয়া হয় যে তারা ‘অন্য’, ‘বিপজ্জনক’ বা ‘অগ্রহণযোগ্য’। তাই তাদের হত্যা করা দোষের িকছু না।

তাছাড়া ইসরায়েলীরা ফিলিস্তিনীদেরকে আমালেক হিসেবে সম্বোধন করে। “আমালেক” বলতে মূলত হিব্রু বাইবেলে বর্ণিত একটি জাতিকে বোঝায়, যারা ইসরায়েলিদের চিরশত্রু হিসেবে পরিচিত। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হামাস নিধনের প্রসঙ্গে আমালেক শব্দটি উল্লেখ করেছিল।

বাইবেলের বিবরণ অনুযায়ী, আমালেকীয়রা মিশর থেকে বের হওয়ার পর ইসরায়েলিদের উপর আক্রমণ করেছিল। এই ঘটনার পর, ঈশ্বর মূসাকে নির্দেশ দেন যে আমালেকের নাম সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলতে হবে। সেকারণে ফিলিস্তিনীদের হত্যা করা ইসরায়েলী বহিনী তাদের পবিত্র দ্বয়িত্ব মনে করে।

নির্বিচারে এত এত মানুষ হত্যার জন্য ইসরায়েলীরা মোটেও অনুতপ্ত তো নয়ই, বরং এই মানবতা বিরোধী অপরাধ ঘটানোর জন্য তারা গর্ববোধ করে।

ইসরায়েলী ইতিহাসবিদ ইলান পাপে বলেছেন যে, ইসরায়েল তার শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছে। কারণ যে কোন বৃহৎ সাম্রাজ্য বা ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের পতনের আগে সর্বোচ্চ সহিংসতা তৈরী করে।

অতীতের মিশরীয় সাম্রাজ্য, েরামান সাম্রাজ্য, মঙ্গল সাম্রাজ্য এমনকি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পর্যন্ত সকল প্রতাপশালীর পতন হয়েছিল তাদের নিজেদের তৈরী সহিংসতার মধ্য দিয়ে।

কারণ সৃষ্টিকর্তা মজলুমের দোয়া কখনও ফিরিয়ে দেন না। ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষের দুর্দশা যত বাড়ছে, আল্লাহ সাহায্য তত নিকটে অাসছে। তাই ইসরায়েল পাপাচার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার মধ্যদিয়ে আসলে নিজেদের ধ্বংসই আরো ত্বরান্বিত করছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *


দিন
ঘণ্টা
মিনিট
সেকেন্ড
আমাদের লাইভ ক্লাস শেষ হয়েছে, তবে আপনি এখন ফ্রি রেকর্ডেড কোর্সে ইনরোল করে দেখতে পারবেন।
আপনার রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনার জন্য একটি একাউন্ট তৈরি হয়েছে। প্রদত্ত ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।

কোর্সের তারিখ: ০৩/১০/২০২৫
সময়: রাত ৯টা থেকে
(বাংলাদেশ সময়)

আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।